আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ

ঐতিহ্য, আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার অনুসন্ধান

প্রতিনিধি, ঢাবি
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ২০: ০৪

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ এমন এক নাম, যিনি জাতির আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের পথকে আলোকিত করেছেন মৌখিক ঐতিহ্যের আলোয়। তার জন্মের ১৫৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে বৃহস্পতিবার বিকেলে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। সূচনা বক্তৃতা দেন মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক মনসুর মুসা। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নেহাল করিম এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ।

বিজ্ঞাপন

মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক মনসুর মুসা বলেন, আদিম যুগে মানুষ শ্রুতি ও স্মৃতির মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সংরক্ষণ করত। পরে ছন্দ ও লিপির মাধ্যমে তা স্থায়ী আকারে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। সেই লিখিত ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের জন্যই আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ এগিয়ে এসেছিলেন।


তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকট তার পথ রুদ্ধ করতে পারেনি। নিজের কেরানির চাকরি থেকে সামান্য আয় সত্ত্বেও তিনি একাই ১৭ হাজারেরও বেশি পুথি সংগ্রহ করেছিলেন। তার এই কাজ আসলে আত্ম-আবিষ্কারের এক অনন্য অভিযান।

অধ্যাপক মনসুর মুসা আরও বলেন, আরাকান রাজসভায় যে বাংলা সাহিত্যচর্চা ছিল, তা আমাদের সামনে এনেছেন আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তার কাজ বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারের এক মহান উদ্যোগ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ বলেন, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ কেবল পুথি সংগ্রাহক নন, তিনি ছিলেন এক গভীর চিন্তাশীল গবেষক। ৫৮৫টি পুথি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন, অনেকগুলো রেখে যান বরেন্দ্র জাদুঘরে। তার এই পরিশ্রমের পেছনে ছিল বাঙালি জাতিকে আত্মপরিচয়ে গৌরবান্বিত করার এক আন্তরিক প্রচেষ্টা।

তিনি বলেন, একজন সাধারণ কেরানী হয়েও তিনি আজীবন সাহিত্যসাধনায় নিবেদিত ছিলেন। আমরা তাকে প্রায়শই পুথি সংগ্রাহক হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখি, অথচ তিনি বাংলা সাহিত্য গবেষণার এক নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন।

অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ ‘জাতি’ ধারণাকে দেখেছিলেন অন্তর্ভুক্তিমূলক মানবিক দৃষ্টিতে। তার কাছে বাঙালিত্ব ছিল ধর্মীয় সীমানা ছাড়িয়ে এক সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধের প্রতীক। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ- সব সম্প্রদায় মিলেই গঠিত বাঙালি জাতি- এই ধারণাই ছিল তার মৌলিক বোধ।

আলোচনায় বক্তারা বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও সাহিত্যবিশারদ নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন এক প্রাতিষ্ঠানিক ধারার গবেষক হিসেবে। তার কাজ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ধারা অনুধাবনের ক্ষেত্রে এক অনন্য ভিত্তি স্থাপন করেছে।

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক তার সভাপতির বক্তব্যে বলেন,
আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ আমাদের শিখিয়েছেন- জ্ঞানচর্চার জন্য ডিগ্রি নয়, প্রয়োজন নিষ্ঠা, শ্রম ও মমতা। আজকের বাংলাদেশে যখন বহুত্ববাদ ও অংশগ্রহণমূলক সমাজ বিনির্মাণের প্রশ্ন সামনে আসে, তখন তার উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের সবচেয়ে বড় দিশা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত