‘ইলিশ রানী’ খ্যাত জান্নাতুলের গল্প

মো. মাসুদ হোসেন
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৪: ৩৮

চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম ও বেড়ে ওঠা জান্নাতুল মাওয়ার। কাজ করেন চাঁদপুরের বিখ্যাত রুপালি ইলিশ ও নদীর সুস্বাদু তাজা মাছ নিয়ে। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া মাওয়া এখন ইলিশ রানী নামেই বেশি পরিচিত। জীবনসংগ্রামে তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।

মাধ্যমিক স্তর না পেরোতেই দাদির আবদারে ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় ২০০০ সালে বিয়ে হয়ে যায় জান্নাতুল মাওয়ার। মুক্ত মনে যে বয়সে ছুটে চলার কথা, সে সময় থেকে তার শুরু হয় জীবনসংগ্রাম। মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে অনুশোচনায় ভুগছিলেন মাওয়ার বাবাও। বিয়ের পর মাওয়ার দাম্পত্য জীবনে আস্তে আস্তে নেমে আসে সংগ্রামের ছাপ।

বিজ্ঞাপন

বিয়ের পর পড়াশোনা ছাড়া নিজের মধ্যে কিছু একটা অপূর্ণতা রয়েছে ভেবেই সাংসারিক কাজের ভেতরেও লেখাপড়া চালিয়ে যান এই নারী। প্রথম সন্তানের পাঁচ বছর বয়সকালে মাওয়া উপজেলার নীলকমল ওসমানীয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন। বর্তমানে বিএ ফাইনাল ইয়ারে অধ্যয়নরত সংগ্রামী এই নারী নিজের অবসর সময়কে কাজে লাগাতে ঘরে বসেই শেখেন হাতের কাজ। এর মধ্যে ২০২১ সালে বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে তিনি সম্পূর্ণ সাহস হারিয়ে ফেলেন । নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আজকের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে বহুদূর—সে কথা ভেবেই মাওয়া সফল গৃহিণী হওয়ার পাশাপাশি সফল উদ্যোক্তার পরিচয় গড়ে তুলেছেন।

প্রবাসী স্বামীর একেবারে দেশে চলে আসার খবরে পুরোপুরি ভেঙে পড়েন মাওয়া। সংসার খরচ আর সন্তানদের ভরণপোষণের কথা চিন্তা করে ‘নিজের বলার মতো একটি গল্প’ নামে একটি ফাউন্ডেশন থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা। স্বামীর অর্থনৈতিক দুরবস্থা আর সামাজিক কুসংস্কারের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজের সন্ধান করতে পারতেন না। তাই মাওয়া সংসার ও স্বামী-সন্তানের সব দায়িত্ব পালন করে নিজের পরিচয়ে বাঁচার লক্ষ্য স্থির করেন। তিনি পুরোপুরি কাজ শুরু করেন চাঁদপুরের বিখ্যাত রুপালি ইলিশ ও নদীর সুস্বাদু তাজা মাছ নিয়ে।

নিজের চেষ্টা আর মেয়ে সাবিকুন নাহারের সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে থাকেন হার না মানা জীবনযোদ্ধা এই নারী উদ্যোক্তা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘Ilish Rani–ইলিশ রানী’ নামে রয়েছে তার একটি ফ্যান পেজ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশ থেকেও এই পেজে অর্ডার আসতে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের। ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে তাকে অনেক সময় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তার এই কষ্ট বিফলে না গিয়ে আর্থিক ও সামাজিকভাবে সফল হয়েছেন তিনি, কুড়িয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা। তার এই সাফল্যে গর্বিত পরিবারসহ এলাকাবাসী।

হাজীগঞ্জ ই-কমার্সের সহযোগিতায় উঠে আসা মাওয়া বলেন, ‘শুধু একজন সফল গৃহিণী ও মা হিসেবে নয়, পাশাপাশি নিজেকে দেখতে চেয়েছি একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। খুব অল্প বয়সেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। সেইসঙ্গে খুব তাড়াতাড়িই প্রথম বেবি কনসিভ করি। অল্প বয়সেই খুব সহজেই সংসারের সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলাম । কিন্তু ঘর সামলানোর পাশাপাশি নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলতে চেয়েছিলাম সবসময়।

যেহেতু ঘর আর ছোট বাচ্চা সামলানোর পাশাপাশি বাইরে গিয়ে কিছু করা আমার পক্ষে তেমন সম্ভব হচ্ছিল না, তাই চিন্তা করি ঘরে বসেই কিছু করার। আমার কাজের প্রথম দিকে অনেকে বিষয়টি ভালো চোখে দেখতেন না, তবে আজ সবাই আনন্দিত। আমি আমার মরহুম বাবাসহ পুরো পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। এছাড়া যারা আমাকে আমার উদ্যোক্তা লাইফে বিভিন্ন পরামর্শ কিংবা সার্বিক সহযোগিতা করেছেন, তাদের ঋণ কখনোই ভোলার মতো নয়।’

জান্নাতুল মাওয়া আরো বলেন, ‘যেহেতু ছোটবেলায় বিয়ে হয়, আর থাকতে হতো শ্বশুরবাড়ি, তাই সংসারের কাজের পাশাপাশি হাতের কাজ শিখি। আর তখন থেকেই শুরু করে দিই নিজে কাজ শেখা ও অন্যদের শেখানো। ধীরে ধীরে এটা ভালো লাগার জায়গা হয়ে যায়। একটা সময় এসে মনে হলো সংসার ও সন্তানদের রেখে তো আমার স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হবে না, কিংবা পাব না কোনো চাকরি। আমার হাসব্যান্ড পরিবারের বড় ছেলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই প্রবাসজীবন পার করল। তাই চেষ্টা করে যাচ্ছি আমার ক্রেতাদের সঠিক সেবা দিতে, আর লোকাল এরিয়ার প্রত্যেকটা ঘাটে গিয়ে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ সংগ্রহ করে পৌঁছানোর জন্য।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত