মুকাদ্দিমা
৩৬ জুলাই কি বর্ষাবিপ্লবের শুরু ছিল, নাকি, যেমন অনেক শাহবাগি বুদ্ধিজীবী বলতেসেন, এইটা ছিল বিদেশি অর্থায়নে পুষ্ট ছাপড়িদের কমান্ডে বস্তি বিদ্রোহের চূড়ান্ত পরিণতি? আর বুদ্ধিজীবী মানেই বাই ডিফল্ট ‘শাহবাগি’ কেন আমাদের মুল্লুকে? কারণ, ‘শাহবাগ = মুক্তিযুদ্ধের চেতনা + বাঙালি জাতীয়তাবাদ’।
আমরা সম্প্রতি দেখসি, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ কীভাবে জুলাইয়ের রাজপথের গেরিলাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করসে। কীভাবে? অনেকভাবেই। প্রাসঙ্গিকটা বলি, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ আওয়ামী প্যারাডাইম ও ‘শাহবাগ’-কে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করসে।
এখন, শাহবাগ আসলে কী? শাহবাগ = মুক্তিযুদ্ধের চেতনা + বাঙালি জাতীয়তাবাদ! এই শাহবাগকে এস্থেটিকাইজ করে কালচারে না আনলে ফ্যাসিবাদ কখনো পোটেন্ট হবে না। এই এস্থেটিক ও কালচারকে গায়ের জোরে পরাজিত করা যায় না। আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা যায় গায়ের জোরে, শাহবাগকে যায় না। শাহবাগকে পরাজিত করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা + বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাল্টা রাজনীতি আর্টিকুলেট করতে হবে; এই রাজনীতিকে এস্থেটিকাইজ করে উন্নত কালচারে পরিণত করতে হবে। হবেই।
‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ হওয়া উচিত ছিল শাহবাগ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা + বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ৩৬ জুলাইয়ের রাজনীতির বজ্র নির্ঘোষ।
পয়লা দফা আমরা একটা পয়েন্টে পরিষ্কার হইÑআওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে অপসারণ ইনসাফের জন্য ছাত্র-জনতার ইনকিলাবের একটি পর্যায়। পরবর্তী পর্যায় হলো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলোপ করা। তারপর বাঙ্গালার ইনকিলাবি জনগণের জজবা জাহেরের তৌফিক আছে এমন একটা সর্বজনীন ইনসাফের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করে যে সংবিধান, সেইটা রেখে যে কোনো সংস্কার বা সংশোধন এই খুনে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে বহাল রাখবে। মানে, খুনে রাষ্ট্রের খুন করা বা লুট করা তাতে বন্ধ হবে না। মানে, যতদিন এই সংবিধান ও রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও বিএনপি ও অন্যান্য দলের লাখ লাখ কর্মীর অন্যায্য মামলার সঠিক সুরাহা হবে না, আমার স্বাধীন দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও অর্থ ব্যবস্থাপনা এবং আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি হয়ে থাকবে ফ্যাসিস্ট। আমাদের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করাও নামুমকিন হয়ে থাকবে। কিন্তু এইগুলো সবই মুট পয়েন্ট, এক অর্থে।
আসল কথা হলো, বাংলাদেশে একটা রেনেসাঁ ঘটতেসিল গত কয়েক বছর ধরে। এই নবজাগরণ, নব উন্মেষের একটা বিস্ফোরণ আমরা দেখসি রাজপথে। শাপলা-শাহবাগের বিভাজনের যে ক্ষত, তার অপূর্ব শুশ্রূষা আমরা দেখসি, মৃত্যুর দামে কিনসে বীর ছাত্র-জনতা। অশ্রুতে, খুনে, মিছিলে, মৃত্যুতে ও শৌর্যে-বীর্যে এই মাটির সন্তানদের ইচ্ছার ইশতেহার ঘোষিত হইসে বজ্র নির্ঘোষে। মনে রাখবেন, ইচ্ছার ইশতেহার শুধু আমাদের না, এই আরমান, এই তামান্না, দুঃখে, ক্ষুধায়, মড়কে ও মৃত্যুতে বিদীর্ণ হয়ে যাওয়া এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে হাজার বছর ধরে হালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চাষার, যার দীর্ঘশ্বাস আমাদের রক্তে উথাল-পাথাল করসে; এই আরমান, এই তামান্না, মজনু শাহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, বাঘাই পীর ও কোটি মুজাহিদের আমানত।
এই ইচ্ছা, এই বাসনা, এই ঘোষণা নূতন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদ। এই ইচ্ছা, এই বাসনা, এই ঘোষণা কীভাবে স্থান পাবে নূতন সংবিধানে? নূতন রাষ্ট্রে? এই বিপ্লবের ফসল কি আমরা ঘরে তুলব, নাকি আবার বর্গি এসে লুটে নেবে আমাদের ইশ্ক-ইজ্জত-আমানত?
এর খুব সহজ, স্বীকৃত ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিতকরণ আছে এই বিপ্লবের ফসল ঘরে তোলার, জনগণের ছতর ছিন্ন করে জাগা তামান্না থেকে নয়া রাষ্ট্র তৈরির, উপনিবেশমুক্ত প্রতিষ্ঠান তৈরির।
২.
আজাদির তামান্নায়, আমরা এই থিসিসকে সমর্পণ করতেসি সেই সকল শহীদের প্রতি যাঁরা ৩৬ জুলাইয়ে নিজেদের রক্ত দিয়ে নূতন বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করসেন।
তাঁদের শাহাদাত শুধু মৃত্যু নয়—এ হইতেসে এক নূতন জীবনের সূচনা, এক নূতন সভ্যতার উন্মেষ।
আবু সাঈদের প্রসারিত হাত আমাদের শিখাইসে যে প্রতিরোধ শুধু শক্তি দিয়ে হয় না, হয় আত্মত্যাগ দিয়ে। মুগ্ধর নিঃশব্দ শাহাদাত, আবরারের অকুতোভয় সাহস, ফারজানার অটুট দৃঢ়তা—এসব শুধু ঘটনা নয়, এসব হলো এক নূতন নাফাক্বাতুল হাইওয়ানের জন্ম, যেখানে প্রাণ ও আত্মা একসূত্রে গাঁথা।
হাক্কুল এবাদ—বান্দার অধিকার—এই দাবি ৩৬ জুলাইয়ের কেন্দ্রীয় বার্তা। আমরা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন চাই না, আমরা চাই এক নৈতিক বিপ্লব, যেখানে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা, প্রতিটি বান্দার ইনসাফ এবং প্রতিটি মজলুমের অধিকার স্বীকৃত হবে। এ শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তন নয়, এ হলো মনের রূপান্তর, চেতনার জাগরণ, সত্তার পুনর্নির্মাণ।
আজমাইশ—এই শব্দটি আমাদের মনে করায় যে, ৩৬ জুলাই শুধু বিজয় নয়, এ হলো এক দীর্ঘ আজমাইশের সূচনা। আমরা কি পারব এই শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে? আমরা কি পারব তাঁদের রক্তের ঋণ শোধ করতে? আমরা কি পারব এই বিপ্লবের প্রকৃত ফসল ঘরে তুলতে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ভর করবে আমাদের নুফুস-এ-জিহাদি: জিহাদি আত্মার ওপর।
জশন (উৎসব) শব্দটি আমরা ব্যবহার করসি, কারণ ৩৬ জুলাই শুধু শোক নয়, এ হলো এক মহাজাগরণের জশন, এক সভ্যতাগত রেনেসাঁ-উৎসব। যেমন কারবালার পরে প্রতি বছর মুহররমে আমরা হুসাইনের শাহাদাত স্মরণ করি শোক ও গর্ব উভয় সঙ্গে নিয়ে, কারণ সেই শাহাদাত ইসলামকে জীবিত রাখসে; তেমনি ৩৬ জুলাই আমাদের জন্য হবে এক বার্ষিক জশন, যেখানে আমরা স্মরণ করব সেই বীরদের, যারা বাঙালি মুসলিম গাইস্টকে পুনর্জাগরিত করসেন।
‘কতলে হুসাইন দর হাকিকত মারগে ইয়াজিদ বুদ,
ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ...’
এই শের আমাদের মনে করায় যে, হুসাইনের হত্যা আসলে ছিল ইয়াজিদের মৃত্যু এবং প্রতিটি কারবালার পর ইসলাম নূতন করে জীবিত হয়। তেমনি ৩৬ জুলাইয়ের প্রতিটি শাহাদাত আসলে ফ্যাসিবাদের মৃত্যু এবং প্রতিটি আবু সাঈদের রক্ত নূতন করে জাগায় বাঙালি মুসলিম গাইস্টকে।
মুমলিকাত-এ-খুদাদাত—খোদাপ্রদত্ত রাজ্য—এই ধারণা আমাদের মনে করায় যে, বাংলাদেশ শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এ হলো খোদার এক আমানত, যা আমাদের দায়িত্ব রক্ষা করা এবং ইনসাফ দিয়ে পূর্ণ করা। এই মাটির প্রতিটি কণা, এই নদীর প্রতিটি বুঁদ, এই আকাশের প্রতিটি তারা সাক্ষী থাকবে—আমরা কি এই আমানত রক্ষা করতে পারলাম?
এই প্রশ্ন আমাদের জাগিয়ে রাখবে; আমাদের সচেতন রাখবে।
কারণ ক্ষমতা শুধু দখল করা নয়, ক্ষমতা হলো দায়িত্ব—হাক্কুল এবাদ আদায়ের দায়িত্ব, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব, জুলমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দায়িত্ব।
ডিকলোনিয়াল ও উপনিবেশোত্তর মাসালা কি ফ্যাসিবাদের একই নিদান নিঃসৃত করে মাহরুফ হয়? এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। উপনিবেশমুক্তি ও উপনিবেশোত্তর তত্ত্ব যদি শুধু পশ্চিমা ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে থেকে কাজ করে, তাহলে তা নূতন ফ্যাসিবাদের জন্ম দিতে পারে। আমাদের দরকার এমন এক তত্ত্ব, যা আমাদের নিজস্ব তুরাছ থেকে উৎসারিত, যা আমাদের নিজস্ব কালিমাতুল হিকমাহ—প্রজ্ঞার বাণী থেকে পুষ্ট। শহীদের খুন ও মিছিলের সিয়াসাত যে ইনকিলাবের এজাহার এলান করল, আমাদের তত্ত্ব সেই বরকতের বারাকাহ বুকে নিয়ে, ক্ষমতার বাসরে বুলন্দ হইতে হবে ও সর্বোপরি বিপ্লবকে সম্পন্ন করতে হবে, নাইলে সকলই গরল ভেল।
ইলিয়াস শাহের ‘শাহ-ই-বাঙালাহ’ থেকে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ—এই হলো আমাদের সিলসিলাহ, যা সবসময় নূতন করে জেগে ওঠে। বালাকোটের শাহাদাত থেকে ৩৬ জুলাইয়ের শাহাদাত, এই হলো আমাদের কৌমের বুকে, নূতন অর্থ নিয়ে ফিরে ফিরে আসা বিলম্বিত আঘাত, যা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এসে নূতন অর্থ পায় এবং ভবিষ্যতের পথ দেখায়।
এই থিসিস সেই পথের একটি মাইলফলক হইতে চায়।
৩.
এই থিসিস একটা দ্বৈত দায়িত্ব পালনের প্রয়াস—যা বর্ষা বিপ্লবের কোনো ঘটনা বা সাধারণ অর্থে ইতিহাসও বর্ণনা করে না, হিস্টোরিওগ্রাফি অন্তর্নিহিত রুহকে উন্মোচিত করে এক নূতন ভাষা, এক নূতন তত্ত্বীয় কাঠামো গড়ে তোলে; বর্ষা বিপ্লবকে তত্ত্বায়ন করে; ইতিহাস রচনার উপযুক্ত দার্শনিক পাটাতন নির্মাণে সচেষ্ট হয়।
এর একমাত্র কারণ সেই জ্ঞানতাত্ত্বিক রূপান্তর, যা কোনো বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করে—যেখানে আমরা ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হই, যেখানে আমরা নিজেদের দেখি অন্যদের চোখ দিয়ে নয়, বরং নিজস্ব গাইস্টের আয়নায়।
এই থিসিস ৩৬ জুলাইকে ধরতে চায় সিভিলাইজেশনাল/সভ্যতাগত উত্থানপর্ব হিসেবে, যেখানে বাঙালি মুসলিম গাইস্ট নিজেকে পুনরাবিষ্কার করসে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কার্যত একটি রেজিমের পরিবর্তন হইলেও যে জ্ঞানতাত্ত্বিক রূপান্তর ছাড়া কোনো বিপ্লব পূর্ণতা লাভ করে না, সেই রূপান্তর এখনো অসম্পূর্ণ।

