জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকানদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ আরো বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় টেক্সাস রাজ্যের রিপাবলিকান গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট গত ১৯ নভেম্বর তার রাজ্যে কথিত ‘শরিয়াহ আদালত’-এর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো প্রমাণ, অভিযোগ বা কোনো আইনি অনিয়মের ভিত্তিতে এই অভিযোগটি করেননি। বরং এটি একটি রাজনৈতিক অভিযোগ। কেননা, টেক্সাসের মুসলমানরা কোনো শরিয়াহ আদালত পরিচালনা করেন না। বরং সেখানে ইহুদি বেথদিন আদালত এবং খ্রিষ্টান সালিশ পরিষেবা যেভাবে কাজ করে, ঠিক একই কাঠামোর অধীনে স্বেচ্ছাসেবী মুসলিম মধ্যস্থতা প্যানেলও কাজ করে।
কিন্তু তারপরও গভর্নর অ্যাবট শরিয়াহ আদালতের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানিয়ে জেলা অ্যাটর্নি এবং শেরিফদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, মুসলমানরা এই রাজ্যে গোপনে প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে একটি বিকল্প আইনি ব্যবস্থা তৈরি করছে। কিন্তু সংবিধানের ধর্মীয় সুরক্ষা রাজ্য এবং ফেডারেল আইনকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো অধিকার ধর্মীয় আদালতগুলোকে দেয় না। তার এই অভিযোগ প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য একটি রাজনৈতিক নাটক ছাড়া আর কিছু নয়।
এই অভিযোগ করার একদিন আগে ১৮ নভেম্বর অ্যাবট একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম মুসলিম নাগরিক অধিকার সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনসকে (কেয়ার) ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এই আদেশে সংগঠনটির বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ, কোনো সহিংসতা, কোনো চক্রান্ত, কোনো প্রসিকিউটরিয়াল রেকর্ড উল্লেখ করা হয়নি। বরং এতে শুধু দাবি করা হয়েছে, আমেরিকান একটি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, কেয়ারকে অভিযুক্ত করার ক্ষমতা অ্যাবটের নেই, এই ক্ষমতা শুধু মার্কিন ফেডারেল সরকারের আছে। ফলে অ্যাবটের আদেশটি আইনগত দিক থেকেও সঠিক ছিল না। এই অকার্যকর আদেশটিতে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে রাজনৈতিক কারণই বেশি ছিল। এর লক্ষ্য ছিল মুসলিম আমেরিকান এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্দেহভাজন হিসেবে এবং তাদের নাগরিক সম্পৃক্ততাকে নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হিসেবে চিত্রিত করা।
অ্যাবটের এই কর্মকাণ্ড আমেরিকান মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য দীর্ঘদিন ধরে চলমান তৎপরতাই অংশ। তার অভিযোগ, এতে সর্বশেষ সংযোজন যা যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মুসলিম জীবনকে আতঙ্ক ও হুমকির সম্মুখীন করবে। এই আতঙ্ক যন্ত্রটি যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দশক ধরে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য শরিয়াহকে বারবার সামনে টেনে আনছেন মার্কিন রাজনীতিকরা, বিশেষ করে রিপাবলিকানরা।
২০০০ সালের শেষের দিকে ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী বিভিন্ন সংগঠন দেশজুড়ে আইনপ্রণেতাদের ‘শরিয়াহবিরোধী’ বিল আইনসভায় উত্থাপনের জন্য চাপ দেয়। ২০১০ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০টিরও বেশি রাজ্য আদালত ‘বিদেশি আইন’ প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়ার আইনটি বিবেচনায় নেয়। এখানে ‘বিদেশি আইন’ বলতে ইসলামি আইনকেই বোঝানো হয়েছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা রাজ্যে, যেখানে ভোটাররা শরিয়াহ এবং আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করে একটি সাংবিধানিক সংশোধনী অনুমোদন করেছেন।
শরিয়াহবিরোধী এসব পদক্ষেপে একটি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে, ইসলাম ধর্মীয় অনুশীলন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি। এর মাধ্যমে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রেই ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী উত্তেজনা বৃদ্ধির পথ তৈরি করা হয়, যার সঙ্গে যুক্ত হলো টেক্সাসে অ্যাবটের কর্মকাণ্ডও।
‘শরিয়াহ আদালত’ নিয়ে তদন্তের আহ্বান জানানোর কয়েক মাস আগে টেক্সাসে মুসলিম নেতৃত্বাধীন একটি রিয়েল এস্টেট প্রকল্পকে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে টার্গেট করা এবং অনলাইনে ‘শরিয়াহ উপনিবেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। স্থানীয় জনগণকে এ কথা বলে উত্তেজিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল, ইসলামি আইন এলাকা পরিচালনা করবে, অমুসলিমদের বাদ দেওয়া হবে এবং এগুলো মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের অংশ। কিন্তু এগুলো ছিল পুরোপুরিই গুজব এবং এর কোনোই সত্যতা ছিল না। কারণ এই প্রকল্পটি ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত এবং শুধু সেখানের আবাসন সংকট মোকাবিলা করার জন্যই এটি করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও বিচার বিভাগ অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। তদন্ত শেষে অভিযোগের কোনো সত্যতা না পাওয়ায় বিচার বিভাগ গত জুন মাসে তার তদন্ত শেষ করে।
কিন্তু এরপরও গত সেপ্টেম্বরে গভর্নর অ্যাবট টেক্সাসে শরিয়াহর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনা নিষিদ্ধ করার একটি আইনে স্বাক্ষর করেন। এ ধরনের তৎপরতা টেক্সাসের বাইরেও অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। টেনেসি রাজ্যের মারফ্রিসবোরোতে একটি মসজিদের বিরোধীরা দাবি করেছিলেন, ইসলাম কোনো ধর্ম নয়, তাই মুসলমানরা প্রথম সংশোধনীর সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য নন। এর মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম ধর্মীয় জীবনকে আইনগতভাবে অবৈধ করে তোলা।
যুক্তরাষ্ট্রের আরব এবং মুসলিম সম্প্রদায় অধ্যুষিত পুরোনো নগরী মিশিগানের ডিয়ারবর্নে ভাইরাল গুজবগুলোয় বারবার দাবি করা হয়েছে, শহরটি ‘শরিয়াহ আইন দ্বারা দখল করা হয়েছে’। যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামি শাসন নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্যই এসব বানোয়াট ভিডিও, কারসাজি করা শিরোনাম এবং অন্যান্য দেশের ছবি প্রচার করা হয়েছে। তবে তথ্য যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব অপপ্রচারকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। কিন্তু তারপরও ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে গুজবের কমতি নেই, এ ধরনের গুজব টিকে আছে।
আমেরিকান মুসলিমদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদেরও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। এখানে নিই ইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির কথা উল্লেখ করা যায়। তার নির্বাচনি প্রচারণার সময় তিনি বর্ণবাদী আক্রমণ এবং নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মুখোমুখি হয়েছিলেন। দাবি করা হয়েছিল, তিনি নির্বাচিত হলে ‘শরিয়াহ শাসন’ চালু করার ষড়যন্ত্র করছেন। মামদানির কোনো নীতি বা প্রস্তাবেই কোনো ধর্মীয় বিষয়বস্তু নেই। তার এজেন্ডা গণপরিবহন, আবাসন এবং পুলিশের জবাবদিহির ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু যারা শরিয়াহ আতঙ্কে ভুগছেন, তারা সরকারি পদে থাকা একজন মুসলিমকে সবসময়ই বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালান। শুধু রিপাবলিকানরাই যে ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী এই আগুনে ঘি ঢালছেন, তা নয়। দেশটির প্রধান প্রধান সংবাদপত্র, উদার রাজনীতিবিদ এবং এমনকি নাগরিক স্বাধীনতার পক্ষে গলা ফাটানো প্রতিষ্ঠানগুলোও এতে যুক্ত রয়েছে।
এসব ঘটনা একটি নির্দিষ্ট ধরন প্রকাশ করে আর তা হচ্ছে শরিয়াহকে ঘিরে আতঙ্ক সৃষ্টি, এর বিরুদ্ধে আইন তৈরি করা। কাকে আমেরিকান হিসেবে দেখা হবে এবং কে স্থায়ীভাবে সন্দেহভাজন থাকবেন, তার ভিত্তি তৈরি করার জন্যই এসব অপচেষ্টা চালানো হয়। এসব অপপ্রচার মুসলমানদের নাগরিক অধিকারের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি চালানোর ন্যায্যতা বা বৈধতা প্রমাণ করার জন্য একটি হাতিয়ার।
আরবি ভাষায় শরিয়াহ মানে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পুষ্টির লাভের পথ। এটি ন্যায়বিচার, কল্যাণ এবং জবাবদিহির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিস্তৃত নৈতিক কাঠামো। এর মূল লক্ষ্যগুলো জীবন, বুদ্ধি, বিশ্বাস, সম্পত্তি এবং মানবিক মর্যাদা রক্ষা করার চারপাশে আবর্তিত হয়। এই ঐতিহ্যে ন্যায়বিচার (ইস্তিহসান), জনস্বার্থ (মাসলাহ) এবং প্রথার পরিশীলিত মতবাদ রয়েছে, যা আধুনিক সাধারণ আইনব্যবস্থার ন্যায়সংগত এবং প্রাসঙ্গিক হাতিয়ারের মতো কাজ করে।
শরিয়াহ কোনো বিদেশি আইন নয়, বরং এটি পশ্চিমা আইনগত ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীর কাঠামোগত অনুরণন ভাগ করে নেয়। অধ্যাপক জন মাকডিসি নর্থ ক্যারোলিনা ল রিভিউতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, ইংরেজি সাধারণ আইনের বেশ কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য ইসলামি আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তার এই বক্তব্য প্রমাণ করে, ইসলামি আইন পশ্চিমা শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়—এই অভিযোগ পুরোপুরিই ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর :
মোতালেব জামালী


বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন বনাম ঐক্য
১৮ বছরেও চালু হয়নি স্যালাইন কারখানা