চিকিৎসাযন্ত্র মেরামত ব্যয়ের অর্ধেকই সিন্ডিকেটের পেটে

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ১৬

প্রতি বছর বিভিন্ন হাসপাতালে হাজারের বেশি চিকিৎসাযন্ত্র মেরামতে সরকারে বরাদ্দ প্রায় শতকোটি টাকা। বিপুল এ বরাদ্দ পেয়েও রাষ্ট্রের একমাত্র মেরামতকারী সংস্থা ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) যন্ত্র মেরামতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। যার মূলে প্রতিষ্ঠানটির একটি সিন্ডিকেট।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী নিজেরাই যন্ত্র মেরামত করার কথা থাকলেও ৯০ ভাগই হচ্ছে তৃতীয় পক্ষ, তথা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। যেখানে ঠিকমতো যন্ত্র মেরামত না করেই বিল তোলা, যন্ত্রাংশের দাম কয়েক গুণ বেশি দরে কেনা হয়েছে। এমনকি যেসব ঠিকাদার কোম্পানি যন্ত্র মেরামত করছে তাদেরও ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির অন্তত পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তার নাম এসেছে। যারা প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতালগুলোতে নিজস্ব বায়োমেডিকেল টিকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ার থাকলেও চিকিৎসাযন্ত্রের ত্রুটি দেখা দিলে ভরসা করতে হয় নিমিউ অ্যান্ড টিসির ওপর। যন্ত্র কিনলেও মেরামতে হাসপাতালগুলোর সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা খরচ করতে পারে। এর অতিরিক্ত লাগলে নিমিউয়ের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) নিতে হয়, যা পেতে অন্তত তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। নিমিউয়ের কাছে জিন্মি তারা।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘নিমিউ অ্যান্ড টিসির সক্ষমতার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে কিছু গাফিলতিও পেয়েছি আমরা। ইতিমধ্যে বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। সম্প্রতি তাদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বেশকিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনোভাবেই আমরা অনিয়ম কিংবা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেব না।’

নষ্ট হাজার যন্ত্র, শতকোটি বরাদ্দেও মিলছে না সুফল

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সিটি স্ক্যান, এমআরআইসহ ৬০ ভাগ চিকিৎসাযন্ত্রই দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। ফলে রোগীরা বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখাতে পারলেও রোগ নির্ণয়ের জন্য যেতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে।

প্রায় ২৮ কোটি টাকার এই তিন যন্ত্রের একটি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত, অন্য দুটিও ২০২৩ সাল থেকে নষ্ট। মেরামতে স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের দরকষাকষিতে সময়মতো মেরামত করা যায়নি। এখন নতুন করে কিনতে মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যন্ত্রের এমন বেহাল অবস্থার জন্য নিমিউয়ের গাফিলতিকে দুষছেন নিটোরের সংশ্লিষ্টরা।

নিটোরের যুগ্ম-পরিচালক ডা. মোজাফফর আমার দেশকে বলেন, ‘যন্ত্র মেরামত কেন হয়নি সেটি নিমিউ বলতে পারবে। আমরা শুরু থেকেই জানিয়েছি। এখন একেবারে বিকল হয়ে গেছে। নতুন যন্ত্র ছাড়া উপায় নেই।’

শুধু এ দুই হাসপাতাল নয়, দেশের সরকারি সব হাসপাতালে বছরজুড়েই হাজারের বেশি যন্ত্র বিকল থাকছে, যা মেরামতযোগ্য। এজন্য সরকার প্রতি বছর বরাদ্দ দিচ্ছে প্রায় শতকোটি টাকা। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করলেও সুফল মিলছে না।

নিমিউ অ্যান্ড টিসি সূত্রে জানা গেছে, যন্ত্র মেরামতে গত তিনটি অর্থবছর থেকে ৯০ থেকে ৯৪ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দিয়ে আসছে সরকার।

সংস্থাটির টেকনিক্যাল ম্যানেজার (রিপেয়ার) ইঞ্জিনিয়ার মো. মাসুদ হাসান আমার দেশকে বলেন, ‘সীমিত জনবল দিয়ে বিপুল পরিমাণ যন্ত্র মেরামত অসম্ভব। ফলে প্রতি বছর ৯০ থেকে ৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও কাজে লাগানো যায় না। সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশের মতো খরচ করতে পারি আমরা।’

ঘুরেফিরে কাজ পায় ২২ ঠিকাদার কোম্পানি

সারাদেশের সাত শতাধিক হাসপাতালের যন্ত্র মেরামতে ১৯৮৩ সালে ৯৫ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করে নিমিউ অ্যান্ড টিসি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫০ জন জনবল রয়েছে। ফলে ভরসা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।

অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদার দিয়ে মেরামতের পরও বিপুল সংখ্যাক যন্ত্র বিকল থাকার পেছনে নিমিউ অ্যান্ড টিসির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও ইঞ্জিনিয়ার জড়িত। ঠিকাদারি কোম্পানির কাছ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন নিয়ে কাজ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

নিমিউ অ্যান্ড টিসির পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে করে দেখা গেছে, ২২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ ঘুরেফিরে কাজ পেয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- ফামানটেক করপোরেশন, নাহিদ এন্টারপ্রাইজ, প্যালিকন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, সাইফুল ইসলাম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স রাজু এন্টারপ্রাইজ, নাতাশা হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, সেন্স, ইকরাম বায়োমেডিক লিমিটেড, এ এস রয়, ইনোভেশন সিস্টেম, সিমেন্স, ইরবিস, মেডিটেল, এইচএম ট্রেডার্স, বাংলাদেশ সায়েন্স হাউজ, স্পেকট্রা, মমতাজ এন্টারপ্রাইজ এবং বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স।

নিমিউ অ্যান্ড টিসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, এক সময় প্রতিষ্ঠানটিতে বরাদ্দ ২০ কোটির নিচে ছিল, তখনো যন্ত্রপাতি অনেক বিকল থাকতো। এখন বরাদ্দ বেড়েছে, কিন্তু অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। কারণ একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করছে। কাজ পেতে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ঠিকাদার কোম্পানির স্বত্বাধিকারী বলেন, ‘নিমিউতে এক সময় বৈধভাবে কাজ পাওয়া যেত। কিন্তু ২০১৮ সালের পর থেকে কাজ পেতে হলে কমিশন দিতে হয়। প্রতিবাদ করলে কাজ পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে যারা কাজ পেয়েছেন, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক পতিত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’ ক্ষমতা আর টাকার জোরে তারা কাজ পেতেন বলে অভিযোগ করেন এ ঠিকাদার। অনুসন্ধানে এসব অনিয়মের সম্পৃক্ততার সঙ্গে নিমিউ অ্যান্ড টিসির পাঁচজন ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে।

এসব অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে- টেকনিক্যাল ম্যানেজার (রিপেয়ার) ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. আনোয়ার হোসেন আমার দেশকে বলেন, আমি রিভিউ কমিটিতে থেকেছি, কখনো কাজ দেওয়ার কমিটিতে ছিলাম না। ৫ আগস্টের আগে কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম হলেও হয়তো হয়েছে। কারা সেটি করেছে খুঁজে দেখার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান প্রধানের।

এক লাখ টাকার চেক ভালভ ৫ লাখ টাকা

বছর দুয়েক আগে কিশোরগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এন্ডোসকপি মেশিনের ত্রুটি দেখা দেয়। এজন্য পরিবতর্ন করা হয় চেক ভালভ। নিয়ম অনুযায়ী, নিমিউ এটির মেরামত করে। এজন্য চারটি চেক ভালভ লাগানো হয়। যার দাম রাখা হয় ৫ লাখ টাকা।

হাসপাতালটির বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ান আমান উল্লাহ আমার দেশকে বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হাসপাতালের একটি এন্ডোসকপি মেশিনের চারটি চেক ভালভ লাগানো হয়। সবগুলোর দাম সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা হবে, কিন্তু নেওয়া হয়েছে ৫ লাখ টাকা। অথচ নতুন এই যন্ত্রের দামই ৭ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয় ইকোমেশিনও তারা নিম্নমানের দিয়েছে, যা দিয়ে হার্টই দেখা যায় না।’

জিম্মি দুই শতাধিক বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ান

হাসপাতালের বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ান জানান, ‘আমরা নিমিউতে নিয়োগ চাই না। হাসপাতালে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়া হোক। আমরা দেখছি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং সার্টিফিকেট না থাকা সত্ত্বেও নিমিউয়ের টেকনিশিয়ানরা উপসহকারী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পর্যন্ত পাচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট কাজে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইলেকট্রো-মেডিকেলসহ ৮ থেকে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও আমরা টেকনিশিয়ান।’

বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইন ইলেকট্রো-মেডিকেল/বায়োমেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, সরকার হাসপাতালের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য আমাদের বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু আমরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছি না। আমাদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে। যে কোনো কাজ করতে হলে নিমিউয়ের অনুমতি নিতে হয়। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই।

নিমিউ অ্যান্ড টিসির টেকনিক্যাল ম্যানেজার (রিপেয়ার) ইঞ্জিনিয়ার মো. মাসুদ হাসান বলেন, ‘হাসপাতালে থাকা বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে পারলে সরকারের সাশ্রয় যেমন হবে, কাজের পরিধিও বাড়বে। কারণ ওপেন টেন্ডারে ৫৫ হাজার টাকার কাজ পরে ২ লাখ টাকায় করা লাগে। আমরা তো এটি চাই না।’

অনিয়ম হলে ব্যবস্থা

নিমিউ অ্যান্ড টিসির চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজার (উপসচিব) জয়ন্ত কুমার মুখোপাধ্যায় আমার দেশকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমাদের জনবলের তীব্র সংকটে পড়তে হয়েছে। আমার সক্ষমতা নেই এটা স্পষ্ট। এ কারণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ওপর ভরসা করতে হয়। তবে আমার জানামতে টেন্ডার নিয়ম অনুযায়ী হয়। তারপরও সুনির্দিষ্ট কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত