শেষ কিস্তি
নির্ঝর আহমেদ প্লাবন
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আনতে হলে উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন প্রয়োজন হবে। উপেক্ষিত হলো তারা—যাদের ছোটলোক ও নিচু সম্প্রদায় বলে ওপরতলার লোকেরা সম্বোধন করে, যাদের শ্রমে-ঘামে পৃথিবী আজ এগিয়ে চলেছে; অথচ যারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, সারা দিন-রাত পরিশ্রম করে যারা পরিবারের সদস্যের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে পারে না। দেশের জন্য যারা জান বাজি রেখে পরিশ্রম করে, অথচ দেশ যাদের মূল্য দেয় না, তারাই উপেক্ষিত শক্তি। কৃষক, মজুর, মুটে, মালী, মুচি, কুলিসহ সব ধরনের দেহসর্বস্ব শ্রমজীবী হলো উপেক্ষিত। উচ্চ শ্রেণি-পেশার লোকজন এদের কাছ থেকে শ্রম নেয়, কিন্তু যথাযথ মজুরি দেয় না। তাদের সম্মান করা তো অনেকটা অবান্তর প্রশ্নের মতো ঠেকে ওপরতলার লোকের কাছে। অথচ কৃষক যদি কাজ না করে, শ্রমিক যদি শ্রম না দেয়, তাহলে ভদ্রবেশীদের লেবাস খসে পড়ে। নজরুলের চিন্তনশৈলী হলো, এদের যদি নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা যায় এবং নিজ অধিকার দিয়ে এদের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করানো যায়, তবে এরাই দেশ স্বাধীন করে ফেলবে। যেদিন এরা জাগবে, সেদিনই মহামানুষের মহাভারতের সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ স্বাধীন-সার্বভৌম ভারতবর্ষ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করবে। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার সবাই পাবে। নজরুলের ভাষ্য—
‘শোনাও এ বাণীপীড়িত স্বদেশে, পীড়িত মানুষ ছাড়া
কোনো কিছু নাই, এরই প্রতিকারে জাগুক পরাণে সাড়া।
এই বাণী, এই চেতনা লইয়া স্বদেশ জাগিবে যবে,
মহামানুষের মহাভারতের সেদিন সৃষ্টি হবে।’৬
নজরুল চেয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষদের জাগরণ। তিনি মনে করতেন, শ্রমজীবীরা হচ্ছে উপেক্ষিত শক্তি। এদের একটু ভালোবাসা দিয়ে বুকে টানলেই এদের দিয়ে অনেক মহৎ কাজ সহজে করানো যায়। নজরুল তাদের জাতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ মনে করতেন। তাদের বোধন বাঁশিতে ফুঁ দিতে বলতেন। জাতির মহাজাগরণের দিনে নজরুল তাদের স্মরণে রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। তার ভাবনা, এদের ওপরই দেশের ১০ আনা শক্তি নির্ভর করছে। নজরুলের ভাষায়, ‘যদি একবার এই জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিতে পার, তাহাদিগকে মানুষ বলিয়া ভাই বলিয়া কোল দিবার তোমার উদারতা থাকে, তাহাদিগের শক্তির উন্মেষ করিতে পার, তাহা হইলে দেখিবে তুমি শত বৎসর ধরিয়া প্রাণপণে চেষ্টা সত্ত্বেও যে-কাজ করিতে পারিতেছ না, এক দিনে সেই কাজ সম্পন্ন হইবে।৭
নজরুলের এ জাগরণ চিন্তার শতভাগ প্রয়োগ করেছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। তারা সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এ আন্দোলনে সংযুক্ত করতে পেরেছিল, এমনকি সশস্ত্র বাহিনী ও অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও। নিজেদের শিক্ষকদেরও তারা আন্দোলনে নিয়ে এসেছে। যখন যা দরকার তা-ই করেছে। উপেক্ষিত মানুষদের তারা উপেক্ষা না করে বুকে ঠাঁই দিয়েছে। তাই চট্টগ্রামে কাঠমিস্ত্রিও আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হয়েছে। ঢাকার রিকশাচালকও সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস ‘সাহস পেলাম কোথা থেকে’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, আমাদের মুক্তির স্বপ্নে যারা নির্দ্বিধায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে, তারা ছিল সাহসের প্রেরণা। সেসব রিকশাওয়ালা ভাইদের সহমর্মিতা—যারা বুঝতেন যে আমরা আন্দোলনে আছি, সম্ভাব্য বিপদ চিন্তা করেই বোধহয় বলতেন, ‘মামা একদম টেনশন নিয়েন না, জান গেলে যাইব, তবু মামা আপনাগোর কিছু হইবার দিমু না।’৮
বিনা পারিশ্রমিকে রিকশার ড্রাইভাররা আহত শিক্ষার্থীদের মেডিকেলে নিয়ে গেছে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে মৃত লাশ রিকশায় তুলে বয়ে বেড়িয়েছে। বাংলার তরুণরা পুরো জাতিসত্তাকে একই সরলরেখায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল বলেই বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। উপেক্ষিতরাও জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
বিপ্লব শেষ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস গণনার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। এজন্য নাম দেওয়া হয়েছে জুলাই বিপ্লব। মানুষ এতেও স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। ছাত্ররা স্লোগান দেয়—‘বুকের ভেতর বইছে ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর।’ ঠিকই স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ গুলি করে রংপুরের ছেলে আবু সাঈদের বুকে। আবু সাঈদ রংপুরের সমন্বয়ক ছিলেন। ভয় না পেয়ে গুলির মুখে বুক পেতে দিয়ে পুরো জাতিকে জাগিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। আবু সাঈদের কথা বন্ধ করে দিয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকার। আবু সাঈদকে স্তব্ধ করে দেওয়ার পর খুলে গেছে পুরো জাতির জবান।
যুগবাণী গ্রন্থের ‘মুখবন্ধ’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছিলেন, ‘জোর করিয়া একজনকে চুপ করাইয়া দিলে তাহার ঐ না কওয়াটাই বেশি কথা কয়। কারণ তখন তাহার একার মুখ বন্ধ হয় বটে, কিন্তু তাহার হইয়া—সত্যকে, ন্যায়কে রক্ষা করিবার জন্য আরো লক্ষ লোকের জবান খুলিয়া যায়। বালির বাঁধ দিয়া কি দমোদরের স্রোত আটকানো যায়?’৯ জুলাই ’২৪-এর স্রোতকে আটকাতে পারেনি জালিম সরকার। এ স্রোত খরস্রোতা পদ্মার চেয়ে প্রলয়ংকরী হয়েছিল। এ স্রোত সুনামিতে পর্যবসিত হয়ে গিয়েছিল, যার ধাক্কায় জালিম শাসক মাটিতে টিকতে না পেরে বিমানে করে পালিয়েছে। সবার যখন জবান খুলে গিয়েছে, তখন মুখ বন্ধ করার মতো শক্তি পৃথিবীর কারো ছিল না। জবান খোলার বিনিময়ে দেড় হাজারের ওপরে মানুষ শহীদ হয়েছে, তবুও তারা থামেনি। হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। ৪০ হাজারের ওপরে মানুষ আহত হয়েছে। হাত-পা-চোখ হারিয়েছে শত শত মানুষ। তারপরও কেউ পিছু হটেনি। নজরুলের ভাষায়—‘তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়।’ ভয় দেখিয়ে শাসন করতে গেলে একসময় সে শাসনদণ্ড ভেঙে যায়। মানুষের ভয় উড়ে যায়।
আবু সাঈদ সেই বীজ বপন করে দিলেন। বুকে গুলি নিয়েছেন, পিঠে নয়। যার জন্য একজন বিপ্লবী নারীকে বলতে শোনা গেছে, ‘আমরা অবশ্যই সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত। পেছনে ফেরার পথ নেই। পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা।’ এই স্বাধিকারের চেতনা তো নজরুলেরই স্বপ্ন ছিল। এমন নারীই তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। এই পৃথিবীর সব মহৎ কাজের পেছনে নারীর সমান অংশীদারত্বের কথা ‘নারী’ কবিতায় তিনি বলেছিলেন। জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের নারীসমাজকে তুমুল আন্দোলিত করেছিল নজরুলের ‘নারী’ কবিতা। পৃথিবীর ইতিহাসে নারীদের এমন জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ নজিরবিহীন ঘটনা। পৃথিবীর নারীদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়েছে বাংলদেশের নারীসমাজ।
ধর্মযুদ্ধে যারা মারা যায়, তাদের শহীদ বলা হয়। কিন্তু ‘আনোয়ার পাশা’, ‘কামাল পাশা’ ও আরো অনেক কবিতায় নজরুল দেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদেরও শহীদ বলে সম্বোধন করেছেন। দেশের সঙ্গে ধর্মের মিল ঘটিয়ে তিনি দেশাত্মবোধকে প্রগাঢ় করে তুলেছেন। প্রকারান্তরে স্বাধীনতার স্পৃহাকে বেগবান করে তুলেছেন। ভারতবাসীর স্বাধীনতা না পাওয়ার পেছনে কবি দাবি করেছেন, হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক ভেদাভেদকে।
এছাড়া উঁচু-নিচু, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র ভেদাভেদও অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। ভাইয়ে-ভাইয়ে অমিল; একজন অন্যজনের পেছনে লেগে আছে। এক জাতি অন্য জাতির পেছনে কুৎসা রটায়। কে কাকে কীভাবে দমিয়ে রাখতে পারে, এ যখন চিন্তা তখন ব্রিটিশ রাজাকাররা উভয়কেই কচুকাটা করছে। উভয়েই দেখছে, কিন্তু উভয়েই নির্বিকার। এরপরও তারা ঐক্যবদ্ধ হয় না। এমন পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন করা খুব কঠিন কাজ। নিজেদের বোকামির জন্য নিজেরা পিছিয়ে যাচ্ছে, অথচ কোনো হুঁশ হচ্ছে না এদের। স্বাধীনতা না পেলে সাম্যের প্রসঙ্গটিও দুর্বল হয়ে যাবে। সবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে প্রয়োজন স্বশাসন। শাসনভার যদি অন্যের হাতে থাকে, তাহলে সাম্যের চিন্তা অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হবে। এজন্য কবি স্বাধিকার আদায়ের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তার লেখনীতে ও বক্তব্যে।
নজরুল যে সাম্যের রূপরেখা দেখিয়েছিলেন এবং যে সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণ হতে পারলে বিপ্লব সফল হবে বলেছিলেন, তার সবগুলো পরামর্শ মেনে চব্বিশের বিপ্লবীরা সফল হয়েছেন। চব্বিশের জেন-জির এই সফলতা প্রমাণ করে নজরুল বিপ্লবের যে পথ দেখিয়েছিলেন, সেটিই সঠিক পথ। রাষ্ট্রের স্বার্থে যেসব মত-পথের লোক একই সরলরেখায় আসতে পারে, সেটাও তারা দেখিয়েছেন। নজরুলের এ চিন্তাকে অতীতে যারা ভুল বলে আখ্যায়িত করতেন, তারা বুঝতে পারলেন নজরুলই সঠিক। বিপ্লবের রূপরেখা দেওয়ার শত বছর পরে তার অনুসারীরা বিপ্লব সফল করেছেন। এ এক অনন্য উদাহরণ।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আনতে হলে উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন প্রয়োজন হবে। উপেক্ষিত হলো তারা—যাদের ছোটলোক ও নিচু সম্প্রদায় বলে ওপরতলার লোকেরা সম্বোধন করে, যাদের শ্রমে-ঘামে পৃথিবী আজ এগিয়ে চলেছে; অথচ যারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, সারা দিন-রাত পরিশ্রম করে যারা পরিবারের সদস্যের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে পারে না। দেশের জন্য যারা জান বাজি রেখে পরিশ্রম করে, অথচ দেশ যাদের মূল্য দেয় না, তারাই উপেক্ষিত শক্তি। কৃষক, মজুর, মুটে, মালী, মুচি, কুলিসহ সব ধরনের দেহসর্বস্ব শ্রমজীবী হলো উপেক্ষিত। উচ্চ শ্রেণি-পেশার লোকজন এদের কাছ থেকে শ্রম নেয়, কিন্তু যথাযথ মজুরি দেয় না। তাদের সম্মান করা তো অনেকটা অবান্তর প্রশ্নের মতো ঠেকে ওপরতলার লোকের কাছে। অথচ কৃষক যদি কাজ না করে, শ্রমিক যদি শ্রম না দেয়, তাহলে ভদ্রবেশীদের লেবাস খসে পড়ে। নজরুলের চিন্তনশৈলী হলো, এদের যদি নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা যায় এবং নিজ অধিকার দিয়ে এদের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করানো যায়, তবে এরাই দেশ স্বাধীন করে ফেলবে। যেদিন এরা জাগবে, সেদিনই মহামানুষের মহাভারতের সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ স্বাধীন-সার্বভৌম ভারতবর্ষ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করবে। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার সবাই পাবে। নজরুলের ভাষ্য—
‘শোনাও এ বাণীপীড়িত স্বদেশে, পীড়িত মানুষ ছাড়া
কোনো কিছু নাই, এরই প্রতিকারে জাগুক পরাণে সাড়া।
এই বাণী, এই চেতনা লইয়া স্বদেশ জাগিবে যবে,
মহামানুষের মহাভারতের সেদিন সৃষ্টি হবে।’৬
নজরুল চেয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষদের জাগরণ। তিনি মনে করতেন, শ্রমজীবীরা হচ্ছে উপেক্ষিত শক্তি। এদের একটু ভালোবাসা দিয়ে বুকে টানলেই এদের দিয়ে অনেক মহৎ কাজ সহজে করানো যায়। নজরুল তাদের জাতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ মনে করতেন। তাদের বোধন বাঁশিতে ফুঁ দিতে বলতেন। জাতির মহাজাগরণের দিনে নজরুল তাদের স্মরণে রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। তার ভাবনা, এদের ওপরই দেশের ১০ আনা শক্তি নির্ভর করছে। নজরুলের ভাষায়, ‘যদি একবার এই জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিতে পার, তাহাদিগকে মানুষ বলিয়া ভাই বলিয়া কোল দিবার তোমার উদারতা থাকে, তাহাদিগের শক্তির উন্মেষ করিতে পার, তাহা হইলে দেখিবে তুমি শত বৎসর ধরিয়া প্রাণপণে চেষ্টা সত্ত্বেও যে-কাজ করিতে পারিতেছ না, এক দিনে সেই কাজ সম্পন্ন হইবে।৭
নজরুলের এ জাগরণ চিন্তার শতভাগ প্রয়োগ করেছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। তারা সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এ আন্দোলনে সংযুক্ত করতে পেরেছিল, এমনকি সশস্ত্র বাহিনী ও অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও। নিজেদের শিক্ষকদেরও তারা আন্দোলনে নিয়ে এসেছে। যখন যা দরকার তা-ই করেছে। উপেক্ষিত মানুষদের তারা উপেক্ষা না করে বুকে ঠাঁই দিয়েছে। তাই চট্টগ্রামে কাঠমিস্ত্রিও আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হয়েছে। ঢাকার রিকশাচালকও সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস ‘সাহস পেলাম কোথা থেকে’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, আমাদের মুক্তির স্বপ্নে যারা নির্দ্বিধায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে, তারা ছিল সাহসের প্রেরণা। সেসব রিকশাওয়ালা ভাইদের সহমর্মিতা—যারা বুঝতেন যে আমরা আন্দোলনে আছি, সম্ভাব্য বিপদ চিন্তা করেই বোধহয় বলতেন, ‘মামা একদম টেনশন নিয়েন না, জান গেলে যাইব, তবু মামা আপনাগোর কিছু হইবার দিমু না।’৮
বিনা পারিশ্রমিকে রিকশার ড্রাইভাররা আহত শিক্ষার্থীদের মেডিকেলে নিয়ে গেছে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে মৃত লাশ রিকশায় তুলে বয়ে বেড়িয়েছে। বাংলার তরুণরা পুরো জাতিসত্তাকে একই সরলরেখায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল বলেই বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। উপেক্ষিতরাও জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
বিপ্লব শেষ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস গণনার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। এজন্য নাম দেওয়া হয়েছে জুলাই বিপ্লব। মানুষ এতেও স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। ছাত্ররা স্লোগান দেয়—‘বুকের ভেতর বইছে ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর।’ ঠিকই স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ গুলি করে রংপুরের ছেলে আবু সাঈদের বুকে। আবু সাঈদ রংপুরের সমন্বয়ক ছিলেন। ভয় না পেয়ে গুলির মুখে বুক পেতে দিয়ে পুরো জাতিকে জাগিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। আবু সাঈদের কথা বন্ধ করে দিয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকার। আবু সাঈদকে স্তব্ধ করে দেওয়ার পর খুলে গেছে পুরো জাতির জবান।
যুগবাণী গ্রন্থের ‘মুখবন্ধ’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছিলেন, ‘জোর করিয়া একজনকে চুপ করাইয়া দিলে তাহার ঐ না কওয়াটাই বেশি কথা কয়। কারণ তখন তাহার একার মুখ বন্ধ হয় বটে, কিন্তু তাহার হইয়া—সত্যকে, ন্যায়কে রক্ষা করিবার জন্য আরো লক্ষ লোকের জবান খুলিয়া যায়। বালির বাঁধ দিয়া কি দমোদরের স্রোত আটকানো যায়?’৯ জুলাই ’২৪-এর স্রোতকে আটকাতে পারেনি জালিম সরকার। এ স্রোত খরস্রোতা পদ্মার চেয়ে প্রলয়ংকরী হয়েছিল। এ স্রোত সুনামিতে পর্যবসিত হয়ে গিয়েছিল, যার ধাক্কায় জালিম শাসক মাটিতে টিকতে না পেরে বিমানে করে পালিয়েছে। সবার যখন জবান খুলে গিয়েছে, তখন মুখ বন্ধ করার মতো শক্তি পৃথিবীর কারো ছিল না। জবান খোলার বিনিময়ে দেড় হাজারের ওপরে মানুষ শহীদ হয়েছে, তবুও তারা থামেনি। হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। ৪০ হাজারের ওপরে মানুষ আহত হয়েছে। হাত-পা-চোখ হারিয়েছে শত শত মানুষ। তারপরও কেউ পিছু হটেনি। নজরুলের ভাষায়—‘তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়।’ ভয় দেখিয়ে শাসন করতে গেলে একসময় সে শাসনদণ্ড ভেঙে যায়। মানুষের ভয় উড়ে যায়।
আবু সাঈদ সেই বীজ বপন করে দিলেন। বুকে গুলি নিয়েছেন, পিঠে নয়। যার জন্য একজন বিপ্লবী নারীকে বলতে শোনা গেছে, ‘আমরা অবশ্যই সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত। পেছনে ফেরার পথ নেই। পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা।’ এই স্বাধিকারের চেতনা তো নজরুলেরই স্বপ্ন ছিল। এমন নারীই তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। এই পৃথিবীর সব মহৎ কাজের পেছনে নারীর সমান অংশীদারত্বের কথা ‘নারী’ কবিতায় তিনি বলেছিলেন। জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের নারীসমাজকে তুমুল আন্দোলিত করেছিল নজরুলের ‘নারী’ কবিতা। পৃথিবীর ইতিহাসে নারীদের এমন জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ নজিরবিহীন ঘটনা। পৃথিবীর নারীদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়েছে বাংলদেশের নারীসমাজ।
ধর্মযুদ্ধে যারা মারা যায়, তাদের শহীদ বলা হয়। কিন্তু ‘আনোয়ার পাশা’, ‘কামাল পাশা’ ও আরো অনেক কবিতায় নজরুল দেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদেরও শহীদ বলে সম্বোধন করেছেন। দেশের সঙ্গে ধর্মের মিল ঘটিয়ে তিনি দেশাত্মবোধকে প্রগাঢ় করে তুলেছেন। প্রকারান্তরে স্বাধীনতার স্পৃহাকে বেগবান করে তুলেছেন। ভারতবাসীর স্বাধীনতা না পাওয়ার পেছনে কবি দাবি করেছেন, হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক ভেদাভেদকে।
এছাড়া উঁচু-নিচু, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র ভেদাভেদও অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। ভাইয়ে-ভাইয়ে অমিল; একজন অন্যজনের পেছনে লেগে আছে। এক জাতি অন্য জাতির পেছনে কুৎসা রটায়। কে কাকে কীভাবে দমিয়ে রাখতে পারে, এ যখন চিন্তা তখন ব্রিটিশ রাজাকাররা উভয়কেই কচুকাটা করছে। উভয়েই দেখছে, কিন্তু উভয়েই নির্বিকার। এরপরও তারা ঐক্যবদ্ধ হয় না। এমন পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন করা খুব কঠিন কাজ। নিজেদের বোকামির জন্য নিজেরা পিছিয়ে যাচ্ছে, অথচ কোনো হুঁশ হচ্ছে না এদের। স্বাধীনতা না পেলে সাম্যের প্রসঙ্গটিও দুর্বল হয়ে যাবে। সবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে প্রয়োজন স্বশাসন। শাসনভার যদি অন্যের হাতে থাকে, তাহলে সাম্যের চিন্তা অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হবে। এজন্য কবি স্বাধিকার আদায়ের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তার লেখনীতে ও বক্তব্যে।
নজরুল যে সাম্যের রূপরেখা দেখিয়েছিলেন এবং যে সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণ হতে পারলে বিপ্লব সফল হবে বলেছিলেন, তার সবগুলো পরামর্শ মেনে চব্বিশের বিপ্লবীরা সফল হয়েছেন। চব্বিশের জেন-জির এই সফলতা প্রমাণ করে নজরুল বিপ্লবের যে পথ দেখিয়েছিলেন, সেটিই সঠিক পথ। রাষ্ট্রের স্বার্থে যেসব মত-পথের লোক একই সরলরেখায় আসতে পারে, সেটাও তারা দেখিয়েছেন। নজরুলের এ চিন্তাকে অতীতে যারা ভুল বলে আখ্যায়িত করতেন, তারা বুঝতে পারলেন নজরুলই সঠিক। বিপ্লবের রূপরেখা দেওয়ার শত বছর পরে তার অনুসারীরা বিপ্লব সফল করেছেন। এ এক অনন্য উদাহরণ।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন শিশির বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, শাকসু বানচালের চেষ্টা চলছে। শিক্ষার্থীরা এটা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। যদি আগামী সোমবার ভিসি এসে নির্বাচন কমিশন গঠন করে রোডম্যাপ ঘোষণা না করেন, তাহলে প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের...
৩ ঘণ্টা আগেসংগঠনের তথ্য, উপহার প্রদান, অনুভূতি বক্স এবং মেহেদি দেওয়ার জন্য উৎসবের ছাউনিতে চারটি আলাদা বুথ। সেখানে ছিল নারী শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আয়োজকরা নতুন সদস্য আহ্বান ও প্রচারপত্র বিলি করেন। ফটকের সামনে একটি ব্যানারে লেখা, ‛প্রিয় ভাইয়েরা, ভেতরে প্রবেশ ও উঁকি মারা থেকে বিরত থাকুন।’
৩ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন বলেছেন, ছাত্রদল নেতা ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়েদ হোসাইন হত্যাকাণ্ডে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে—কেউ যেন আইনের ফাঁক দিয়ে কেউ বেরিয়ে না যায়।
৪ ঘণ্টা আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বোরকা ও পর্দাশীল নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে। এই মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থা।
৫ ঘণ্টা আগে