নৌকায় ভেসে হাওর দেখি

অনিতা আক্তার
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৫, ১৩: ০৯
আপডেট : ০৪ মে ২০২৫, ১৩: ১৩

পানির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে থাকা জীবনের প্রতি অন্যরকম আকর্ষণ আছে আমার। এ জীবন যেন একটা বৈচিত্র্যময় সংগ্রামী কবিতা। বাংলাদেশের ল্যান্ডস্কেপ ভীষণ সুন্দর। যেকোনো জায়গা ঘুরতেই ভালো লাগে । কিন্তু জলে ভেসে ভেসে ঘুরে বেড়ানোর ভেতর ভিন্নরকম আবেদন আছে। তাই বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আর মিস করলাম না।

বিজ্ঞাপন

‘Go Girls’-এর পক্ষ থেকে ১২ জনের গার্লস গ্রুপ নিয়ে চললাম সুনামগঞ্জের দিকে। ফকিরাপুল থেকে রাত ১১টার বাসে উঠে বসলাম। যানজট থাকার কারণে সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ৯টা বেজে গেল। সুনামগঞ্জ নেমেই অটো নিয়ে চলে গেলাম বৈঠাখালী ঘাটে। সেখানে আমাদের জন্য বোট অপেক্ষা করছে। অটো ভাড়া ছিল ১২০ টাকা। এক অটোতে ছয়জন করে যাওয়া যায়।

hAHOR _

বোটে ওঠার একটু পরই চলে এলো সকালের নাশতা। খিচুড়ি, ডিম কষা আর সালাদ। সেইসঙ্গে লেবুর শরবত। জলে ভাসতে ভাসতে এসব খাবার খেতে এত সুস্বাদু লাগে। হাওরের রান্না আসলেই খুব মজার। আমাদের দুদিনের হাওর যাপনে যত খাবার আমরা খেয়েছি, প্রতিটি খাবার অসাধারণ ছিল। মনে হয়েছে, শুধু খাবার খাওয়ার জন্য হলেও আবার হাওরে যাওয়া যায়।

যাই হোক, খাওয়া শেষে আমরা সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আর বাইরের প্রকৃতি দেখছিলাম। আমাদের বোটটা পার্সোনাল ছিল, তাই খুব বেশি বড় বোট নিইনি। ১২ সদস্যের জন্য তিন রুমের একটি বোট নিয়েছিলাম। প্রতিটি রুমে অ্যাটাচড বাথরুম ছিল। বোটে অন্য কোনো পর্যটক না থাকার দরুন আমরা একদম নিজেদের মতো সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। বোটে সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য চারজন লোক ছিলেন প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিনে ছিলেন পাঁচজন। তারা প্রত্যেকে খুবই আন্তরিক ছিলেন। বোটেই রান্না হচ্ছে, একেক গঞ্জে থামিয়ে বাজার করা হচ্ছে, বোটের জন্য তেল কেনা হচ্ছে; বোটেই খাওয়া-দাওয়া, ঘুম সব। এ এক অন্যরকম অনুভূতি।

প্রথমে আমরা একটানা অনেকক্ষণ ভাসলাম। ভাসতে ভাসতে শেষ দুপুরের দিকে এক জায়গায় বোট থামল গোসলের জন্য। টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে গেলে সবাই সেখানেই গোসল করে। বড় বোট থেকে নেমে লাইফজ্যাকেট পরে ছোট নৌকায় একটু এগিয়ে গিয়ে যেখানে পানি তুলনামূলকভাবে কম, অর্থাৎ নিরাপদ সেখানে গিয়ে গোসল করতে হয়। বড় বোট তখন অদূরে বেশি জলে নোঙর করা থাকে। ছোট নৌকা আপ-ডাউন ২০০ টাকা করে নেয়। এক নৌকায় ছয়জন অনায়াসে যাওয়া যায়। ছোট ছোট নৌকায় চা, চিপস, বিস্কুট ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের খাবার বিক্রি করে। গোসল করতে করতে পর্যটকরা অনেকেই সেসব খাবার খান।

মনের আনন্দে অনেকক্ষণ গোসল করে বোটে ফিরে এসে পোশাক বদলে নিলাম সবাই। তারপর ছাদে দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো। সাদা ভাত, ভাজি, আলুভর্তা, হাওরের মাছ, সালাদ আর ডাল। শেষ বিকালের মিষ্টি হাওয়ায় জল কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের বোট আর আমরা ছাদে বসে খাচ্ছিলাম। এই অনুভূতি আসলেই অমৃতের মতো।

খাওয়া শেষে সবাই ছাদে বসে গান গাইলাম, আড্ডা দিলাম। সন্ধ্যা আর রাত নামা দেখলাম। চলতে চলতে বোট নীলাদ্রি লেকে এসে থামল। সেখানে সারি সারি বোট নোঙর করে রাখা আছে। একদিকে প্রতিটি আলোকসজ্জিত বোটের আলো, অন্যদিকে মেঘালয়ের পাহাড় কেটে বানানো উঁচু সড়কের নয়নাভিরাম ল্যাম্পপোস্টের আলো দেখতে কী যে ভালো লাগছিল! সময়স্বল্পতার জন্য সেদিন আর কোথাও যাওয়া হলো না। রাতের খাবার খেলাম প্রায় ১২টার দিকে। মুরগির মাংস, ডাল, ভাজি আর সাদা ভাত। তবে তার আগে একবার জম্পেশ ঝালমুড়িও খাওয়া হলো। রাত সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে বলে খাবার শেষ করে একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

যথাসময়ে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। সবাইকে ডেকে তুললাম। রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভোরের নীলাদ্রি লেক দেখার জন্য। যেখানে আমাদের বোট নোঙর করা ছিল, সেখান থেকে নীলাদ্রি লেক খুব কাছে, একদম হাঁটা দূরত্ব। নীলাদ্রি লেকের অন্য নাম শহীদ সিরাজ লেক। সেখানে গিয়ে ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একদিকে মেঘালয়ের বড় বড় পাহাড়, নিচে শান্ত জলের লেক, লেকের ভেতর সারিবাঁধা রঙিন নৌকা আর উঁচুনিচু সবুজ টিলা। সব মিলিয়ে অপূর্ব! এ জায়গাটা ভোরবেলা দেখতে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। এখানে গেলে অবশ্যই নৌকায় ঘোরা মিস করবেন না। তাহলে অসম্ভব সুন্দর একটা অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হবেন।

নীলাদ্রি থেকে অটোতে করে চলে গেলাম লাকমাছড়া দেখতে—কাছেই, ১০ মিনিটের পথ। অটোতে আপ-ডাউন সাধারণত ২০০ টাকা করে নেয় এবং ছয়জন যাওয়া যায়। বাইকে গেলে আপ-ডাউন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নেয়। মাঝখানে লাকমাছড়া ঘুরে দেখার জন্য আধা ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। সেখানে মেঘালয় থেকে আসা ঝরনার জল বয়ে গেছে বাংলার বুক ছুঁয়ে আর আছে সুউচ্চ পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য। পায়ের নিচে শত শত পাথরের মেলা দেখে আর ঝরনার শীতল জলে পা ভিজিয়ে যে কেউ মুগ্ধ হবে।

লাকমাছড়া দেখা শেষ করে আমরা বোটে ফিরে এলাম। যেকোনো ভ্রমণে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠিকমতো সময় ব্যবস্থাপনা না হলে ভালোভাবে ঘুরে দেখা যায় না। হাওরের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা আরো বেশি মেনে চলতে হয়, কারণ রাতে বোট চলে না। আর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব দর্শনীয় জায়গা দেখে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য অবশ্যই সময়সীমা মেনে চলা জরুরি।

বোটে ফেরার পর চলে এলো সকালের খাবার—পোলাও, মুরগির মাংস, বেগুনভাজা, সালাদ আর চাটনি। বোট ছাড়ার পর খাওয়া শুরু করলাম। খাবার শেষ হওয়ার পরই চা পরিবেশন করা হলো। খেয়েদেয়ে সবাই রাজ্যের গল্প করলাম। একসময় বোট এসে থামল শিমুল বাগানে। তখন প্রায় দুপুর। ৫০ টাকা এন্ট্রি ফি দিয়ে শিমুল বাগানে প্রবেশ করলাম। এই মৌসুমে শিমুল বনে সবুজ প্রকৃতি থাকে। এ জায়গাটা সবচেয়ে সুন্দর লাগে শিমুল ফুল ফোটার সময়। সেখানে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোরও সুযোগ আছে।

শিমুল বন ঘুরে আবার আমরা বোটে ফিরে এলাম। কাছেই বারেকের টিলা। সেখানে নেমে বাইক ভাড়া করলাম। প্রতিটি বাইকে দুজন করে যাওয়া যায়। বাইক ভাড়া আপ-ডাউন ২০০ টাকা। তবে হেঁটেও যাওয়া যায় সেখানে। বারেকের টিলায় গিয়ে আমরা পরিবেশ সুরক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করলাম। গ্রুপের সবাই মিলে সেখানকার প্লাস্টিক পরিষ্কার করলাম। জায়গাটি মূলত বাংলাদেশের শেষ সীমানা। পেছনে যাদুকাটা নদী আর মেঘালয়ের পাহাড় মিলে অনিন্দ্য সুন্দর আবহ তৈরি করেছে সেখানে। ওপর থেকে অর্থাৎ বারেকের টিলা থেকে জায়গাটা দেখতে বেশ ভালো লাগে।

ফিরে আসার পর কিছুটা পথ এগিয়ে এক জায়গায় বোট নোঙর করা হলো। সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে গোসলের জন্য নেমে পড়লাম যাদুকাটা নদীতে। ইচ্ছামতো গোসল করলাম। কোনো ছবি তুললাম না এখানে, মুহূর্তটুকু শুধু নির্ভেজাল উপভোগের জন্য রাখলাম। দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো। সাদা ভাত, ভাজি, মুড়িঘণ্ট, ডাল চচ্চড়ি, হাঁসের মাংস আর পাতলা ডাল। স্বাভাবিকভাবেই চা চলে এলো তখনই। চা খেতে খেতে নৌকার গলুইয়ে বসে বিকাল নামা দেখছিলাম। নরম রোদ, মৃদুমন্দ হাওয়া, হাওর অঞ্চলের দৃশ্য আর সঙ্গে চা—এত ভালো লাগছিল! একের পর এক নদী, হাওর ও জনপদ পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। এই অনুভূতি বোঝানো কঠিন। সন্ধ্যায় পৌঁছে গেলাম বৈঠাখালী ঘাটে। আমাদের নুডলস আর চা খেতে দেওয়া হলো। ওহ্‌, বলা হয়নি, বিকালে পেয়ারা মাখাও দেওয়া হয়েছিল। এককথায় হাওর অঞ্চলের মানুষের আতিথেয়তার যেন শেষ নেই।

আমাদের ঢাকা ফেরার বাস ছিল রাত সাড়ে ১১টায়। নোঙর করা বোটে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত থাকলাম আর ঘাট ঘেঁষে যে জনপদ গড়ে উঠেছে রাতের আলো-আঁধারিতে সেখানে হেঁটে বেড়ালাম। তারপর অটোতে করে চলে গেলাম বাসস্ট্যান্ডে। যথাসময়ে রওনা দিয়ে সকাল প্রায় ৭টা নাগাদ পৌঁছালাম ঢাকা। তারপর যে যার মতো বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

হাওর যাপন করে আমার এটাই মনে হয়েছে, জীবনে একবার হলেও জলযানে ভেসে বেড়ানোর অনুভূতি নেওয়ার জন্য প্রত্যেকেরই হাওরে যাওয়া উচিত।

কীভাবে যাবেন

সড়কপথে এনা, শ্যামলী, হানিফ প্রভৃতি বাস সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফকিরাপুল থেকে চলাচল করে। ভাড়া ৭৫০ থেকে এক হাজার টাকা।

রেলপথে ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত গিয়ে তারপর অটো, বাইক বা লেগুনায় ধর্মপাশা বা মধ্যনগর যেতে হয়। ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত ভাড়া ২৭০ থেকে ৫৯০ টাকা। ধর্মপাশা বা মধ্যনগর থেকে শুকনো মৌসুমে বাইকে যেতে পারেন সুনামগঞ্জ, দূরত্ব ৫০-৬০ কিলোমিটার। আর বর্ষা মৌসুমে নৌপথে যেতে পারেন।

কোথায় থাকবেন

সুনামগঞ্জ সদরে পূর্ববাজার স্টেশন রোড, জগন্নাথবাড়ী রোড কিংবা পুরোনো বাসস্ট্যান্ডের স্টেশন রোডে বাজেট হোটেল পেয়ে যাবেন। এ ছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে গেলে সবাই সাধারণত অনিন্দ্য সুন্দর সাজে সজ্জিত বোটেই রাতযাপন করে থাকেন। বোটের ভাড়া মৌসুম, বোটের আয়তন, মান ও দরদামের ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন হয়। ৩০ হাজার টাকায়ও যেমন বোট ভাড়া পাওয়া যায়, আবার লাখ টাকার বোটও আছে সেখানে।

কী খাবেন

আখনি পোলাও, সাতকরা, দেশবন্ধুর মিষ্টি ও রাধানগর বাজারের দুধ-চা খেতে পারেন। এ ছাড়া বোটের মজাদার খাবার তো রয়েছেই।

সতর্কতা

যেহেতু জলবেষ্টিত অঞ্চল, তাই সাঁতার না জানলে সতর্ক থাকা উচিত।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত