ঘাম ঝরে, স্বপ্ন জাগে

ইভা আক্তার
প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৫, ১২: ২৩

‘আলোয় ভরে যে ভুবন, তার ছায়াতেও থাকে গল্প। যেখানে নেই ফুলের মালা, আছে ঘামের চিহ্ন। সম্মান চায় না তারা, চায় শুধু মানুষ হয়ে দেখা। একটু সম্মান, একটু শ্রদ্ধা আর কিছু সহজ কথা।’

ভোরের আলো যখন ঘুমচোখে কুয়াশার চাদর সরিয়ে একফালি সোনালি কিরণ রাখে পৃথিবীর কাঁধে, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম জাগে না, ল্যাবের দরজা খোলে না, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ছুটে আসে না কেউ, মুখর হয় না চত্বর শিক্ষার্থীর পদচারণে। তবে তারও আগে, অতল নীরবতার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসেন কিছু মানুষ—কারো হাতে ঝাড়ু, কারো কোলে ছোট শিশু, কেউ বৈদ্যুতিক তারের জালে চোখ রেখে নিশ্চিত হন : ‘আজকের আলোটা নিরাপদ’। তারা আসেন নিঃশব্দে, চলে যান অচেনার ছায়ায়। অথচ এই ক্যাম্পাস, এই ধূসর টাইলস, এই কাচের জানালা, প্রতিটি সকালের নিরাপত্তা—তাদেরই ঘামে রচিত।

বিজ্ঞাপন

তারা কারা? তারা সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিঃশব্দ নায়িকারা—এই শিক্ষার জগতে মহাকাব্যের অনুল্লিখিত চরিত্র, যাদের গল্প প্রতিদিন রচিত হয় অথচ বলা হয় না।

ইলেক্ট্রিশিয়ান-আমেনা-খাতুন

লিফটম্যান আমেনা খাতুন

২০১৩ সাল থেকে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিফটম্যান হিসেবে কাজ করছেন আমেনা খাতুন। ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজেও সহযোগিতা করেন । কিন্তু তার ভেতরের গল্পটা এক সাহসিকতার মহাকাব্যÑ‘ডা. জাফরুল্লাহ স্যার বলতেন—‘মেয়েরা পারবে না, এই ধারণাটাই ভুল।’ তিনি চাইতেন মেয়ে ইলেকট্রিশিয়ান তৈরি হোক। তার চাওয়া পূর্ণতাও পেল আমার মধ্যে। শুরুতে ভয় লাগতÑকারেন্ট তো জীবনমৃত্যুর খেলা। কিন্তু একসময় বুঝলাম, ভয় না পেলে শেখা হয় না। এখন তো আমার নিজের ছেলেরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, মেয়েটা হাফেজা। ভাবলে অবাক লাগে—একদিন যে আমি তারের খুঁটিতে হাত রাখতাম কাঁপতে কাঁপতে, আজ সেখানেই আমার আত্মবিশ্বাস দাঁড়িয়ে আছে। আমেনার চোখে যে আত্মমর্যাদা ঝলকে ওঠে, তা নিছক একটি চাকরির নয়—তা এক চেতনার, এক প্রজন্মকে আলোর পথে এগিয়ে নেওয়ার কাহিনি।

ডে-কেয়ার সেন্টারের মা ফাহিমা

ডে-কেয়ার সেন্টারে আট বছর ধরে কর্মরত ফাহিমা যেন একটি কোমল চিত্রনাট্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার কণ্ঠে শোনা যায় এক শিক্ষিকা, এক মায়ের, এক স্বপ্নচারী নারীর ছায়াÑ‘কাজে না এলে মন খারাপ হয়। ছোট বাচ্চাদের পড়াই, খেলাই, ঘুম পাড়াই। আমার নিজের ছেলেকেও নিয়ে আসি এখানে। আমার বড় মেয়ে এসএসসি দিচ্ছে এবার। ভোর সাড়ে ৪টায় উঠে রান্না করি, তারপর ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে ক্যাম্পাসে ছুটে আসি। আমি দেখি ওদের আমার নিজের সন্তানের মতো।’ ফাহিমা শুধু কাজ করেন না, প্রতিদিন বুনে যান কোমলতা, শিক্ষার বীজ ও মায়ার জাল।

পরিচ্ছন্নতাকর্মী অমিতন বেগম

অমিতন বেগমের কাহিনি যেন একটি না-পড়া বইয়ের পাতায় জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস। তার হাতে ডাস্টার, চোখে না-পূরণ হওয়া এক দীর্ঘ স্বপ্ন—‘চার বছর বয়সে বিয়ে, তারপর আর পড়া হয়নি। কিন্তু পড়ার ইচ্ছাটা মরে যায়নি। আজও ভাবি, যদি কেউ একটু পড়াত! আমি চাই আমার মেয়েরা যেন আমার মতো না হয়। আমার বড় মেয়েও এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনার। ওকে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছি। আজ গর্ব করে বলতে পারি, আমি পড়তে পারিনি কিন্তু মেয়েকে পড়িয়েছি। আমার মেয়েও এই কাজটাকে ভালোবাসেই করে। আর বলে, ‘মা তুমি চিন্তা করো না, সব কাজই সম্মানের।’ শিক্ষক-ছাত্ররা যে সম্মান দেয়, এটুকুই তো জীবনের বড় পাওয়া।’

পরিচ্ছন্নতাকর্মী মরিয়ম

ছয় বছর ধরে কর্মরত মরিয়মের জীবন বর্ষার সঙ্গে লড়াই আর ভালোবাসার ছায়ায় বেঁচে থাকার গল্প। ‘সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করি। বর্ষাকাল এলেই মনে হয় যুদ্ধ শুরু হয় গিয়েছে। এ সময়টা শুধু ক্যাম্পাসের কথা ভাবি। বেতন পাই, সংসার চলে কোনোমতে। মাঝেমধ্যে বাঁচানো টাকা দিয়ে শার্ট-প্যান্ট বানিয়ে দিই ওনার (স্বামীর) জন্য। আর যদি আমার মন খারাপ হয়, দেরি হয়, তিনি রান্না করে রাখেন। কষ্ট তো আছে, কিন্তু ভালোবাসা দিয়েই টিকে আছি। যারা এখানে পড়তে আসে—তারা আমার সন্তানের মতো। আমি বাসা থেকে বের হই একটাই চিন্তা নিয়ে—ওদের ক্লাস যেন ঝকঝকে থাকে।’

পরিচ্ছন্নতাকর্মী শুকতারা

শুকতারা ক্যাম্পাসের চারপাশে কাজ করেন পাঁচ বছর ধরে। তার হাতে ঝাড়ু, কাঁধে সংসারের ভার, মনে সন্তানের জন্য গড়া স্বপ্নের স্তম্ভ। ‘চাকরিটা যেন চলে না যায়—এই চিন্তায় থাকি সবসময়। কিন্তু কষ্ট একটাই আমাদের খাবার খাওয়ার বা বিশ্রাম নেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো রুম নেই। তীব্র গরমে আমাদের খুবই কষ্ট হয়। সন্তানদের কষ্ট করে পড়াই। মাঝে-মাঝে টাকার সংকট হলেও পড়াতে পিছু হটি না। আমি চাইÑওরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক। সবাই জানুক ক্লিনারের সন্তানও পারে। যেদিন আমার ছেলে ক্যাম্পাসে পা রাখবে আর দেখবে ‘মা’কে শিক্ষকরা সম্মান করছেন, সেদিন আমার বুকটা গর্বে ভরে যাবে।’

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ২১ মৌন কারিগররা, অদৃশ্য আলোর মশালধারী। তাদের হাতে নেই কলম, তাদের নাম নেই ওয়েবসাইটের গৌরবপঞ্জিতে। তারা ক্যাম্পেইন ভিডিওর চমক নয়, কিন্তু প্রতিটি পরিচ্ছন্ন করিডোর, নিরাপদ সকালের পেছনে তারা জেগে থাকেন নীরবে। তারা নেই পাঠ্যপুস্তকে, নেই কনভোকেশনের মঞ্চে, তবু প্রতিটি স্নাতকের ভেতরে বহমান তাদের ঘামের ধারা। তারা প্রমাণ করেন—সম্মান পদের নয়, কাজের। শ্রদ্ধা মুখের নয়, অন্তর থেকে আসে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত