বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত

আরিফ বিন নজরুল
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৫, ১৭: ৪১

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইবার অপরাধের হারও বাড়ছে। হ্যাকিং, তথ্য চুরি, ফিশিং আক্রমণ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা প্রযুক্তি একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি শরীরের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

বিজ্ঞাপন

যেমন : ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেসিয়াল রিকগনিশন, আইরিস স্ক্যান, ভয়েস রিকগনিশন ব্যবহার করে ব্যক্তিগত তথ্য ও ডিভাইস সুরক্ষিত রাখা যায়। বর্তমানে স্মার্টফোন, ব্যাংকিং, করপোরেট সেক্টর এবং সীমান্ত নিরাপত্তায় বায়োমেট্রিক নিরাপত্তার ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এর কার্যকারিতা, নিরাপত্তাঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গুরুত্বপূর্ণ। আর তা নিচে তুলে ধরা হলো—

এটি কীভাবে কাজ করে?

বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা এমন একটি প্রযুক্তি, যা ব্যবহারকারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করে নির্দিষ্ট ডিভাইস বা সিস্টেমে প্রবেশাধিকার প্রদান করে। এটি মূলত দুটি ধাপে কাজ করে। প্রথমত, শনাক্তকরণ (Identification), যেখানে ব্যবহারকারীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেস, আইরিস বা অন্যান্য বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং আগে সংরক্ষিত ডাটাবেসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। দ্বিতীয়ত, অনুমোদন (Authentication), যদি তথ্য মিলে যায়, তবেই ব্যবহারকারী নির্দিষ্ট সিস্টেম বা ডিভাইসে প্রবেশের অনুমতি পায়। বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে নির্ভুলতা বাড়ানোর চেষ্টা করে। যাতে ভুল শনাক্তকরণের (False Positive/False Negative) হার কমানো যায় এবং নিরাপত্তা আরো উন্নত হয়।

এই নিরাপত্তাব্যবস্থার সুবিধা

বায়োমেট্রিক প্রযুক্তির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলো। এটি পাসওয়ার্ডের চেয়ে নিরাপদ এবং ব্যবহার করা সহজ। এটি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে। কারণ পাসওয়ার্ড হ্যাক করা সম্ভব হলেও বায়োমেট্রিক তথ্য নকল করা অনেক কঠিন। এ ছাড়া এটি ব্যবহার করাও সহজ। কারণ প্রতিবার পাসওয়ার্ড টাইপ করার প্রয়োজন হয় না। শুধু ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যান বা ফেস আনলক করলেই কাজ হয়ে যায়। বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশন দ্রুত কার্যকর হয়, যা সময় বাঁচায় এবং ব্যবহারকারীকে সহজেই অনুমোদন দেয়। নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি আরো কার্যকর। কারণ পাসওয়ার্ডের পাশাপাশি বায়োমেট্রিক ব্যবহার করলে দ্বৈত নিরাপত্তা (Multi-Factor Authentication) নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি চুরি বা ভুলে যাওয়ার ভয় নেই, যা সাধারণ পাসওয়ার্ড ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় সমস্যা।

কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে এটি

বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা বর্তমানে বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্মার্টফোন ও ল্যাপটপে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর এবং ফেস আনলকের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। ব্যাংকিং ও আর্থিক লেনদেনে মোবাইল ব্যাংকিং এবং এটিএমে বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশন ব্যবহার করে নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করা হচ্ছে। সীমান্ত ও পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে অনেক দেশে বিমানবন্দরে পাসপোর্ট চেকিংয়ে ফেসিয়াল রিকগনিশন এবং আইরিস স্ক্যান প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। স্বাস্থ্য খাতে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো রোগীর তথ্য সংরক্ষণে বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশন ব্যবহার করছে। এ ছাড়া করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের অফিসে প্রবেশাধিকার ও গোপন ডাটাবেস ব্যবহারের জন্য বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করছে, যা সংবেদনশীল তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

এই নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি

যদিও বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা অত্যন্ত কার্যকর। তবে এটি কিছু চ্যালেঞ্জ ও নিরাপত্তাঝুঁকির সম্মুখীন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কারো ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফেসিয়াল ডাটা চুরি হলে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না, যা বড় ঝুঁকি তৈরি করে। এ ছাড়া বায়োমেট্রিক তথ্য সাধারণত একটি কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়, যা হ্যাকিংয়ের শিকার হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নির্ভুলভাবে বায়োমেট্রিক তথ্য চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। ফলে অনুমোদিত ব্যবহারকারী প্রবেশাধিকার পায় না বা অননুমোদিত কেউ প্রবেশ করতে পারে না। উন্নত সেন্সর ও ক্যামেরা ছাড়া বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ কার্যকরভাবে কাজ করে না, যা হার্ডওয়্যার নির্ভরতা বাড়ায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অনেক সংস্থা ব্যবহারকারীর বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষণ করে, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

বায়োমেট্রিক নিরাপত্তার সম্ভাবনা

বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা দ্রুত উন্নত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এতে আরো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হবে। এক সম্ভাবনাময় উন্নয়ন হলো ব্রেইনওয়েভ অথেনটিকেশন। যেখানে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট তরঙ্গ শনাক্ত করে অনুমোদন দেওয়া হবে। এ ছাড়া ডিএনএ অথেনটিকেশন ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তির ডিএনএ স্বতন্ত্র, যা নিরাপত্তার নতুন মাত্রা যোগ করবে। মাল্টিমোডাল বায়োমেট্রিকস আরো শক্তিশালী সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। যেখানে একাধিক বায়োমেট্রিক পদ্ধতি একসঙ্গে ব্যবহৃত হবে। যেমনÑফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ফেসিয়াল রিকগনিশন। পাশাপাশি ক্লাউডভিত্তিক বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা উন্নয়ন করা হচ্ছে, যা ব্যক্তিগত ডিভাইসের পরিবর্তে ক্লাউডভিত্তিক অথেনটিকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডাটা আরো সুরক্ষিত রাখবে।

বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা প্রযুক্তি আমাদের ডিজিটাল জীবনকে সহজ, দ্রুত ও নিরাপদ করেছে। পাসওয়ার্ডনির্ভরতার যুগ প্রায় শেষের দিকে। এখন নিরাপত্তার জন্য মানুষ বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশনের ওপর বেশি ভরসা করছে। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এগুলো আরো নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠবে। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং এর সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলোর প্রতি সতর্ক থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়। বরং বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অর্থনীতি এবং তথ্য নিরাপত্তায় নতুন বিপ্লব ঘটাবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত