জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন কাভার করার সুযোগ পাওয়া যে কোনো সাংবাদিকের জন্য অত্যন্ত মর্যাদা ও গৌরবের। মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টাররা এমন একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট কাভার করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জীবন পার করে দেন। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। অবশেষে চলতি ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে আমি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশন কভার করার সুযোগ পাই।
নানা কারণে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এতে সংস্থাটির ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের ১৪০ জনেরও বেশি রাষ্ট্রনেতা অংশ নিয়ে নিজ নিজ দেশের অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। এবারের অধিবেশনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—‘একসঙ্গে ভালো : শান্তি, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের পথে ৮০ বছর ও আরো বেশি।’
এবারের অধিবেশনের প্রতিটি সেশন ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা, মানবাধিকার রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বনেতারা এ অধিবেশনে মিলিত হন। বিভিন্ন দেশের নেতারা তাদের বক্তব্যে বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দ্বার উন্মোচনের আহ্বান জানান। বিশেষ করে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশে দেশে বিরাজমান বিরোধ ও যুদ্ধ বন্ধ, খাদ্য ও জ্বালানি সংকট বা পারস্পরিক সংঘাতের মতো জরুরি বিষয়গুলো মোকাবিলা করার জন্য কৌশল নির্ধারণের পরামর্শও দেন। প্রতিটি সেশনে জলবায়ু পরিবর্তন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবার।
জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনে বড় ধরনের চমক দেখিয়েছে বাংলাদেশ, যা পুরো অধিবেশনকে মাতোয়ারা করে তোলে। প্রচলিত রীতি বা রেওয়াজ অনুযায়ী প্রতিটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সে দেশের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকেও এর আগে যত সরকারপ্রধান অংশ নিয়েছেন, একই রীতি অনুসরণ করেছেন। তবে এবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে তিনটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন শীর্ষস্থানীয় নেতাও অংশ নেন। গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট ও সাইড মিটিংগুলোতেও তাদের উপস্থিতি বিশ্বের অন্য দেশের সরকারপ্রধানরা উপভোগ করেন।
নিউইয়র্কের মাঠে ‘বাংলাদেশের রাজনীতি’
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেন ২৩ সেপ্টেম্বর। এর চারদিন আগে ১৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে গিয়ে জ্যাকসন হাইটসের এলমার্স্ট এলাকায় বড় ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে থিতু হই। জ্যাকসন হাইটস নিউইয়র্কের বাঙালিপাড়া হিসেবে পরিচিত। এখানকার দোকানগুলোর ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। সংস্কৃতি, পরিবেশ-প্রকৃতি, চলন-বলন, ঝগড়া-বিবাধ, ভিলেজ-পলিটিক্স বা রাজনীতি নিয়ে তর্কাতর্কি ও এটা-সেটা নিয়ে ঝামেলা তৈরি এবং বিচার-আচারের মাধ্যমে মিটমাট করাÑ সবকিছুতেই ‘বাংলাদেশি সিস্টেম’।
জ্যাকসন হাইটসের অলিগলিগুলোও যেন বাংলাদেশের কথা বলে। ঢাকার ফুটপাতের মতো সেখানেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা টুকরিতে করে নিজের উৎপাদিত নানান জাতের শাক-সবজি ও ঘরে তৈরি পিঠা-পায়েস কিংবা হাতে তৈরি তৈজসপত্র নিয়ে টুকরি বা ছোট টেবিলে পসরা সাজিয়ে বসেন। বাঙালি ক্রেতারা সেটা বেশ আনন্দের সঙ্গেই কিনে দেশের মাটি ও মানুষের স্মৃতি রোমন্থন করেন। এমন দৃশ্য সেখানকার নিয়মিত ঘটনা।
গ্রাম-বাংলার হাট-বাজারের মতোই জ্যাকসন হাইটস এলাকার অলিগলিতে ছোট ছোট চা-কফির দোকান, টংঘর ও বিরিয়ানির দোকানও রয়েছে অনেক। সামনের পাতানো বেঞ্চে বসে গরম চা-কফিতে চুমুকের সঙ্গে আড্ডার পাশাপাশি রাজনীতির কঠিন হিসাব-নিকাশও চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সেখানে দেখা হলো, সঙ্গ পেলাম সাংবাদিকদের পরিচিত মুখ ড. কনক সারোয়ার ও ইলিয়াস হোসেনসহ বেশ কয়েকজন সাবেক সহকর্মীর। কখনো সখনো আমাদের মধ্যে শেখ হাসিনার সেই উক্তিÑ‘সাত সমুদ্দর আর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় আমি যামু না’ আলোচ্য বিষয় হয়েছে।
শেখ হাসিনার হুংকার ও আলোচনার শীর্ষে আমার দেশ
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর ও প্রদেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের শাখা রয়েছে। জাতীয় নেতারাও নিজ নিজ দলের ওইসব শাখার নেতাদের বেশ গুরুত্ব দেন। অবশ্য এর পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণও রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যখনই কোনো সরকারপ্রধান যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান, তখন তাদের পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল, সমাবেশ ও নানা ধরনের অনুষ্ঠানাদি একটি রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে। এ পেশায় আসার পর থেকেই এগুলো দেখে আসছি। তবে এবারের ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী।
প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের স্বাগত জানাতে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলের যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতারা ব্যাপক আয়োজন করেন। পাশাপাশি তাদের কালো পতাকা প্রদর্শন করে সফরের প্রতিবাদ জানাতেও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাও বড়সড় প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তবে, দুটি আয়োজনের মাত্রায় কিছুটা তফাৎ ছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ তদারকি করেন স্বয়ং শেখ হাসিনা, যিনি ক্ষমতা হারিয়ে এখন ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন। সেখান থেকেই তিনি প্রতিনিয়ত দলটির যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে ‘ইউনূস হটাও’ কর্মসূচি সফল করার নির্দেশনা দেন। সঙ্গে ছিলেন শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, যিনি মাত্র কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সফরসঙ্গী রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে পলাতক শেখ হাসিনা যেসব পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল বৈঠকে অংশ নিয়ে শেয়ার করেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ, ভারত ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকে ভাড়া করা মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থা এনে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে জড়ো করা, পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রচার করাÑএমন কিছু সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের দেন। দুই দিনের বৈঠকের এমন আটটি অডিও ক্লিপ আমার হাতে এসে পৌঁছে। যথাযথ পক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই ও সংবাদ তৈরির সব রীতিনীতি অনুস্মরণ করে তা নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় বার্তা সম্পাদকের বরাবরে পাঠাই।
২৬ সেপ্টেম্বর আমার দেশ ‘আ.লীগ নেতাকর্মীদের হাসিনার নির্দেশ: নিউ ইয়র্ক থেকে কেউ যেন অক্ষত ফিরতে না পারে’ শিরোনামে লিড নিউজটি প্রকাশ করে। সংবাদের একটি অংশ ছিল এমনÑ ‘স্থানীয় সময় আজ শুক্রবার দুপুর ১টায় জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। ওই সময় তার সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতারাও উপস্থিত থাকবেন। বর্তমানে তারা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সন্নিকটে হোটেল আল হায়াতে অবস্থান করছেন।
এদিন জাতিসংঘের সামনে ব্যাপক উপস্থিতি ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ। তাদের সঙ্গে রয়েছে জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া দলের নেতাকর্মীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত তিন দিন ধরে নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন এলাকায় কমপক্ষে আটটি ঘরোয়া বৈঠক করে এসব বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
নিউ ইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল কার্যালয়ের কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এ সভায় অংশ নেওয়া কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি আমার দেশকে জানান, প্রতিটি সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন ভারতে পালিয়ে থাকা হাসিনা ও তার ছেলে মার্কিন নাগরিক সজীব ওয়াজেদ জয়। একটি সভায় হাসিনা প্রধান উপদেষ্টাসহ তার সফরসঙ্গী রাজনীতিকদের আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ওরা কেউ যাতে অক্ষত যেতে না পারে; তোমরা সব ব্যবস্থা করবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা গেছে, এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্র শাখা আওয়ামী লীগ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের মাধ্যমে অর্থের জোগান দিচ্ছেন জয়। জয় কিছুদিন আগে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন।
জেকসন হাইটস এলাকায় দুদিন আগে হওয়া একটি সভায় উপস্থিত থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক কর্মী আমার দেশকে জানান, বৈঠক শুরুর কিছু সময় পর যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ভিডিও কল করেন শেখ হাসিনার কাছে। বিমানবন্দরে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের সফলভাবে হেনস্তা করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ দেন তিনি। সামনের কর্মসূচিগুলোও তিনি ওইদিনের মতোই সফল করতে বলেন। এ সময় হাসিনা বলেন, কোনোভাবেই কেউ যাতে অক্ষত ফিরতে না পারে, সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের ওই কর্মী আরো জানান, সভাটিতে সিদ্দিকুর রহমানের স্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আপত্তি করে তিনি বলেন, আইন ভাঙা যাবে না। আইনের ভেতরে থেকেই সর্বোচ্চটা করতে হবে। এ পর্যায়ে শেখ হাসিনা চিৎকার ও চেঁচামেচি করে ওঠেন। তিনি বলেন, ওদের (অন্তর্বর্তী সরকার) জন্য আবার দরদ কিসের? ওরা আইন দেখে আমাদের মারছে নাকি? ওরা তো আমাদের কিছুই আর বাকি রাখেনি। ওদের একটাকেও আমি ছাড়ব না। ওই সময় শেখ হাসিনার বক্তব্য ও আচরণ অসংলগ্ন ছিল।’
বাংলাদেশে যখন দুপুর যুক্তরাষ্ট্রে তখন গভীর রাত। রাত-দিনের এ ব্যবধান আমাকে অনেক ভুগিয়েছে। তবে, এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আমার দেশ’র এক পাঠক ফোন করে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে রিপোর্টটির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয়Ñআপনি আপনার পেশাগত জীবনের সেরা রিপোর্টটি করে ফেলেছেন। আমরা প্রত্যাশা করবো প্রধান উপদেষ্টাসহ রাজনৈতিকগুলোর শীর্ষ নেতারা অক্ষত অবস্থায় সম্মান নিয়ে নিরাপদে দেশে আসবেন।’ যে কোনো ভালো রিপোর্টের জন্য একজন রিপোর্টার ধন্যবাদ পেলে সেটাই তার জন্য স্বীকৃতি। পেশাগত জীবনে এমন অনেক রিপোর্টের জন্যই অনেকের প্রশংসা ও ধন্যবাদ পেয়েছি। সেদিনের রিপোর্টটির জন্য বহুজনের কাছ থেকে যে ‘রেসপন্স’ পেয়েছিÑ এটি আমার জীবনের এক অনন্য পাওয়া। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ইউটিউব চ্যানেল রিপোর্টটি পর্যালোচনা করেছে। এর ফটোকার্ড বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতারাসহ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকরাও রিপোর্টটির জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
রিপোর্টে যে ধরনের সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার নির্দেশ শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন তার সবই আওয়ামী লীগ ঘটানোর চেষ্টা করেছে। বিমানবন্দরে ডিম নিক্ষেপ থেকে শুরু করে অনেক ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি ও সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে নিজেদের প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে নেয়। ২৬ সেপ্টেম্বর সকালেই তারা জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশের স্থানটিতে বিপুল লোকসমাগম ঘটিয়ে তা দখলে নেয়। সকাল ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের এক রাজ্য সভাপতি সমাবেশটি নিজেদের মনে করে সেখানে ঢুকে পড়েন। কোট ও টাই পরা ওই নেতাকে বিএনপির কর্মীরা চিনতে পেরে বেশ নাজেহাল করেন। একজন নেতা তার টাই ধরে টান দিলে গলায় ফাঁস লেগে যায়। এ অবস্থা দেখে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্ত্রী ও কয়েকজন পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যায়। এ ঘটনাটি প্রচার হলে নিঝুম মজুমদারসহ অন্যান্য দেশ থেকে আসা আওয়ামী লীগের নেতারা আর প্রতিবাদ জানাতে আসেননি।

এমন ঘটনায় বাংলাদেশ কমিউনিটি লজ্জিত কি না? এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে। তারা সে দেশের সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করছেন। তাদের সবার বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমরা এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকি। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সময় প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আমরা শুধু লজ্জিতই নই, মর্মাহতও বটে। জাতি হিসেবে আমরা বাংলাদেশিরা কতটা অসভ্য, এ ঘটনাগুলোই তার নিকৃষ্ট প্রমাণ।’
বাংলাদেশিসহ অন্য দেশের বহু নাগরিকও তো যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তারা এমন আন্দোলন বা বিক্ষোভ করছেন না কেন? এমন প্রশ্নও ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন শিক্ষকের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, অন্য দেশের যেসব নাগরিক এখানে বসবাস করেন, তাদের এত অলস সময় নেই। প্রত্যেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাজ করেন। তারা নিজ দেশকে ব্র্যান্ডিং করেন। পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, নিউইয়র্কে এখন ১৯০টির বেশি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান কিংবা তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত আছেন। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশের নাগরিকদের পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন বা সভা-সমাবেশ কি আপনি দেখেছেন? অবশ্যই দেখেননি। কারণ, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এ শহরে যত আইন ভঙ্গের কাজ হয়, তার অধিকাংশই করেন আমাদের দেশের নাগরিকরা। তারা দেশেও আইন মানেন না, বিশ্বের যেখানেই যান সেখানেও আইন মানতে অভ্যস্ত নন। এ ঘটনা যে শুধু এ বছর হয়েছে, তা নয়। আমি গত ২৫ বছর ধরেই এ ঘটনা দেখে আসছি। জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল ও বিক্ষোভ এখন একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ জাতিসংঘের সম্মেলন উপলক্ষে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পরিবেশবিদ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো গোটা বিশ্বের কথা চিন্তা করে এখানে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে জড়ো হন। তারা বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গোটা বিশ্বের সমস্যা নিয়ে।
সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বনেতাদের নজর কাড়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন সুবক্তাও। প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আগেও তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে টানা বক্তব্য দিয়ে রেকর্ড গড়েছেন। তিনি মঞ্চে উঠলে বিপুল করতালি দিয়ে পুরো অনুষ্ঠানস্থল মাতোয়ারা করে তোলেন শ্রোতারা।
প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দেবেন বেলা ১১টায়। আমরা সেদিন সকাল ৯টার আগেই সদর দপ্তরের সামনে গিয়ে পৌঁছি। বাংলাদেশের সেশনের আগে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর বক্তব্যের পালা ছিল। ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা চালানো নেতানিয়াহুর অধিবেশন বাংলাদেশ বয়কট করে সদর দপ্তরেই ঢুকেনি। শুধু বাংলাদেশই নয়, ওই সময় যারাই সদর দপ্তরের ভেতরে ছিলেন তারা সবাই নেতানিয়াহুকে মানবতার শত্রু, গণহত্যাকারী ও রক্তপিপাসু হিসেবে আখ্যা দিয়ে অধিবেশন থেকে বেরিয়ে যান। নেতানিয়াহু যখন বক্তব্য দেন পুরো অডিয়েন্স ছিল প্রায় শূন্য। সদর দপ্তরের বাইরে মিডিয়া সেন্টারের বিশাল টিভি স্ক্রিনে এ দৃশ্য দেখেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামিদামি গণমাধ্যমের শত শত সাংবাদিক। একজন গণহত্যাকারীর প্রতি মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভের গভীরতা কতটুকু, তা ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হলে আমারও অজানা থেকে যেত।
নেতানিয়াহু বক্তব্য দিয়ে সদর দপ্তরের অধিবেশনস্থল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বিশ্বনেতা ও তাদের প্রতিনিধিরা আবার সেখানে প্রবেশ করেন। এর কিছুক্ষণ পর সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে অধিবেশনস্থলে প্রবেশ করেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
অধিবেশনের সভাপতি ভাষণ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে তুমুল করতালির শব্দ শোনা যায়। তিনি প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বক্তব্য দেন। পুরো সময় জুড়ে সেখানে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। কিছু সময় পর পর অধিবেশনে অংশগ্রহণকারীরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তাকে অভিবাদন ও সমর্থন জানান।
সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বাংলাদেশের গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে সরকার প্রস্তুত রয়েছে। জনগণ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে এ আশ্বাস ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার অঙ্গীকার। প্রধান উপদেষ্টার সফরে বাংলাদেশের তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এটিই প্রথমবার, যেখানে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা একসঙ্গে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফরে গেলেন। তারা কূটনীতিক, প্রবাসী নেতৃবৃন্দ এবং ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। এ উদ্যোগ বিশ্বকে বার্তা দিয়েছে যে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগোচ্ছে।
লেখক: বিশেষ সংবাদদাতা, আমার দেশ
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

