রাকসু নির্বাচন

লড়বে ১১ প্যানেল আলোচনায় ছয়টি

ফাহমিদুর রহমান ফাহিম, রাবি
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ০৬
ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে আজ থেকে প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হচ্ছে। এবারের নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, সাবেক সমন্বয়ক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমন্বয়ে ১১টি প্যানেল লড়াইয়ে নেমেছে। সে হিসেবে আজ থেকে শুরু হচ্ছে ১১ প্যানেলের লড়াই। তবে ঘোষিত প্যানেলগুলোর মধ্যে শুধু ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরই সবগুলো পদে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। অন্য কোনো সংগঠন বা স্বতন্ত্র প্যানেল তা পারেনি।

নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, এবারের রাকসু নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৩ পদের বিপরীতে ২৪৮ জন, সিনেটে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি পদে ৫৮ জনসহ মোট ৩০৬ প্রার্থী লড়বেন। এছাড়া ১৭ হলে মোট প্রার্থী ৫৯৭ জন।

বিজ্ঞাপন

রাকসুতে মোট ভোটার ২৮ হাজার ৯০১ জন। এর মধ্যে ছেলে ভোটার ১৭ হাজার ৫৯৬ এবং মেয়ে ১১ হাজার ৩০৫ জন।

এবারের রাকসু নির্বাচনে ১১টি প্যানেল বিভিন্ন নামে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’, ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল ‘রাকসু ফর রেডিক্যাল চেঞ্জ’। এছাড়া রয়েছে ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’, ‘অপরাজেয় ৭১, অপ্রতিরোধ্য ২৪’, ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’, ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’, ‘সচেতন শিক্ষার্থী পরিষদ’, ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী জোট’, ‘ইউনাইটেড ফর রাইটস’ এবং ‘ইনডিপেনডেন্ট স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স’।

নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমানে ঘোষিত ১১টি প্যানেলের মধ্যে ছয়টি প্যানেল আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। কারণ, তারা শুধু সংগঠনকেন্দ্রিক প্যানেল ঘোষণা করবে বলে ধারণা করা হলেও তাদের প্যানেলে স্থান পেয়েছেন তিন নারী শিক্ষার্থী, জুলাই আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থী, সাবেক সমন্বয়ক ও একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী।

ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ থেকে সহসভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন শাখা ছাত্রশিবিরের বর্তমান সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে লড়বেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম রেজা এবং সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে লড়বেন ‘স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ক সোচ্চারের’ সভাপতি এসএম সালমান সাব্বির।

মোস্তাকুর রহমান জাহিদের অনার্সে সিজিপিএ ৩ দশমিক ৭৬ এবং মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টারে ৩ দশমিক ৯২ পেয়ে বিভাগে তৃতীয় অবস্থানে আছেন। বর্তমানে তার মাস্টার্সের দ্বিতীয় সেমিস্টার চলমান। তিনি ২০২৩ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ফেলোশিপ পান। এজিএস প্রার্থী ফাহিম রেজা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথ কাঁপিয়েছেন এই ছাত্রনেতা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সব যৌক্তিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন রাজপথের অগ্রণী ভূমিকায়।

ছাত্রশিবিরের প্যানেলে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সাবেক সমন্বয়ক মো. ফাহিম রেজা বলেন, স্বতন্ত্রভাবে জিএস পদে নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা ছিল। পরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে ইনক্লুসিভ প্যানেল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আমি ছাত্রশিবিরের প্যানেলে নির্বাচন করতে সম্মত হই।

এদিকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও তাদের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেছে। প্যানেলে স্থান পেয়েছেন নির্যাতিত ও ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব, যেখানে দলের কর্মীদের বাইরেও জাতীয় দলের ফুটবলার, ব্যান্ড দলের প্রতিষ্ঠাতা, অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত । ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর শাখা ছাত্রদলের সহসভাপতির দায়িত্বে আছেন। ২০২৩ সালে বিএনপির মিছিলে অংশ নেওয়ায় ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী শাকিবুল হাসান বাকীর হাতে মারধরের শিকার হন তিনি।

বর্তমান কমিটির দপ্তর সম্পাদক নাফিউল ইসলাম জীবন। তিনি প্যানেলের জিএস প্রার্থী। ২০২৪ সালের মে মাসে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব ও তার অনুসারীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন জীবন। ছাত্রলীগ নেতারা ওইদিন নাফিউল ও তার সহপাঠী এক বন্ধুকে মাদার বখ্শ হলের ২১৫ নম্বর কক্ষে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে মারধর ও পিস্তল ঠেকিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন বলে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। এছাড়া শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিন বিশ্বাস এষা প্যানেলে এজিএস পদে রয়েছেন।

ছাত্রদল সমর্থিত এ প্যানেলে ক্রীড়া ও খেলাধুলা সম্পাদক হয়েছেন নার্গিস খাতুন। তিনি জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়। এর আগে তিনি অনূর্ধ্ব-১৮ ও ১৯ খেলেছেন। সহক্রীড়া ও খেলাধুলা সম্পাদক পদপ্রার্থী মাহফুজুর রহমান শাওন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টিমের গোলকিপার। সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক শাহরিয়ার আলম অথী ‘অমরত্ব’ ব্যান্ড দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। মহিলাবিষয়ক সম্পাদক স্বপ্না আক্তার শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৩ দশমিক ৮২ সিজিপিএ নিয়ে স্নাতক শেষ করেছেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৪ সালে ডিনস অ্যাওয়ার্ড পান। সহতথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রেদোয়ানুল ইসলাম হৃদয়, যিনি চায়না সাউথ এশিয়া ইয়ুথ এনভয়েজ প্রোগ্রাম-২০২৫-এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সহমিডিয়া ও প্রকাশনা সম্পাদক নূর নবী। তিনি দৈনিক দিনকালের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।

ছাত্রদলের প্যানেল সম্পর্কে নাফিউল ইসলাম জীবন বলেন, আমাদের লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের মৌলিক সমস্যার সমাধান করা। ক্ষমতার রাজনীতি নয়, শিক্ষার্থীদের কল্যাণই আমাদের রাজনীতি। কারণ আমরা সবসময় শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেই। আবাসন সংকট সমাধান, নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং শান্তিপূর্ণ শিক্ষা পরিবেশ গড়াই আমাদের প্রতিশ্রুতি।

জীবন আরো বলেন, আমাদের প্যানেল প্রতিশ্রুতিতে নয়; বরং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনায় বিশ্বাসী। এছাড়া নির্বাচনে ভোটের গোপনীয়তা ও স্বচ্ছতাÑদুটিই সমান জরুরি। অটোমেটিক অথবা ম্যানুয়ালÑযে পদ্ধতিই ব্যবহার করা হোক না কেন, শিক্ষার্থীদের আস্থা নিশ্চিত করাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব, জিএস পদে সালাহউদ্দিন আম্মার এবং এজিএস পদে লড়বেন আকিল বিন তালেব। তিনজনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

সাবেক সমন্বয়কদের আলাদা আলাদা প্যানেলের বিষয়ে মেহেদী সজীব বলেন, ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা সংগঠিত হলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা কমিটি হয়নি। কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হলেও সমন্বয়করা সেখান থেকে পদত্যাগ করেছেন। ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়করা সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার বাইরে কাজ করতে পেরেছেন। শীর্ষ পদ সীমিত হওয়ায় সবাই ভিপি বা জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা রাখলেও ঐক্য গড়া সম্ভব হয়নি। তবে সবার উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণ।

‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ থেকে ভিপি পদে লড়বেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল, জিএস পদে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের কোষাধ্যক্ষ কাউছার আহম্মেদ এবং এজিএস পদে লড়বেন ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম সরকার। বাম সংগঠনগুলোর এ মোর্চায় থাকা প্রার্থীরা যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলনে সরব ছিলেন।

জানতে চাইলে ফুয়াদ রাতুল বলেন, আমাদের প্যানেলের মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করা। আমরা সেই ফ্যাসিবাদের আমল থেকেই শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করছি। ক্যাম্পাসে যখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর লোক পাওয়া যেত না, তখন থেকেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছি। রাকসুতে নির্বাচিত হলে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দেব, যেন রাকসু নিয়মিত হয় এবং অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে রাকসু যুক্ত হয়।

‘রাকসু ফর র‍েডিক্যাল চেঞ্জ’ প্যানেলে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি ও সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী মারুফ। জিএস পদে উত্তরণ লেখক ও পাঠক সূতিকাগারের সাবেক সভাপতি আফরিন জাহান এবং এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আল শাহরিয়ার শুভ।

‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলে ভিপি পদে লড়বেন সাবেক সমন্বয়ক এবং রাকসু নির্বাচনের ইতিহাসে প্রথম নারী ভিপি প্রার্থী তাসিন খান। জিএস পদে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী রাজন আল আহমেদ এবং এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সাবেক সমন্বয়ক মাহাইর ইসলাম।

তাসিন খান বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো রাবিতেও সম্মুখসারিতে ভূমিকা পালন করেছেন ক্যাম্পাসের নারী শিক্ষার্থীরা। নারী ভোটাররা জুলাইয়ে যেভাবে গণতান্ত্রিক ও অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শামিল ছিলেন, তেমনি নেতৃত্বও দেবেন। আশা করি এবারের রাকসুতে সর্বোচ্চ নারী প্রতিনিধিত্ব আমরা দেখতে পাব।

সার্বিক বিষয়ে রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. এফ নজরুল ইসলাম বলেন, রাকসুর কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চলছে এবং সবকিছু ঘোষিত তফসিল অনুযায়ীই অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র বিতরণ, যাচাই-বাছাই ও দাখিল সম্পন্ন হয়েছে। শুরু হয়েছে প্রচার।

আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে রাকসু নির্বাচন। ওইদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোয় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর একই দিন ভোট গণনা এবং ফলাফল প্রকাশ করা হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত