ড. ফজলুল হক তুহিন
সমকালীন ইতিহাসের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির যোগসূত্র নিবিড়। বিপুল প্রভাববিস্তারী কোনো ঘটনা জীবন ও সমাজের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পকলার সব প্রান্তকে প্রভাবিত করে ভেতরে-বাহিরে। বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ শিল্প-সাহিত্যের ভাষাকে নতুন ব্যঞ্জনা ও মাত্রায় উন্নীত করে।
অনেক আগে থেকেই লেখক-শিল্পী আসন্ন অভ্যুত্থানের ভাব ও ভাষার পাটাতন নির্মাণে তৎপর থাকেন। ইউরোপের রেনেসাঁ, ফরাসি, বলশেভিক ও ইরানি বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত ও ভাষা তৈরির কাজ আগে থেকেই সৃষ্টিশীল ও মননশীল সাহিত্যিক-শিল্পীর হাতে সম্পন্ন হয়। একইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে সিপাহি বিপ্লব ও স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব থেকেই উপনিবেশবিরোধী শিল্প-সাহিত্য সৃজনের কাজ শুরু হয়ে যায়। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে জুলাই গণজাগরণ, গণহত্যা ও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইতিহাসের অদ্বিতীয় যে বাঁকবদল সম্পন্ন হয়, তার সার্বত্রিক প্রভাব অসামান্য।
আর জুলাই বিপ্লবে নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পায় আমজনতা। এই জাগরণ ও গণ-অভ্যুত্থানের শিল্পভাষ্য রচিত হচ্ছে জুলাই-পরবর্তী সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কবিতা, গান, স্লোগান, গ্রাফিতি, প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্যে। চব্বিশ-পূর্ববর্তী অধীনতামূলক প্রবণতা থেকে মুক্ত হয়ে সমকালীন বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠছে স্বাধীন, গণমুখী ও দেশজ। এই অভ্যুত্থানকে সংহত করতে ও আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে সংবিধান, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পুরোনো কাঠামো ভেঙে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায় উজ্জীবিত নতুন ভিত্তি নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন।
কবিতা সমকালীন গণমানুষের স্পন্দকে ধারণ করলেই হয়ে ওঠে সম্মিলিত কণ্ঠস্বর; শিল্পকলায় কবিতা তখন ব্যক্তিগত সীমা ছাড়িয়ে সামষ্টিক ব্যঞ্জনায় সরব ও জনমনস্পর্শী ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়; ঘর-প্রাঙ্গণ হয়ে রাজপথে বুলেটের প্রতিরোধে অদৃশ্য প্রেরণা ও সাহসের আগ্নেয়াস্ত্র হয়ে কথা বলে।
জাতীয় জীবনের বিশেষ ক্ষণে, ঐতিহাসিক পথচলায় ও রক্তাক্ত আন্দোলনে কবিতা অনেক সময় বারুদের ভাষায় গতির লক্ষ্যভেদী হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোর শৃঙ্খল ভেঙে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা একাই রক্তবলকানো সামষ্টিক চেতনায় আত্ম-উদ্বোধন, জাগরণ, দ্রোহ ও প্রতিরোধের রণঝংকার তোলে শিল্পকলার নয়াভাষায়।
পরবর্তী মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে নজরুলের কবিতা প্রেরণার বাতিঘররূপে আলো ছড়িয়েছে। বাংলাদেশে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও তাঁর কবিতা-আগুনের ফুলকি বিপ্লবীদের রণক্ষেত্রে শক্তি জোগায়। নজরুলের বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত কবিদের কলম সাম্প্রতিক লাল জুলাইয়ের দ্রোহী মিছিলে শামিল হয়। গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাপ্রবাহ ও ভাষা ধারণ করে নতুন স্বরে কথা বলেন এই সময়ের কবিবৃন্দ। কয়েকটি কবিতার দৃষ্টান্ত —
শোকগাথা থেকে গেছে অদৃশ্য আড়ালে
ঝরে গেছে কত প্রাণ স্বপ্ন আর স্বম্ভাবনা
প্রতিবাদে পাখিরা গায়নি গান বন্ধ্যা নদী রাতে
হঠাৎ বিপ্লবে ঝড়ে আলুথালু জেগেছে বসুধা
‘গুম’ শব্দ অবশেষে আকাঙ্ক্ষিত মুক্তিও পেয়েছে।
—হাসান হাফিজ
রাষ্ট্র উদ্ধারে আজ আসমুদ্র স্বদেশ ব্যাকুল,
ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশে ফুটবেই পলাশ-শিমুল।
এ ভূমির সবাই আজ তোর মতো সাঈদ সাঈদ,
সম্মিলিত স্বপ্ন চায় রাহুমুক্ত পবিত্র ঈদ।
ফিরে আয় হে সন্তান, ফিরে আয় শূন্য এ বুকে
অমানুষ উৎখাত করে মরি ফের সগৌরব সুখে।
—আবদুল হাই শিকদার
যে ভোলে ভুলুক—
আমি আমার রক্তের কালিতে
সূর্যের করপুটে লিখে দিলাম একটি নাম—
লাল চব্বিশের পাঁচই আগস্ট।
— মোশাররফ হোসেন খান
আমি দেখলাম পাঁচই আগস্ট উড়ছে আকাশে সোনালি ঈগল,
তাকে ঘিরে নৃত্য করছে একজোড়া কপোত-কপোতী আর
বাংলাদেশের সমস্ত দোয়েল।
—সায়ীদ আবুবকর
প্রিয় পুত্র! আজ আমার কোনো আফসোস নেই।
একটি জাতির মুক্তির জন্য
যে সন্তান জীবন দিতে জানে
তাকে জানাই ‘লাল সালাম’।
—মনসুর আজিজ
লাশের মিছিল, গণকবর
খুনির কাতান শাড়িতে
যাত্রাবাড়ি ডুইবা গেল
আজরাইলের ফাঁড়িতে।
চিরকালই স্বাধীনতা
আসে এমন রীতিতে
কত রক্ত লাইগা আছে
বাংলাদেশের সিঁথিতে।
—হাসান রোবায়েত
এইসব স্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা আমাদের আরও অনেক কবির বিপ্লবী কবিতার কাছে নিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর ফিরোজের ‘ঘুরবে রথের চাকা’; মাহবুব হাসানের ‘বোবা-কালা জনগণ’; আবদুল হাই শিকদারের ‘আমরা মানুষ আমরা এসেছি’, ‘সাঈদ’, ‘স্বাধীনতা ও মুক্তি’, ‘স্বদেশ ও সন্তান’, ‘মুগ্ধ’, ‘জুলাই বাংলাদেশ’; সোলায়মান আহসানের ‘আমাদের লড়াইটা শেষ হয়নি’; মুজতাহিদ ফারুকীর ‘যারা রুয়ে দিলে রক্ত-বীজ’; আশরাফ আল দীনের ‘দুঃশাসনের নিপাত হোক’; রহমান হেনরীর ‘বর্ণাংশ’; সেলিম রেজা নিউটনের ‘ভয় কেটে যাবে রাস্তায় যদি নামি’; কাজী জহিরুল ইসলামের ‘শহীদ আবু সাঈদ’; জাকির আবু জাফরের ‘তুমি জাগলে জাগবে বাংলাদেশ’; নয়ন আহমেদের ‘মুগ্ধ; একটি ফিনিক্স পাখি’; আশরাফ হাসানের ‘ডেটলাইন জুলাই ও অন্যান্য’; ইমতিয়াজ মাহমুদের ‘আশুরার কবিতা’; সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাবের ‘তোমরা জুলুম করো’; সাজ্জাদ বিপ্লবের ‘শেষ রক্ষা হবে না তোমার’; জামসেদ ওয়াজেদের ‘সর্বস্বান্ত পদাতিক মাছ’; মাহফুজুর রহমান আখন্দের ‘শিল্পময় নতুন স্বপ্ন’; আফসার নিজামের ‘বের হয়ে যাও আমার সীমানা থেকে’; মুসা আল হাফিজের ‘কার আদেশে’; হাসনাইন ইকবালের ‘অভিশাপ দিচ্ছি’; জব্বার আল নাঈমের ‘জুলাই, দু’হাজার চব্বিশ’; আলতাফ শাহনেওয়াজের ‘রক্তজবা’; পলিয়ার ওয়াহিদের ‘গুলি ও গাদ্দার’; তাজ ইসলামের ‘স্লোগান’, ফজলুল হক তুহিনের ‘গণজোয়ার’ প্রভৃতি জুলাই কাব্যপ্রবাহে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখে। বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের ইতিহাসে জুলাই বিপ্লবের কবিতা একটি নতুন অধ্যায় ও নতুন বাঁক। ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও বাকশালী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই ধারার কবিতা একটি ঐতিহাসিক মাইলপোস্ট। জুলুম, নিপীড়ন, গুম, খুনসহ যাবতীয় মানবতাবাদী অপরাধ ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য এইসব কবিতা জাতীয় সাহিত্য হিসেবে বিবেচনার যোগ্য।
দেড় দশকের দুঃশাসনে ক্ষুব্ধ জনমানসকে ধারণ করে গীতিকবি ও শিল্পীরা কথা ও সুরে প্রকাশ করেন। গণ-অভ্যুত্থানের আগে থেকেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কিছু কিছু গান গণপরিসরে আসন্ন অভ্যুত্থানের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। গীতিকবি ইথুন বাবুর লেখা ও নাজনীন আখতার মৌসুমীর গাওয়া গান তুমুল আলোড়ন তোলে। গণ-আন্দোলনের কালে শিল্পী হান্নান হোসাইন শিমুল র্যাপগানের মাধ্যমে দ্রোহ, ব্যঙ্গ, আক্রমণ ও প্রতিরোধের আগুন জ্বালায় নেট-দুনিয়ায়।
র্যাপগানের নিজস্ব শৈলীতে কথা ও সুরের চলতি ও কথ্য ভাষার ঢঙে তীব্র ও উচ্চ কণ্ঠে একের পর এক লক্ষ্যভেদী গানের তীর নিক্ষেপ করেন। প্রতিবাদী বাংলা গানগুলোর মধ্যে ‘আওয়াজ উডা’ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায়; তারপর ‘কথা ক’ গানটিও বেশ আলোচনায় আসে। সমকালীন গণমানুষের মন ও অনুভবকে নাড়া দেওয়ার মতো গানে ও সুরের প্রবাহে শিল্পী শায়ান ও হায়দার সাহসী ও প্রতিবাদী ভূমিকায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। অন্যদিকে জনপ্রিয় শিল্পী শান সায়েক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শহীদ মুগ্ধ, আবু সাঈদসহ অন্যদের নিয়ে গান তৈরি করেছেন।
‘তোমাদের ভুলব না’ শিরোনামের গানটি লিখেছেন ও সুর করেছেন মিফতাহ করিম এবং শানের সঙ্গে আরও গেয়েছেন লতা আচার্য্য ও মুত্তাক হাসিব। নোমান আজাদের ‘শত্রু আমগো কেডা’ ও ‘শেখ হাসিনা পালাইসে’ গান দুটিও আলোচনায় আসে। এইসব-সহ আরও অনেক গানের অগ্রভাগে নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নতুন ব্যঞ্জনায় জনমনে প্রতিরোধের প্রেরণাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়।
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক মুক্তির রূপরেখা প্রণয়নে এইসব কবিতা ও গান যেমন মূল্যবান সংযোজন, তেমনি আধিপত্যবাদী শক্তির মদতে পালিত ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের প্রতিষ্ঠিত বয়ান ভেঙে গণমুক্তির নতুন বয়ান নির্মাণে স্লোগানের ভূমিকাও অনন্য। দেয়াললিখনে তারুণ্যের যে স্লোগান অঙ্কিত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা নির্ধারণ ও ফ্যাসিবাদকে চ্যালেঞ্জ উপস্থাপিত হয়েছে। একদিকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও বাকশালী ফ্যাসিবাদ মোকাবেলা; অন্যদিকে নতুন স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ নির্মাণের রং-রেখার প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয়েছে সমগ্র দেশে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতৃত্বে পরিচালিত অভ্যুত্থানে বহুল উচ্চারিত কয়েকটি স্লোগান—‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে’; ‘লাশের ভিতর জীবন দে, নইলে যদি ছাইড়া দে’; এক দুই তিন চার/ শেখ হাসিনা গদি ছাড়; ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে; লেগেছে রে লেগেছে/ রক্তে আগুন লেগেছে; আমি কে তুমি কে/ রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে/ স্বৈরাচার স্বৈরাচার; রাজা কার?/ জনতার জনতার; আপস না সংগ্রাম/ সংগ্রাম সংগ্রাম; দালালি না রাজপথ/ রাজপথ রাজপথ; ক্ষমতা না জনতা/ জনতা জনতা; চলছে লড়াই চলবে/ চলছে লড়াই চলবে; আবু সাঈদ মুগ্ধ/ শেষ হয়নি যুদ্ধ; আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত/ সেই রক্ত কোনোদিনই/ পরাজয় মানে না। স্লোগানের বজ্রাঘাতে আগ্রাসী-ঘাতক সরকারের ভিত কেঁপে যায় এবং আমজনতা বুকের মাঝে শক্তি ও সাহস ফিরে পায়। এইসব স্লোগানের প্রেরণা ও গণক্ষোভের বিস্ফোরণে ছাত্র-জনতার অভাবনীয় রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির কবল থেকে বাংলাদেশ সার্বত্রিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন প্রকাশিত।
নতুন স্বপ্ন, সম্ভাবনা, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক রূপান্তর, প্রতিবাদ-দ্রোহ-স্বাধীনতা, ব্যঙ্গ ও উদ্দীপনার প্রতিনিধিত্বশীল গ্রাফিতি, দেয়ালচিত্র ও ক্যালিগ্রাফির রং-রেখা-রূপের প্রতিচ্ছবি বাংলাদেশময় ছেয়ে যায়। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও স্পিরিট ধারণ করে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে নয়া জন-অভিপ্রায় এইসব শিল্পভাষ্যে বাক্সময় হয়ে ওঠে। বল বীর/চির উন্নত মম শির; ভয়ের দেয়াল ভাঙলো এবার/ জোয়ার এলো ছাত্র-জনতার; আমরা নয় তো একজন/ আমরা কয়েকজন; রক্ত গরম/ মাথা ঠান্ডা; হীরক রাণীর দেশে; স্বাধীনতা এনেছি যখন/ সংস্কার করি; সুবোধ সকাল হয়ে গেছে; বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর; আমরা ইন্টারনেট বন্ধ করিনি; বন্ধ হয়ে গেছে; বাংলাদেশ ২.০। চিত্র ও চিত্রকল্প, রং ও রেখা, রূপ ও দৃশ্যকল্প মিলিয়ে যে পেইন্টিং, তা দেশের গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্রে নতুন এক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি, আধিপত্যবাদ থেকে স্বাধীনতা, শৃঙ্খল থেকে জাগরণ, খুন-গুম থেকে নিরাপত্তা, দুর্নীতি-পাচার থেকে দেশপ্রেম, হতাশা থেকে স্বপ্ন, বন্ধ্যাত্ব থেকে সম্ভাবনার রূপান্তরের ভাষা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে গ্রাফিতি ও দেয়াললিখনে। অন্যদিকে মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ক্যালিগ্রাফি নতুন আলোয় উদ্ভাসিত ও বর্ণিল রূপে হাজির হয়েছে। এ এক নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনার রঙিন বাংলাদেশ।
গণ-অভ্যুত্থানের সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক প্রভাব কথাসাহিত্যেও পড়েছে। প্রথমত, দেড় দশকের দুঃশাসনের পর্ব; দ্বিতীয়ত, জুলাই অভ্যুত্থান পর্ব। ফ্যাসিবাদের দীর্ঘদিনের বিচিত্র আখ্যান এবং চরিত্রাবলি গল্প ও উপন্যাসে শিল্পরূপ পেয়েছে। আহমেদ মাওলার উপন্যাস ‘আবু সাঈদ যখন শহীদ হয়েছিল’ এক্ষেত্রে স্মরণীয়। গল্প হিসেবে দীপু মাহমুদের ‘ঝলমলে রোদ্দুরে বিড়ালটি’, হামিদ রায়হানের ‘মুগ্ধর মৃত্যুর শেষ কয়েটি মুহূর্ত’, আসাদুল্লাহ মামুনের ‘শেকল ভাঙার শব্দ’, মনির বেলালের ‘ব্যারিকেড’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব গল্পে গণ-আন্দোলনের ঘটনা, সংলাপ ও কুশীলব বাস্তবতার বারুদ ও রক্তে ভেজা অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেন।
চিত্রকলা. ফটোগ্রাফি, নাটক, আবৃত্তিসহ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার প্রতিটি অঙ্গন বর্তমানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিট ও আকাঙ্ক্ষায় অগ্রসর ও তৎপর হচ্ছে। পুরোনো জঞ্জাল অপসারণ করে নয়া স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মাণের সৃজন ও মননধারার গতি ও বিস্তৃতির ওপর নির্ভর করছে আমজনতার ভবিষ্যৎ। এই ধারার সফলতা মানেই আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদমুক্ত গণবিপ্লবের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।
সমকালীন ইতিহাসের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির যোগসূত্র নিবিড়। বিপুল প্রভাববিস্তারী কোনো ঘটনা জীবন ও সমাজের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পকলার সব প্রান্তকে প্রভাবিত করে ভেতরে-বাহিরে। বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ শিল্প-সাহিত্যের ভাষাকে নতুন ব্যঞ্জনা ও মাত্রায় উন্নীত করে।
অনেক আগে থেকেই লেখক-শিল্পী আসন্ন অভ্যুত্থানের ভাব ও ভাষার পাটাতন নির্মাণে তৎপর থাকেন। ইউরোপের রেনেসাঁ, ফরাসি, বলশেভিক ও ইরানি বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত ও ভাষা তৈরির কাজ আগে থেকেই সৃষ্টিশীল ও মননশীল সাহিত্যিক-শিল্পীর হাতে সম্পন্ন হয়। একইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে সিপাহি বিপ্লব ও স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব থেকেই উপনিবেশবিরোধী শিল্প-সাহিত্য সৃজনের কাজ শুরু হয়ে যায়। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে জুলাই গণজাগরণ, গণহত্যা ও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইতিহাসের অদ্বিতীয় যে বাঁকবদল সম্পন্ন হয়, তার সার্বত্রিক প্রভাব অসামান্য।
আর জুলাই বিপ্লবে নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পায় আমজনতা। এই জাগরণ ও গণ-অভ্যুত্থানের শিল্পভাষ্য রচিত হচ্ছে জুলাই-পরবর্তী সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কবিতা, গান, স্লোগান, গ্রাফিতি, প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্যে। চব্বিশ-পূর্ববর্তী অধীনতামূলক প্রবণতা থেকে মুক্ত হয়ে সমকালীন বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠছে স্বাধীন, গণমুখী ও দেশজ। এই অভ্যুত্থানকে সংহত করতে ও আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে সংবিধান, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পুরোনো কাঠামো ভেঙে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায় উজ্জীবিত নতুন ভিত্তি নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন।
কবিতা সমকালীন গণমানুষের স্পন্দকে ধারণ করলেই হয়ে ওঠে সম্মিলিত কণ্ঠস্বর; শিল্পকলায় কবিতা তখন ব্যক্তিগত সীমা ছাড়িয়ে সামষ্টিক ব্যঞ্জনায় সরব ও জনমনস্পর্শী ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়; ঘর-প্রাঙ্গণ হয়ে রাজপথে বুলেটের প্রতিরোধে অদৃশ্য প্রেরণা ও সাহসের আগ্নেয়াস্ত্র হয়ে কথা বলে।
জাতীয় জীবনের বিশেষ ক্ষণে, ঐতিহাসিক পথচলায় ও রক্তাক্ত আন্দোলনে কবিতা অনেক সময় বারুদের ভাষায় গতির লক্ষ্যভেদী হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোর শৃঙ্খল ভেঙে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা একাই রক্তবলকানো সামষ্টিক চেতনায় আত্ম-উদ্বোধন, জাগরণ, দ্রোহ ও প্রতিরোধের রণঝংকার তোলে শিল্পকলার নয়াভাষায়।
পরবর্তী মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে নজরুলের কবিতা প্রেরণার বাতিঘররূপে আলো ছড়িয়েছে। বাংলাদেশে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও তাঁর কবিতা-আগুনের ফুলকি বিপ্লবীদের রণক্ষেত্রে শক্তি জোগায়। নজরুলের বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত কবিদের কলম সাম্প্রতিক লাল জুলাইয়ের দ্রোহী মিছিলে শামিল হয়। গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাপ্রবাহ ও ভাষা ধারণ করে নতুন স্বরে কথা বলেন এই সময়ের কবিবৃন্দ। কয়েকটি কবিতার দৃষ্টান্ত —
শোকগাথা থেকে গেছে অদৃশ্য আড়ালে
ঝরে গেছে কত প্রাণ স্বপ্ন আর স্বম্ভাবনা
প্রতিবাদে পাখিরা গায়নি গান বন্ধ্যা নদী রাতে
হঠাৎ বিপ্লবে ঝড়ে আলুথালু জেগেছে বসুধা
‘গুম’ শব্দ অবশেষে আকাঙ্ক্ষিত মুক্তিও পেয়েছে।
—হাসান হাফিজ
রাষ্ট্র উদ্ধারে আজ আসমুদ্র স্বদেশ ব্যাকুল,
ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশে ফুটবেই পলাশ-শিমুল।
এ ভূমির সবাই আজ তোর মতো সাঈদ সাঈদ,
সম্মিলিত স্বপ্ন চায় রাহুমুক্ত পবিত্র ঈদ।
ফিরে আয় হে সন্তান, ফিরে আয় শূন্য এ বুকে
অমানুষ উৎখাত করে মরি ফের সগৌরব সুখে।
—আবদুল হাই শিকদার
যে ভোলে ভুলুক—
আমি আমার রক্তের কালিতে
সূর্যের করপুটে লিখে দিলাম একটি নাম—
লাল চব্বিশের পাঁচই আগস্ট।
— মোশাররফ হোসেন খান
আমি দেখলাম পাঁচই আগস্ট উড়ছে আকাশে সোনালি ঈগল,
তাকে ঘিরে নৃত্য করছে একজোড়া কপোত-কপোতী আর
বাংলাদেশের সমস্ত দোয়েল।
—সায়ীদ আবুবকর
প্রিয় পুত্র! আজ আমার কোনো আফসোস নেই।
একটি জাতির মুক্তির জন্য
যে সন্তান জীবন দিতে জানে
তাকে জানাই ‘লাল সালাম’।
—মনসুর আজিজ
লাশের মিছিল, গণকবর
খুনির কাতান শাড়িতে
যাত্রাবাড়ি ডুইবা গেল
আজরাইলের ফাঁড়িতে।
চিরকালই স্বাধীনতা
আসে এমন রীতিতে
কত রক্ত লাইগা আছে
বাংলাদেশের সিঁথিতে।
—হাসান রোবায়েত
এইসব স্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা আমাদের আরও অনেক কবির বিপ্লবী কবিতার কাছে নিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর ফিরোজের ‘ঘুরবে রথের চাকা’; মাহবুব হাসানের ‘বোবা-কালা জনগণ’; আবদুল হাই শিকদারের ‘আমরা মানুষ আমরা এসেছি’, ‘সাঈদ’, ‘স্বাধীনতা ও মুক্তি’, ‘স্বদেশ ও সন্তান’, ‘মুগ্ধ’, ‘জুলাই বাংলাদেশ’; সোলায়মান আহসানের ‘আমাদের লড়াইটা শেষ হয়নি’; মুজতাহিদ ফারুকীর ‘যারা রুয়ে দিলে রক্ত-বীজ’; আশরাফ আল দীনের ‘দুঃশাসনের নিপাত হোক’; রহমান হেনরীর ‘বর্ণাংশ’; সেলিম রেজা নিউটনের ‘ভয় কেটে যাবে রাস্তায় যদি নামি’; কাজী জহিরুল ইসলামের ‘শহীদ আবু সাঈদ’; জাকির আবু জাফরের ‘তুমি জাগলে জাগবে বাংলাদেশ’; নয়ন আহমেদের ‘মুগ্ধ; একটি ফিনিক্স পাখি’; আশরাফ হাসানের ‘ডেটলাইন জুলাই ও অন্যান্য’; ইমতিয়াজ মাহমুদের ‘আশুরার কবিতা’; সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাবের ‘তোমরা জুলুম করো’; সাজ্জাদ বিপ্লবের ‘শেষ রক্ষা হবে না তোমার’; জামসেদ ওয়াজেদের ‘সর্বস্বান্ত পদাতিক মাছ’; মাহফুজুর রহমান আখন্দের ‘শিল্পময় নতুন স্বপ্ন’; আফসার নিজামের ‘বের হয়ে যাও আমার সীমানা থেকে’; মুসা আল হাফিজের ‘কার আদেশে’; হাসনাইন ইকবালের ‘অভিশাপ দিচ্ছি’; জব্বার আল নাঈমের ‘জুলাই, দু’হাজার চব্বিশ’; আলতাফ শাহনেওয়াজের ‘রক্তজবা’; পলিয়ার ওয়াহিদের ‘গুলি ও গাদ্দার’; তাজ ইসলামের ‘স্লোগান’, ফজলুল হক তুহিনের ‘গণজোয়ার’ প্রভৃতি জুলাই কাব্যপ্রবাহে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখে। বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের ইতিহাসে জুলাই বিপ্লবের কবিতা একটি নতুন অধ্যায় ও নতুন বাঁক। ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও বাকশালী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই ধারার কবিতা একটি ঐতিহাসিক মাইলপোস্ট। জুলুম, নিপীড়ন, গুম, খুনসহ যাবতীয় মানবতাবাদী অপরাধ ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য এইসব কবিতা জাতীয় সাহিত্য হিসেবে বিবেচনার যোগ্য।
দেড় দশকের দুঃশাসনে ক্ষুব্ধ জনমানসকে ধারণ করে গীতিকবি ও শিল্পীরা কথা ও সুরে প্রকাশ করেন। গণ-অভ্যুত্থানের আগে থেকেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কিছু কিছু গান গণপরিসরে আসন্ন অভ্যুত্থানের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। গীতিকবি ইথুন বাবুর লেখা ও নাজনীন আখতার মৌসুমীর গাওয়া গান তুমুল আলোড়ন তোলে। গণ-আন্দোলনের কালে শিল্পী হান্নান হোসাইন শিমুল র্যাপগানের মাধ্যমে দ্রোহ, ব্যঙ্গ, আক্রমণ ও প্রতিরোধের আগুন জ্বালায় নেট-দুনিয়ায়।
র্যাপগানের নিজস্ব শৈলীতে কথা ও সুরের চলতি ও কথ্য ভাষার ঢঙে তীব্র ও উচ্চ কণ্ঠে একের পর এক লক্ষ্যভেদী গানের তীর নিক্ষেপ করেন। প্রতিবাদী বাংলা গানগুলোর মধ্যে ‘আওয়াজ উডা’ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায়; তারপর ‘কথা ক’ গানটিও বেশ আলোচনায় আসে। সমকালীন গণমানুষের মন ও অনুভবকে নাড়া দেওয়ার মতো গানে ও সুরের প্রবাহে শিল্পী শায়ান ও হায়দার সাহসী ও প্রতিবাদী ভূমিকায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। অন্যদিকে জনপ্রিয় শিল্পী শান সায়েক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শহীদ মুগ্ধ, আবু সাঈদসহ অন্যদের নিয়ে গান তৈরি করেছেন।
‘তোমাদের ভুলব না’ শিরোনামের গানটি লিখেছেন ও সুর করেছেন মিফতাহ করিম এবং শানের সঙ্গে আরও গেয়েছেন লতা আচার্য্য ও মুত্তাক হাসিব। নোমান আজাদের ‘শত্রু আমগো কেডা’ ও ‘শেখ হাসিনা পালাইসে’ গান দুটিও আলোচনায় আসে। এইসব-সহ আরও অনেক গানের অগ্রভাগে নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নতুন ব্যঞ্জনায় জনমনে প্রতিরোধের প্রেরণাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়।
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক মুক্তির রূপরেখা প্রণয়নে এইসব কবিতা ও গান যেমন মূল্যবান সংযোজন, তেমনি আধিপত্যবাদী শক্তির মদতে পালিত ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের প্রতিষ্ঠিত বয়ান ভেঙে গণমুক্তির নতুন বয়ান নির্মাণে স্লোগানের ভূমিকাও অনন্য। দেয়াললিখনে তারুণ্যের যে স্লোগান অঙ্কিত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা নির্ধারণ ও ফ্যাসিবাদকে চ্যালেঞ্জ উপস্থাপিত হয়েছে। একদিকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও বাকশালী ফ্যাসিবাদ মোকাবেলা; অন্যদিকে নতুন স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ নির্মাণের রং-রেখার প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয়েছে সমগ্র দেশে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতৃত্বে পরিচালিত অভ্যুত্থানে বহুল উচ্চারিত কয়েকটি স্লোগান—‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে’; ‘লাশের ভিতর জীবন দে, নইলে যদি ছাইড়া দে’; এক দুই তিন চার/ শেখ হাসিনা গদি ছাড়; ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে; লেগেছে রে লেগেছে/ রক্তে আগুন লেগেছে; আমি কে তুমি কে/ রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে/ স্বৈরাচার স্বৈরাচার; রাজা কার?/ জনতার জনতার; আপস না সংগ্রাম/ সংগ্রাম সংগ্রাম; দালালি না রাজপথ/ রাজপথ রাজপথ; ক্ষমতা না জনতা/ জনতা জনতা; চলছে লড়াই চলবে/ চলছে লড়াই চলবে; আবু সাঈদ মুগ্ধ/ শেষ হয়নি যুদ্ধ; আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত/ সেই রক্ত কোনোদিনই/ পরাজয় মানে না। স্লোগানের বজ্রাঘাতে আগ্রাসী-ঘাতক সরকারের ভিত কেঁপে যায় এবং আমজনতা বুকের মাঝে শক্তি ও সাহস ফিরে পায়। এইসব স্লোগানের প্রেরণা ও গণক্ষোভের বিস্ফোরণে ছাত্র-জনতার অভাবনীয় রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির কবল থেকে বাংলাদেশ সার্বত্রিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন প্রকাশিত।
নতুন স্বপ্ন, সম্ভাবনা, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক রূপান্তর, প্রতিবাদ-দ্রোহ-স্বাধীনতা, ব্যঙ্গ ও উদ্দীপনার প্রতিনিধিত্বশীল গ্রাফিতি, দেয়ালচিত্র ও ক্যালিগ্রাফির রং-রেখা-রূপের প্রতিচ্ছবি বাংলাদেশময় ছেয়ে যায়। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও স্পিরিট ধারণ করে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে নয়া জন-অভিপ্রায় এইসব শিল্পভাষ্যে বাক্সময় হয়ে ওঠে। বল বীর/চির উন্নত মম শির; ভয়ের দেয়াল ভাঙলো এবার/ জোয়ার এলো ছাত্র-জনতার; আমরা নয় তো একজন/ আমরা কয়েকজন; রক্ত গরম/ মাথা ঠান্ডা; হীরক রাণীর দেশে; স্বাধীনতা এনেছি যখন/ সংস্কার করি; সুবোধ সকাল হয়ে গেছে; বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর; আমরা ইন্টারনেট বন্ধ করিনি; বন্ধ হয়ে গেছে; বাংলাদেশ ২.০। চিত্র ও চিত্রকল্প, রং ও রেখা, রূপ ও দৃশ্যকল্প মিলিয়ে যে পেইন্টিং, তা দেশের গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্রে নতুন এক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি, আধিপত্যবাদ থেকে স্বাধীনতা, শৃঙ্খল থেকে জাগরণ, খুন-গুম থেকে নিরাপত্তা, দুর্নীতি-পাচার থেকে দেশপ্রেম, হতাশা থেকে স্বপ্ন, বন্ধ্যাত্ব থেকে সম্ভাবনার রূপান্তরের ভাষা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে গ্রাফিতি ও দেয়াললিখনে। অন্যদিকে মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ক্যালিগ্রাফি নতুন আলোয় উদ্ভাসিত ও বর্ণিল রূপে হাজির হয়েছে। এ এক নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনার রঙিন বাংলাদেশ।
গণ-অভ্যুত্থানের সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক প্রভাব কথাসাহিত্যেও পড়েছে। প্রথমত, দেড় দশকের দুঃশাসনের পর্ব; দ্বিতীয়ত, জুলাই অভ্যুত্থান পর্ব। ফ্যাসিবাদের দীর্ঘদিনের বিচিত্র আখ্যান এবং চরিত্রাবলি গল্প ও উপন্যাসে শিল্পরূপ পেয়েছে। আহমেদ মাওলার উপন্যাস ‘আবু সাঈদ যখন শহীদ হয়েছিল’ এক্ষেত্রে স্মরণীয়। গল্প হিসেবে দীপু মাহমুদের ‘ঝলমলে রোদ্দুরে বিড়ালটি’, হামিদ রায়হানের ‘মুগ্ধর মৃত্যুর শেষ কয়েটি মুহূর্ত’, আসাদুল্লাহ মামুনের ‘শেকল ভাঙার শব্দ’, মনির বেলালের ‘ব্যারিকেড’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব গল্পে গণ-আন্দোলনের ঘটনা, সংলাপ ও কুশীলব বাস্তবতার বারুদ ও রক্তে ভেজা অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেন।
চিত্রকলা. ফটোগ্রাফি, নাটক, আবৃত্তিসহ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার প্রতিটি অঙ্গন বর্তমানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিট ও আকাঙ্ক্ষায় অগ্রসর ও তৎপর হচ্ছে। পুরোনো জঞ্জাল অপসারণ করে নয়া স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মাণের সৃজন ও মননধারার গতি ও বিস্তৃতির ওপর নির্ভর করছে আমজনতার ভবিষ্যৎ। এই ধারার সফলতা মানেই আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদমুক্ত গণবিপ্লবের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন শিশির বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, শাকসু বানচালের চেষ্টা চলছে। শিক্ষার্থীরা এটা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। যদি আগামী সোমবার ভিসি এসে নির্বাচন কমিশন গঠন করে রোডম্যাপ ঘোষণা না করেন, তাহলে প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের...
২ ঘণ্টা আগেসংগঠনের তথ্য, উপহার প্রদান, অনুভূতি বক্স এবং মেহেদি দেওয়ার জন্য উৎসবের ছাউনিতে চারটি আলাদা বুথ। সেখানে ছিল নারী শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আয়োজকরা নতুন সদস্য আহ্বান ও প্রচারপত্র বিলি করেন। ফটকের সামনে একটি ব্যানারে লেখা, ‛প্রিয় ভাইয়েরা, ভেতরে প্রবেশ ও উঁকি মারা থেকে বিরত থাকুন।’
৩ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন বলেছেন, ছাত্রদল নেতা ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়েদ হোসাইন হত্যাকাণ্ডে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে—কেউ যেন আইনের ফাঁক দিয়ে কেউ বেরিয়ে না যায়।
৪ ঘণ্টা আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বোরকা ও পর্দাশীল নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে। এই মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা।
৪ ঘণ্টা আগে