সূর্যমুখী ফুলের রাজ্যে

বিউটি হাসু
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪: ০০
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৫, ১৭: ০৪

কুয়াশার চাদরে মোড়ানো শীতের সকাল। সেই কুয়াশা দূরে ঠেলে পূর্বাকাশে মিষ্টি করে হেসে ওঠে সোনালি সূর্য। সেই হাসির উষ্ণতায় সবুজ পাতার আড়াল সরিয়ে সূর্যমুখী ফুলেরাও হেসে ওঠে। সতেজ দীপ্ত হাসিতে বিলিয়ে দেয় অপার মুগ্ধতা। শীতের হিমেল হাওয়ার পরশে আনন্দে হেলেদুলে প্রকৃতিপ্রেমী দর্শনার্থীদের চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে স্বাগত জানায়।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের আলো তির্যক হয়। সূর্যমুখী ফুলগুলোও সূর্যের দিকে মুখ করে পূর্ণ হাসিতে উচ্ছ্বাস ছড়ায়। ফুলের সেই প্রাণখোলা হাসির হলুদ আভায় চোখ জুড়িয়ে যায়। দিগন্ত বিস্তৃত সূর্যমুখী বাগান দূর থেকে দেখলে মনে হয়, প্রকৃতি যেন পরম মমতায় হলুদ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। চোখজুড়ানো ও মনমাতানো এমন অপরূপ সৌন্দর্যের দেখা মিলবে নরসিংদীর নাগরিয়াকান্দিতে মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত ‘সানফ্লাওয়ার গার্ডেন’-এ। এমনই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগের জন্য দর্শনার্থীদের সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে নরসিংদীর মেঘনা নদীর তীরবর্তী বিস্তৃত মাঠজুড়ে থাকা সূর্যমুখী ফুলের বাগান।

বিজ্ঞাপন

Sunflower-flowers-2

সূর্যমুখী এক ধরনের একবর্ষী ফুলগাছ। এ গাছ লম্বায় তিন মিটার হয়ে থাকে, ফুলের ব্যাস ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়। এই ফুল দেখতে কিছুটা সূর্যের মতো। সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে বলেই এর নামকরণ করা হয়েছে সূর্যমুখী।

সূর্যমুখী ফুলবাগানের পাশেই রয়েছে নানা রঙের বিভিন্ন ফুলের সমাহারে সজ্জিত দৃষ্টিনন্দন ‘আপন’ নামের ঘর। বাহারি ফুলে ফুলে সাজানো ঘরটিকে ‘ফুলপ্রসাদ’ নামেই অভিহিত করা যায়। এটি সব পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, ফুলেল সাজসজ্জায় করছে বিমুগ্ধ। মনোরম ফুলপ্রসাদটি বিভিন্ন রঙের ফুলে পরিবেষ্টিত, যেন শিল্পীর রঙতুলিতে আঁকা কোনো নিখুঁত ছবি।

ঢোকার পথেই রয়েছে হরেক রকম বর্ণিল ছাতায় ছাওয়া চোখজুড়ানো রাস্তা। নানা বর্ণের ঝুলন্ত ছাতার সমাহারে সজ্জিত বলে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ছাতা নগরী’। ছাতার সাজ বাগানের সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই তো সৌন্দর্যপিয়াসীরা ঢুকতেই বাহারি ছাতায় ছাওয়া সাজ দেখে আটকে যান। একদণ্ড থেমে ছাতা নগরীতে কিছু ছবি তুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। বাগানে প্রবেশ করার জন্য কাউন্টার থেকে ৫০ টাকার টিকিট কিনতে হবে।

sunfl..

নরসিংদী সদরের নাগরিয়াকান্দি এলাকায় ১৫ বিঘা জমির ওপর তৌহিদুল ইসলাম মাসুম, মাহবুবুর রহমান ও আতাউর রহমান টিটু সূর্যমুখী ফুলের বাগান গড়ে তুলেছেন। তাদের সূর্যমুখী ফুলের বাগানটি অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে দিন দিন মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তারা চার বছর ধরে এই সূর্যমুখী ফুলের চাষ করছেন। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়। দর্শানার্থীদের আগ্রহ থাকায় কয়েক ধাপে এখানে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করা হয়। এক অংশে ফুলে বীজ হয়ে যায়। অপরদিকে, অন্য অংশে ফুলেরা হেসে ওঠে। সৌন্দর্যপিয়াসীদের বিনোদন দেওয়ার জন্য মার্চ মাস পর্যন্ত সূর্যমুখী ফুল থাকে।

বাগানের উদ্যোক্তা তৌহিদুল ইসলাম মাসুম জানান, সূর্যমুখী ফুলের বীজ থেকে তেল উৎপাদন করাই বাগান মালিকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু দর্শনার্থীদের আগ্রহের কারণেই এটি এখন বিনোদনকেন্দ্রে রূপ নিয়েছে।

দশানার্থীদের বিনোদন দেওয়ার পাশাপাশি তারা প্রতিদিন আয় করছেন ৫০ হাজার টাকা। কথা বলে আরো জানা যায়, সূর্যমুখী চাষের বিঘাপ্রতি খরচ ৪০ হাজার টাকা। আর তিনি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছেন এক লাখ টাকা। বাগানটি পরিচর্যা ও দেখাশোনা করার জন্য প্রায় ২০-২৫ কর্মচারী রয়েছেন।

Sunflower-flowers-3

সূর্যমুখী ফুলের মনোরম দৃশ্যে পর্যটক মুগ্ধ: নদীর তীরে হিমেল হাওয়ায় নিরিবিলি পরিবেশ ও ফুলের নিখাদ সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের শুধু চোখ জুড়ায় না, মনকেও করে পরিতৃপ্ত। অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ প্রতিদিন এই ফুলের বাগানে ভিড় করেন। কিছুক্ষণের জন্য হলেও জীবনের সব অবসাদ ও ক্লেশ ভুলে মানুষ ফুলের রাজ্যে হারিয়ে যায়। আর তাইতো সযত্নে গড়ে তোলা হয়েছে সূর্যমুখী বাগান। নান্দনিক সাজে বাগানটি সাজানো হয়েছে। পাশেই নানারকম বর্ণিল ফুলে সজ্জিত ‘আপন’ নামের ফুলের প্রসাদটি। বর্তমানে সূর্যমুখীর পাশাপাশি ‘আপন’ও তার নান্দনিক সৌন্দর্যে দর্শনার্থীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে। আর ফুলের রাজ্য আপন রেস্টুরেন্টে বসে প্রিয়জনের সঙ্গে খাবার খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে আগের দিন ফোন করে খাবারের অর্ডার নিশ্চিত করতে হবে। এতে কাচ্চি, মোরগ পোলাও, সাদা ভাত, মাছ ও মাংস পাওয়া যায়। এসব খাবারে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ গুনতে হবে। এছাড়া এখানে ফাস্ট ফুড, কফি ও আইসক্রিম খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

প্রতিদিন সূর্যমুখী ফুলের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসছেন। ফুলের সৌন্দর্য দেখতে ঢাকা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ভ্রমণপিয়াসীরা ছুটে আসছেন। কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে এসেছেন, কেউবা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে। অনেকে ফুলের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই মাঝে ছোট মৌমাছিরাও থেমে নেই- ফুল থেকে মধু সংগ্রহে তারা ব্যস্ত।

সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নানা বয়সের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় জায়গাটি। আর ছুটির দিনগুলোয় থাকে উপচেপড়া ভিড়। নানা রঙের পোশাকে আকর্ষণীয় সাজে অনেকে এসেছেন হলুদ ফুলের রাজ্যে। নানা রঙে-ঢঙে বিভিন্ন অভিব্যক্তির মাধ্যমে নিজেকে ক্যামেরাবন্দি করছেন। নিজের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলছেন নানা সাজে ও ভঙ্গিমায়।

Sunflower-flowers-4

ডিসেম্বর মাস থেকেই ফেসবুকের টাইমলাইনে ভাসছে সূর্যমুখীর হলুদের আভায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়া মনোমুগ্ধকর নানা জনের ছবি। সবাই সূর্যমুখী ফুলের রাজ্যের সৌন্দর্যের কথা জানিয়ে ঘোরাঘুরির ছবি পোস্ট করছেন। এর ফলে অন্যরাও বাগানে যেতে উৎসাহিত হচ্ছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাগানে থাকে বিভিন্ন বয়সি দশনার্থীদের মিলনমেলা। মেঘনার মৃদু বাতাসের সঙ্গে সূর্যমুখী বাগানের সরস সৌন্দর্য আমাদের মনকে করে বিমোহিত, করে আনন্দিত।

বর্তমানে সূর্যমুখী তেলের উপকারিতা সম্পর্কে মানুষ অবগত হওয়ায় চাষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সূর্যমুখী বাগানে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে বলে অনেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য চাষ করছেন। তবে দর্শনার্থীদের খেয়াল রাখতে হবে, যাতে সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে কৃষকের ফুল ও বাগান নষ্ট না হয়।

যেভাবে যাবেন: মিরপুর থেকে সিনজি করে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন। ভাড়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। মিরপুর থেকে বাসেও এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন যাওয়া যায়। সেখান থেকে ট্রেনে নরসিংদী। ভাড়া ৭০ টাকা (আসন নিয়ে গেলে)। অথবা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী যে ট্রেনগুলো নরসিংদী স্টেশনে থামে, সেই ট্রেনে নরসিংদী স্টেশনে নামবেন। সেখান থেকে নাগরিয়াকান্দি সানফ্লাওয়ার গার্ডেন পর্যন্ত যেকোনো অটোতে ৫০ টাকা ভাড়া নেবে।

রাজধানীর গুলিস্তান থেকে মেঘালয় পরিবহনে নরসিংদী বাসস্ট্যান্ডে নেমে অটোরিকশায় সূর্যমুখী বাগানে যাওয়া যাবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত