বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার কিংবা রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করার যে প্রত্যাশা জনগণ বহু বছর ধরে বুকে লালন করে এসেছে, তার সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপ অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী । এরা সেসব ব্যক্তি ও শক্তি, যারা বিদ্যমান ব্যবস্থার ভেতরেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং যে কোনো পরিবর্তনকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে। ফলে নতুন ব্যবস্থা, নতুন নেতৃত্ব বা নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় এই গোষ্ঠীই বারবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু আন্দোলন, বিপ্লব, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই যখনই পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে—রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীর স্তরে প্রোথিত এই কায়েমি স্বার্থের বলয় টিকে গেছে। সে কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলালেও, প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী কাঠামোর ভেতরকার শক্তির ভারসাম্য খুব কমই পরিবর্তিত হয়েছে। এতে গণতন্ত্র বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, রাষ্ট্র হয়েছে দুর্বল।
কে এই কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী?
এদের আলাদা কোনো পরিচয়পত্র নেই, কোনো একক দপ্তর নেই। কিন্তু এদের শিকড় অত্যন্ত সুগভীর এবং বহুমাত্রিক। বিচার বিভাগের কিছু অংশ, ব্যবসায়ী-সাহেব শ্রেণির একটি শক্তিশালী অংশ, রাজনীতির ভেতরের সুবিধাভোগী উপদল, বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী—ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, মিডিয়া মালিক, বুদ্ধিজীবী শ্রেণির প্রভাবশালী অংশ এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী শক্তির সঙ্গে যুক্ত নেটওয়ার্ক I সবাই মিলে এই গোষ্ঠী রাষ্ট্রের ওপর এমন একটি অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে, যা ভাঙা সাধারণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব হয় না।
এরা রাষ্ট্রের মূল কাঠামোর ওপর এক ধরনের ‘এলিট সেটেলমেন্ট’ বা এলিট সমঝোতার শৃঙ্খল চাপিয়ে রাখে। এই শৃঙ্খল ভাঙতে না পারলে গণতন্ত্র কখনোই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না।
গণমাধ্যম—যেখানে পরিবর্তন শুরু হওয়ার কথা ছিল
একটি দেশের গণমাধ্যম হওয়া উচিত জাতির বিবেক, জনগণের কণ্ঠ, সত্য-অনুসন্ধানের সাহসী মঞ্চ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—গণমাধ্যমের বড় একটি অংশও এই ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। এর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের ওপর কায়েমি স্বার্থের ছায়া দীর্ঘদিন ধরেই প্রবল।
গণমাধ্যমকে জাগ্রত করার প্রথম শর্ত হলো—এই কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তিকে প্রভাবমুক্ত করা। কারণ—যারা মালিক, তাদের অনেকেরই ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে জড়িত থাকে। সম্পাদকদের অনেকে ক্ষমতার সঙ্গে আপসকামী হয়ে পড়েন। বিজ্ঞাপননির্ভরতা গণমাধ্যমকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রিত করে রাখে। অনেক সাংবাদিকও বিভিন্ন ক্ষমতাশালী স্বার্থগোষ্ঠীর ছত্রচ্ছায়ায় থাকে। ফলে জনমতের জায়গায় গণমাধ্যম অনেক সময় মালিক পক্ষের করপোরেট স্বার্থ বা এলিট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সেটেলমেন্টের ভাষ্য প্রচার করে।
জুলাই বিপ্লবের পরেও কেন তাদের শক্তি অটুট রইল
জুলাই বিপ্লব ছিল সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ—এক ধরনের গণজাগরণ। এই বিপ্লব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোকে ঝাঁকুনি দিলেও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এর তিনটি মূল কারণ—
১. রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরীণ স্তর তাদের দখলে ছিল : মন্ত্রিসভা বদলানো বা নেতৃত্ব পরিবর্তন করা সহজ; কিন্তু সচিব, কমিশন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, পরামর্শদাতা মহল, বিচার ব্যবস্থা—এসব জায়গায় তারা বহু বছর ধরে নিজেদের লোক বসিয়ে রেখেছে।
২. নতুন সরকার অভিজ্ঞতার অভাবে তাদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছে : জুলাইয়ের পর যে সরকার এসেছে, তাদের অভিজ্ঞ আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। আর এই আমলাতন্ত্রের বড় অংশই ছিল ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপের প্রভাবাধীন। ফলে তারা নতুন ব্যবস্থার ভেতরেও নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।
৩. বিদেশি স্বার্থের সঙ্গে তাদের দীর্ঘমেয়াদি নেটওয়ার্ক : অনেক আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে কিছু আঞ্চলিক শক্তি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখে। এতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের প্রভাব আরো বাড়ে।
কেন গণমাধ্যমকে জাগাতে হলে প্রথমে এই গোষ্ঠীকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে?
গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যম হলো অক্সিজেন। গণমাধ্যম স্বাধীন না হলে সত্য চাপা পড়ে, দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়, রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা কমে যায়, ক্ষমতা অপব্যবহার প্রবল হয়, জনগণের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়।
অন্যদিকে ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপ সবসময় গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করতে চায়, কারণ—তারা সত্যকে ভয় পায়, পরিবর্তনকে ভয় পায়, জনগণের শক্তিকে ভয় পায়। তাই গণমাধ্যমকে মুক্ত করতে হলে প্রথমেই এই গোষ্ঠীর দখলদারিত্ব ভাঙতে হবে। এটি না হলে গণমাধ্যম কখনোই জনগণের মুখপাত্র হতে পারবে না।
গণতন্ত্র শুধু একটি রাজনৈতিক কাঠামো নয়; এটি সত্য, ন্যায়, মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার ওপর দাঁড়ানো একটি জীবন্ত ব্যবস্থা। তবে গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই পথটি খুব মসৃণ নয়। সব বাধা দূর করে সঠিক পথে চালিত করার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো গণমাধ্যম। কারণ এই গণমাধ্যম মানুষের কণ্ঠ তুলে ধরে, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে, দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচন করে, রাষ্ট্রের অপকর্ম জনগণের সামনে তুলে ধরে, এবং গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিত্যদিন লড়াই করে, রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের পথ বাতলে দেয়।
যদি গণমাধ্যম নতজানু হয়, ভয় পায় বা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে—তাহলে গণতন্ত্রের মৃত্যু সময়ের ব্যাপার মাত্র। আজ বাংলাদেশ সেই রাস্তায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
আমরা কীভাবে এখানে এলাম? গণমাধ্যম কেন নীরব? এবং কী করলে আবার জাগ্রত হবে সত্য—এই প্রশ্নগুলো আজ জাতির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ এই অবস্থা থেকে ফিরতে হলে আমাদের নির্মোহভাবে এই ব্যর্থতার পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হবে অর্থাৎ রুট কজ এনালাইসিস করতে হবে। কিছু নির্মোহ সত্য উচ্চারণের হিম্মত দেখাতে হবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ যে মোড়ে দাঁড়িয়ে—এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই রাজনীতি বনাম রাজনীতি নয়; বরং জনগণ বনাম কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। বাংলাদেশকে একটি নতুন বাস্তবতার দিকে এগোতে হলে এই অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী বলয় ভেঙে ফেলাই হবে প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গণমাধ্যম যখন সত্যিকার অর্থে জাগবে, তখনই গণতন্ত্র তার শক্তিশালী ভিত্তি খুঁজে পাবে।
এই ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপের শিকড় যতক্ষণ না ভাঙা যাবে— গণমাধ্যম স্বাধীন হবে না, প্রশাসন জনগণের সেবা দিতে পারবে না, রাজনৈতিক পরিবর্তন স্থায়ী হবে না, রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে না, এবং গণতন্ত্র কখনোই পূর্ণ বিকাশ লাভ করবে না। কায়েমি স্বার্থবাদী গ্রুপের অন্তর্নিহিত এই প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও দুটি বড় ভূমিকম্প আমাদের গণমাধ্যমকে ধাক্কা দিয়েছে।
বাকশাল : গণমাধ্যম দমনের প্রথম কামড়
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ রূপে রুদ্ধ করা হয়। সেদিন—চারটি পত্রিকা ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক নেতার এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রেডিও-টিভিতে এরকম একদলীয় প্রচারণা শুরু হয়। সমালোচনামূলক প্রতিবেদন নিষিদ্ধ করা হয়। জনগণের মত প্রকাশকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে দেখা হয়, এই পদক্ষেপ ছিল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ। গণমাধ্যম যখন নিঃশব্দ হয়ে পড়ে, তখন শাসক যেমন ইচ্ছা তেমন তথ্য তৈরি করতে পারে—এই সত্য সেদিনই প্রমাণিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় বাকশাল—যখন সত্য কারো রক্ষাকবজ ছিল না
প্রথম অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আরেকটু পরিশীলিত কৌশলে অগ্রসর হয়েছে। শুরুতেই নানা অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হলো দিগন্ত টিভি, ইসলামি টিভি ও চ্যানেল আই । দৈনিক আমার দেশ বন্ধের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো যুক্তি দাঁড় করানোর প্রয়োজন মনে করা হয়নি। এর সম্পাদককে কারাবন্দি করে আদালত থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো— ‘Truth is no defense’ আদালতের কাঠগড়া থেকে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ‘বাই-চান্স সম্পাদক’ ডেকে দাঁতাল হাসি দিয়ে অপমান করা হলো, যেন বিচারব্যবস্থাকেই রাষ্ট্রশক্তির ব্যঙ্গাত্মক হাতিয়ার বানানো হয়েছে।
যখন সম্পাদক শফিক রেহমান ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তথাকথিত ‘জয়কে হত্যা পরিকল্পনা’র মামলায় গ্রেপ্তার করা হলো, তখন সম্পাদক পরিষদ নামের সেই তথাকথিত অভিজাত সংগঠনটি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তো নিলই না, বরং এমন নীরবতা পালন করল যা তাদের প্রকৃত চরিত্রকে স্পষ্ট করে দেয়।
ফলে সাংবাদিক সমাজ ভয় ও দমনের চাপে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল— দুর্বলচিত্তরা নীরবতায় আশ্রয় নিল, আর সুযোগ সন্ধানীরা সরাসরি ক্ষমতার দালালি শুরু করল। এরই ধারাবাহিকতায় শত শত গণমাধ্যম ক্রমে স্বেচ্ছায় পরিণত হলো সরকারের প্রচারযন্ত্রে। সংবাদপত্রের পাতায় জনস্বার্থের বদলে স্থান পেল ক্ষমতার ভাষ্য, প্রশ্নহীন সমর্থন, আর আলোকচিত্রে কেবল একদলীয় শাসনের সাজানো চিত্র।
এভাবে দ্বিতীয় বাকশালের অবকাঠামো তৈরি হলো—ভয়, দমন, নীরবতা ও দালালিতে তৈরিকৃত এক বিকৃত গণমাধ্যম পরিবেশ, যেখানে সত্য প্রকাশ অপরাধ আর স্বাধীন সাংবাদিকতা রাষ্ট্রশক্তির সবচেয়ে বড় শত্রু।
বাজারে রঙ-বেরঙের ডজন ডজন পত্রিকা এসেছে, কাগজের পাহাড় যেন প্রতিদিনই নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়—কিন্তু সত্যের কণ্ঠটি নিভে গেছে। গণমাধ্যম মালিকরা নিজেদের ব্যবসা বাঁচাতে সত্যের বদলে ক্ষমতার আনুকূল্যকেই বেছে নেন। সাংবাদিকরা জানেন—একটি সমালোচনামূলক বাক্য মানেই চাকরি হারানোর ঝুঁকি। ফলে কলমের ডগায় জমে থাকা সাহসটুকুও নীরব হয়ে যায়।
টিভি টকশোগুলো যেন সরকার-অনুমোদিত স্ক্রিপ্টে পরিচালিত নাটক। কোন অতিথি বসবেন, কোন আলোচনায় কারা কী বলবেন—সবই নির্ধারিত। যেসব মুখ টিভিতে সরকারের বিরুদ্ধে কড়া কথা বলতেন, তাদের অনেকেই ছিলেন সাজানো বক্সিং ম্যাচের কৃত্রিম বক্সারের মতো। দর্শক ভাবতেন—‘সরকারের নাক বুঝি ফাটিয়ে দিল!’ অথচ বাস্তবে এসব ছিল সরকারের সঙ্গে সূক্ষ্ম বোঝাপড়ারই অংশ।
যেমন সংসদে ছিল ক্ষমতার পোষ মানানো বিরোধীদল, ঠিক তেমনি টিভি স্টুডিওতেও তৈরি করা হয়েছিল কিছু ‘গৃহপালিত সমালোচক’। তাদের কাজ ছিল শুধু শব্দের আতশবাজি ছোড়া—ফলহীন, ঝুঁকিহীন, ক্ষমতাসেবী। গৃহপালিত সেই সব সমালোচকদের কেউ কেউ নতুন করে হিরো সেজেছেন! বয়স খুব বেশি না হলেও এই জীবনে বোধহয় খুব বেশি দেখে ফেলেছি। কাজেই এসব হিরোরা সামনের দিনগুলোতে কী করবেন তাও বোধহয় বলে দিতে পারব!
গণমাধ্যম জাগ্রত করার জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে কয়েকটি উদ্যোগ জরুরি—
১. মালিকানার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা : কে কোন গণমাধ্যমের মালিক, তার ব্যবসায়িক স্বার্থ কোথায়—এই তথ্য জনসম্মুখে থাকতে হবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বড় অংশের মালিক হয়েছেন বড় ব্যবসায়ী শ্রেণিÑ যাদের ব্যবসা, সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত লাইসেন্স, ট্যাক্স, আমদানি সুবিধার ওপর নির্ভরশীল। ফলে মালিকরা সরকারি নীতির বিরুদ্ধে যেতে চান না, কারণ এতে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে সত্যিকারের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হারিয়ে গেছে, দুর্নীতির খবর চাপা পড়েছে, সরকারের অপকর্ম প্রচার হয়নি, ব্যর্থতা সাফল্য হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। অন্যদিকে, বিরোধী দল ও ভিন্নমতকে—দুষ্কৃতকারী, দেশবিরোধী, ষড়যন্ত্রকারী রূপে তুলে ধরা হয়েছে। মালিকানা নিরপেক্ষ না হলে গণমাধ্যমও কখনো নিরপেক্ষ হতে পারে না।
২. গণমাধ্যমে বিনিয়োগকারীর স্বার্থসংশ্লিষ্টতা সীমাবদ্ধ করা : যাদের ব্যবসা সরাসরি রাষ্ট্রীয় অনুমতির ওপর নির্ভর করে, তাদের গণমাধ্যম মালিক হওয়া উচিত নয়।
৩. সাংবাদিকতার উপর রাজনৈতিক প্রভাব ও সেলফ-সেন্সরশিপ কমানো
৪. সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও পেশাদারিত্ব বাড়ানো : ভয়মুক্ত সাংবাদিকতা ছাড়া গণমাধ্যম কখনোই শক্তিশালী হতে পারে না।
৫. জাতীয় স্বার্থে গণমাধ্যমকে ঐক্যবদ্ধ করা : গণতন্ত্র, রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের অধিকারের প্রশ্নে গণমাধ্যমকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে।
‘ইয়া-নাফসি’ মোডে সাংবাদিক সমাজ
আজ বাংলাদেশের সাংবাদিকরা সাংবাদিকতার চেয়ে বেশি ব্যস্ত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা ও নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টায়। মামলা, সাইবার আইনের ভয়, ফোনে হুমকি, শারীরিক হামলা, চাকরি হারানোর আতঙ্ক, টিভি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি। এই পরিবেশ সাংবাদিকতাকে শিকল পরিয়ে রেখেছে। যেখানে সাংবাদিক নিরাপদ নয়, সেখানে গণতন্ত্র বাঁচে না।
অনেকেই মনে করছেন যে সোশ্যাল মিডিয়া গণমাধ্যমের ব্যর্থতার ফাঁক পূরণ করছে। এটা সত্য যে যখন মূলধারার গণমাধ্যম নীরব হয়ে গেল, যখন সাংবাদিকরা কথা বলতে ভয় পেল, যখন টিভির টকশো স্ক্রিপ্টেড হয়ে গেল—বা ওয়ার্ল্ড বক্সিং চ্যাম্পিয়ন প্রতিযোগিতার রূপ পরিগ্রহ করল, তখন সত্য বলার জায়গা হয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়া।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার উপর দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতা সমূহ ক্ষতির কারণ হতে পারে! কারণ সোশ্যাল মাধ্যমের তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয় না! ফলে গুজব ছড়ানোর ঝুঁকিও বেশি। কাজেই সোশ্যাল মিডিয়া বা সিটিজেন জার্নালিজম থেকে বেনিফিট নিতে হলে আমাদের সত্যিকার অর্থেই কিছু বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম সৃষ্টি করতে হবে । এদের একটি আরেকটির পরিপূরক হতে পারেÑ কখনোই একটি আরেকটির বিকল্প হবে না!
লেখক: কলামিস্ট
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

