
কমডোর জসীম উদ্দীন ভূইয়াঁ (অব.)

গণতন্ত্রের মোড়কে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ৫৪ বছর পার করেছে, কিন্তু দুর্নীতি আজ সমাজের ক্যানসারে পরিণত। এই দুর্নীতি এখন আর গোপন পাপ নয়, বরং প্রকাশ্য বাণিজ্য। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘দুর্নীতির উৎস হচ্ছে কিছু রাজনীতিবিদ। তাদের হাতেই লালিত হয় দুর্নীতিবাজদের অনেকে। বিগত সরকারের পতনের অন্যতম কারণও ছিল দুর্নীতি।’
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই এই ট্র্যাজেডির প্রমাণ। ২০০৪ সালে যখন আমি একটি সংস্থায় সংযুক্ত ছিলাম, তখন একজন রাজনৈতিক সচিবের বিরুদ্ধে তিন-চারটি লাভজনক পোস্টিংয়ের জন্য ১০ লাখ টাকা করে চাওয়ার রিপোর্ট আমি উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সময়কার সংশ্লিষ্ট কার্যালয় বিষয়টি এড়িয়ে যায় এবং পরে সেটি ধামাচাপা পড়ে যায়। সেই দিন সঠিক কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে না পারার ব্যর্থতাকে আজও এড়িয়ে যেতে পারি না; এটি আমার পক্ষ থেকেও ছিল একটি চরম ভুল, যার দায়ভার এড়াতে পারি না। তখনই মনে হয়েছিল, বাঙালি জাতির মধ্যে দেশপ্রেম ও সততার অভাব এবং ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও অর্থলোভ থাকায় এই ব্যাধি ধীরে ধীরে আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। দুর্নীতির সেই আশঙ্কা আজ সত্যে পরিণত হয়েছে, যা কল্পনারও অতীত। ২০০৪ সালে যেখানে আমি শুধু পুলিশের ওসির লাভজনক পোস্টিংয়ের জন্য পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা লেনদেন করতে হয় বলে জানতাম, দু’দশক পরে সেই পরিমাণ এখন প্রায় ৫০ লাখ টাকা বা তারও বেশি। অন্যদিকে গত দুই দশকে সেই লেনদেন কোটি টাকা ছাড়িয়ে সচিবের চেয়ার বা এনবিআর চেয়ারম্যানের মতো শীর্ষ পদ পেতে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগের স্তরে পৌঁছেছে। এ পরিস্থিতিতে গতানুগতিক ব্যবস্থায় আস্থা রাখা আত্মঘাতী।
বাংলাদেশের দুর্নীতি আজ কেবল প্রশাসনিক নয়, এটি রাজনৈতিক ব্যবস্থারই একটি প্রাতিষ্ঠানিক অংশ। এই ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হলো ‘বিনিয়োগ-উত্তোলন চক্র’: একজন এমপি-প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন পেতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ‘বিনিয়োগ’ করতে হয়। এই ‘ক্রয়মূল্য’ এত বেশি যে সৎ ও মেধাবী প্রার্থীরা পিছিয়ে পড়ে। নির্বাচিত হওয়ার পর এমপির প্রথম লক্ষ্য হয় জনসেবা নয়, বরং নিজের বিনিয়োগের বহুগুণ ‘উত্তোলন’ করা। এই সম্পর্ক একতরফা নয়, কারণ দুর্নীতিবাজরাই রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা লাভ ও ধরে রাখতে আর্থিক এবং অন্যান্য সহায়তা করে। এই রাজনীতিতে যখন শিক্ষিত ও যোগ্য মানুষের পরিবর্তে পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির প্রভাব বাড়ে, তখন রাজনীতি দ্রুত টাকা কামানোর একটি ব্যবসায় পরিণত হয়। আমার অভিজ্ঞতা হলো যখন প্রায় ১০০ জন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়, সেটিও সরকার কর্তৃক একপাশে সরিয়ে রাখা হয়। বাংলায় প্রবাদ প্রচলিত—‘কাকের গোশত কাকে খায় না।’
যেহেতু দুর্নীতিই সরকারের পতনের অন্যতম কারণ ছিল, তাই একে উৎপাটিত করতে হবে নির্মমভাবে। দুর্নীতিকে অত্যন্ত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ও অলাভজনক করে তুলতে হবে। দুর্নীতির এই ব্যাধি দেশের শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। সদ্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ব্যাপক। মিডিয়া রিপোর্ট ও জনদাবিতে উঠে আসে, উপাচার্য ও অধ্যক্ষের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ঘুস নেওয়া হয়েছে। এমন অভিযোগ প্রমাণ করে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শিক্ষা খাতে এমন মারাত্মক দুর্নীতি অসম্ভব। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে মাদক দমনে যে কঠোর (brutal) পথ অবলম্বন করেছিলেন, বাংলাদেশেও দল-মতনির্বিশেষে একই ধরনের চরম ব্যবস্থা উদহারণ হিসেবে অন্তত ১০০ জন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দ্রুত গতিতে চালু করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেতে পারে। দুর্নীতি দমনের জন্য ‘ধরা পড়লে শাস্তি নিশ্চিত’ এমন একটি কঠোর সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, ঠিক যেভাবে নারী ও অ্যাসিড নিক্ষেপ দমনে কঠোরতা দেখানো হয়েছিল।
দুর্নীতির এই মহামারির জন্য কেবল সরকারি কর্মকর্তাই নন, বরং ব্যবসায়ীরাও সমানভাবে দায়ী, যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে প্রলুব্ধ করে। এই ব্যবসায়ীরা প্রায়ই নির্দিষ্ট স্থানে স্থির থাকে, অথচ সরকারি কর্মচারীরা ঘন ঘন বদলি হন। ব্যবসায়ীরা অনেক সময় রাজনীতিবিদদের সহায়তায় কোনো শক্তিশালী ও সৎ কর্মকর্তাকে বদলি করিয়ে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে কাজ হাসিল করে নেয়। কাস্টমস বিভাগের মতো যেখানে বিপুল অঙ্কের লেনদেন হয়, সেখানে এই প্রক্রিয়াটি বিশেষভাবে প্রকট। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের মতো উচ্চপদস্থ ব্যক্তির যুক্তরাজ্যে ২৫০টিরও বেশি সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ প্রমাণ করে, দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের যোগসাজশেই দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আমি আমার থিসিসে দেখিয়েছিলাম, এ ধরনের ‘লাভজনক’ পদগুলো যদি সুসংগঠিতভাবে দুর্নীতিমুক্ত করা যায়, তবে বাংলাদেশের দরিদ্র থাকার কোনো কারণ নেই; অন্যথায়, দেশকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হবে। এই দুই পক্ষকেই আসল অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
কাপুরুষ পালানোর কঠোর বিচারও আজ সময়ের দাবি। জেনারেল হোক বা সৈনিক—সেনাবাহিনীর পরিচয় সাহস ও ত্যাগে। দুর্নীতির কারণে বা ব্যক্তিগত লাভের জন্য অবৈধ কাজ করে পালানো, বিশেষত শত্রু দেশের আশ্রয়ে যাওয়া পুরো বাহিনীর মর্যাদাকে কলঙ্কিত করে। এদের জন্য কঠোর বিচারই হোক, যাতে ইউনিফর্ম পরে আর কেউ কাপুরুষতার দৃষ্টান্ত না গড়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেখায়, সৈনিকের ধর্ম হলো মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করে পতাকা রক্ষা করা। যারা পালায়, তারা শুধু নিজের নয়, জাতির গৌরবেও আঘাত হানে। প্রচলিত বিচারিক ব্যবস্থার মন্থরতা এড়াতে দ্রুতগামী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণে শূন্য সহনশীলতা দেখাতে হবে।
এই বিনিয়োগ-উত্তোলন চক্র থেকে মুক্তি পেতে রাজনীতিকে অবশ্যই অর্থ ও পেশিশক্তি মুক্ত করতে হবে। পশ্চিমা দেশের মতো একটি ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক, যেখানে নির্বাচনের ব্যয়ের জন্য জনগণের কাছ থেকে অনুদান নেওয়া হবে। এই ‘ওপেনিং ফান্ড’ প্রথা চালু করা হলে প্রার্থীর মনোনয়ন কেনার বাধ্যবাধকতা কমবে, যার ফলে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের প্রয়োজনও হ্রাস পাবে। দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে এবং প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয়ের সীমা নির্মমভাবে কার্যকর করতে হবে। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাব সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে স্বচ্ছ, মেধাভিত্তিক ও স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, ডেপুটেশনে একটি বিভাগে সংযুক্ত থাকাকালে আমি সরকার ও বিরোধী দল, ছোট দল এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্বসহ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় ধরনের প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি প্রতিবেশী দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গেও মেশার সুযোগ পেয়েছি এবং তাদের উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতা ও শিক্ষার অভাবে তা অনুধাবন করতে পারেন না, যার প্রমাণ বিগত কয়েক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা। অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং উপমহাদেশের ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ভুলগুলো অনুধাবন করে আমাদের নেতাদের অবশ্যই নিজেদের সংশোধন করতে হবে। রাজনীতিকে কেবল দলের জন্য নয়, বরং ইতিহাসে নিজেদের ভালো কাজগুলোর জন্য স্মরণীয় করে রাখার জন্য সঠিক পথে নিয়ে যেতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার জন্য একজন ভালো ও সৎ নেতাকে জনগণ সবসময়ই পছন্দ করে। এই বাস্তবতা রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে যে, সততা হলো মহত্ত্ব এবং বারবার নির্বাচিত হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশিরা উপমহাদেশের অন্যদের তুলনায় অনেক পরে প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছি। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বেতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯২১ সালে, প্রায় ৬৩ বছর পর। এই ঐতিহাসিক বিলম্ব আমাদের সামাজিক ও আচরণগত মানদণ্ডে একটি চিরস্থায়ী ব্যবধান তৈরি করেছে। ভারতীয় রাষ্ট্রনায়ক গোপাল কৃষ্ণ গোখলের বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা প্রয়োজন—‘আজকের বাংলা যা ভাবে, বাকি ভারত তা কাল ভাবে।’ এই উক্তিটি একসময় বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ও প্রগতিশীল চেতনাকে প্রতিফলিত করত, যা পুরো উপমহাদেশকে অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু আজ যখন বাঙালি জাতি অজ্ঞতা, দুর্নীতি এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ে জর্জরিত, তখন সেই উত্তরাধিকার থেকে আমাদের এই বিচ্যুতি কষ্ট দেয়।
যদি আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগি এবং নিজেদের পরিবর্তনে সাহসী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই, তবে আমাদের এই ৬৩ বছরের ঐতিহাসিক পিছিয়ে পড়া অব্যাহত থাকবে। কেবল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জাতীয় চরিত্রে আত্ম-উন্নয়নের প্রতি আক্রমণাত্মক প্রতিশ্রুতির মাধ্যমেই আমরা এই ঐতিহাসিক ব্যবধান কমিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমান অবস্থানে দাঁড়াতে পারব। জনগণকে সচেতন হতে হবে যে, দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ধ্বংস করছে। জনমত গঠন করতে হবে যে, দুর্নীতিবাজরা জাতীয় শত্রু। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যে, জনগণ একজোট হলে পরিবর্তন সম্ভব। এখন এই গণ-জাগরণের নতুন লক্ষ্য হওয়া উচিত দুর্নীতি। আমাদের বিশ্বাস, এই লেখাটি পাঠকের এবং দেশের কাজে লাগলে আমার অভিজ্ঞতা প্রকাশ সার্থক হবে।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি

গণতন্ত্রের মোড়কে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ৫৪ বছর পার করেছে, কিন্তু দুর্নীতি আজ সমাজের ক্যানসারে পরিণত। এই দুর্নীতি এখন আর গোপন পাপ নয়, বরং প্রকাশ্য বাণিজ্য। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘দুর্নীতির উৎস হচ্ছে কিছু রাজনীতিবিদ। তাদের হাতেই লালিত হয় দুর্নীতিবাজদের অনেকে। বিগত সরকারের পতনের অন্যতম কারণও ছিল দুর্নীতি।’
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই এই ট্র্যাজেডির প্রমাণ। ২০০৪ সালে যখন আমি একটি সংস্থায় সংযুক্ত ছিলাম, তখন একজন রাজনৈতিক সচিবের বিরুদ্ধে তিন-চারটি লাভজনক পোস্টিংয়ের জন্য ১০ লাখ টাকা করে চাওয়ার রিপোর্ট আমি উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সময়কার সংশ্লিষ্ট কার্যালয় বিষয়টি এড়িয়ে যায় এবং পরে সেটি ধামাচাপা পড়ে যায়। সেই দিন সঠিক কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে না পারার ব্যর্থতাকে আজও এড়িয়ে যেতে পারি না; এটি আমার পক্ষ থেকেও ছিল একটি চরম ভুল, যার দায়ভার এড়াতে পারি না। তখনই মনে হয়েছিল, বাঙালি জাতির মধ্যে দেশপ্রেম ও সততার অভাব এবং ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও অর্থলোভ থাকায় এই ব্যাধি ধীরে ধীরে আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। দুর্নীতির সেই আশঙ্কা আজ সত্যে পরিণত হয়েছে, যা কল্পনারও অতীত। ২০০৪ সালে যেখানে আমি শুধু পুলিশের ওসির লাভজনক পোস্টিংয়ের জন্য পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা লেনদেন করতে হয় বলে জানতাম, দু’দশক পরে সেই পরিমাণ এখন প্রায় ৫০ লাখ টাকা বা তারও বেশি। অন্যদিকে গত দুই দশকে সেই লেনদেন কোটি টাকা ছাড়িয়ে সচিবের চেয়ার বা এনবিআর চেয়ারম্যানের মতো শীর্ষ পদ পেতে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগের স্তরে পৌঁছেছে। এ পরিস্থিতিতে গতানুগতিক ব্যবস্থায় আস্থা রাখা আত্মঘাতী।
বাংলাদেশের দুর্নীতি আজ কেবল প্রশাসনিক নয়, এটি রাজনৈতিক ব্যবস্থারই একটি প্রাতিষ্ঠানিক অংশ। এই ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হলো ‘বিনিয়োগ-উত্তোলন চক্র’: একজন এমপি-প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন পেতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ‘বিনিয়োগ’ করতে হয়। এই ‘ক্রয়মূল্য’ এত বেশি যে সৎ ও মেধাবী প্রার্থীরা পিছিয়ে পড়ে। নির্বাচিত হওয়ার পর এমপির প্রথম লক্ষ্য হয় জনসেবা নয়, বরং নিজের বিনিয়োগের বহুগুণ ‘উত্তোলন’ করা। এই সম্পর্ক একতরফা নয়, কারণ দুর্নীতিবাজরাই রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা লাভ ও ধরে রাখতে আর্থিক এবং অন্যান্য সহায়তা করে। এই রাজনীতিতে যখন শিক্ষিত ও যোগ্য মানুষের পরিবর্তে পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির প্রভাব বাড়ে, তখন রাজনীতি দ্রুত টাকা কামানোর একটি ব্যবসায় পরিণত হয়। আমার অভিজ্ঞতা হলো যখন প্রায় ১০০ জন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়, সেটিও সরকার কর্তৃক একপাশে সরিয়ে রাখা হয়। বাংলায় প্রবাদ প্রচলিত—‘কাকের গোশত কাকে খায় না।’
যেহেতু দুর্নীতিই সরকারের পতনের অন্যতম কারণ ছিল, তাই একে উৎপাটিত করতে হবে নির্মমভাবে। দুর্নীতিকে অত্যন্ত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ও অলাভজনক করে তুলতে হবে। দুর্নীতির এই ব্যাধি দেশের শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। সদ্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ব্যাপক। মিডিয়া রিপোর্ট ও জনদাবিতে উঠে আসে, উপাচার্য ও অধ্যক্ষের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ঘুস নেওয়া হয়েছে। এমন অভিযোগ প্রমাণ করে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শিক্ষা খাতে এমন মারাত্মক দুর্নীতি অসম্ভব। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে মাদক দমনে যে কঠোর (brutal) পথ অবলম্বন করেছিলেন, বাংলাদেশেও দল-মতনির্বিশেষে একই ধরনের চরম ব্যবস্থা উদহারণ হিসেবে অন্তত ১০০ জন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দ্রুত গতিতে চালু করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেতে পারে। দুর্নীতি দমনের জন্য ‘ধরা পড়লে শাস্তি নিশ্চিত’ এমন একটি কঠোর সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, ঠিক যেভাবে নারী ও অ্যাসিড নিক্ষেপ দমনে কঠোরতা দেখানো হয়েছিল।
দুর্নীতির এই মহামারির জন্য কেবল সরকারি কর্মকর্তাই নন, বরং ব্যবসায়ীরাও সমানভাবে দায়ী, যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে প্রলুব্ধ করে। এই ব্যবসায়ীরা প্রায়ই নির্দিষ্ট স্থানে স্থির থাকে, অথচ সরকারি কর্মচারীরা ঘন ঘন বদলি হন। ব্যবসায়ীরা অনেক সময় রাজনীতিবিদদের সহায়তায় কোনো শক্তিশালী ও সৎ কর্মকর্তাকে বদলি করিয়ে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে কাজ হাসিল করে নেয়। কাস্টমস বিভাগের মতো যেখানে বিপুল অঙ্কের লেনদেন হয়, সেখানে এই প্রক্রিয়াটি বিশেষভাবে প্রকট। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের মতো উচ্চপদস্থ ব্যক্তির যুক্তরাজ্যে ২৫০টিরও বেশি সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ প্রমাণ করে, দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের যোগসাজশেই দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আমি আমার থিসিসে দেখিয়েছিলাম, এ ধরনের ‘লাভজনক’ পদগুলো যদি সুসংগঠিতভাবে দুর্নীতিমুক্ত করা যায়, তবে বাংলাদেশের দরিদ্র থাকার কোনো কারণ নেই; অন্যথায়, দেশকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হবে। এই দুই পক্ষকেই আসল অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
কাপুরুষ পালানোর কঠোর বিচারও আজ সময়ের দাবি। জেনারেল হোক বা সৈনিক—সেনাবাহিনীর পরিচয় সাহস ও ত্যাগে। দুর্নীতির কারণে বা ব্যক্তিগত লাভের জন্য অবৈধ কাজ করে পালানো, বিশেষত শত্রু দেশের আশ্রয়ে যাওয়া পুরো বাহিনীর মর্যাদাকে কলঙ্কিত করে। এদের জন্য কঠোর বিচারই হোক, যাতে ইউনিফর্ম পরে আর কেউ কাপুরুষতার দৃষ্টান্ত না গড়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেখায়, সৈনিকের ধর্ম হলো মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করে পতাকা রক্ষা করা। যারা পালায়, তারা শুধু নিজের নয়, জাতির গৌরবেও আঘাত হানে। প্রচলিত বিচারিক ব্যবস্থার মন্থরতা এড়াতে দ্রুতগামী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণে শূন্য সহনশীলতা দেখাতে হবে।
এই বিনিয়োগ-উত্তোলন চক্র থেকে মুক্তি পেতে রাজনীতিকে অবশ্যই অর্থ ও পেশিশক্তি মুক্ত করতে হবে। পশ্চিমা দেশের মতো একটি ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক, যেখানে নির্বাচনের ব্যয়ের জন্য জনগণের কাছ থেকে অনুদান নেওয়া হবে। এই ‘ওপেনিং ফান্ড’ প্রথা চালু করা হলে প্রার্থীর মনোনয়ন কেনার বাধ্যবাধকতা কমবে, যার ফলে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের প্রয়োজনও হ্রাস পাবে। দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে এবং প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয়ের সীমা নির্মমভাবে কার্যকর করতে হবে। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাব সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে স্বচ্ছ, মেধাভিত্তিক ও স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, ডেপুটেশনে একটি বিভাগে সংযুক্ত থাকাকালে আমি সরকার ও বিরোধী দল, ছোট দল এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্বসহ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় ধরনের প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি প্রতিবেশী দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গেও মেশার সুযোগ পেয়েছি এবং তাদের উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতা ও শিক্ষার অভাবে তা অনুধাবন করতে পারেন না, যার প্রমাণ বিগত কয়েক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা। অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং উপমহাদেশের ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ভুলগুলো অনুধাবন করে আমাদের নেতাদের অবশ্যই নিজেদের সংশোধন করতে হবে। রাজনীতিকে কেবল দলের জন্য নয়, বরং ইতিহাসে নিজেদের ভালো কাজগুলোর জন্য স্মরণীয় করে রাখার জন্য সঠিক পথে নিয়ে যেতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার জন্য একজন ভালো ও সৎ নেতাকে জনগণ সবসময়ই পছন্দ করে। এই বাস্তবতা রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে যে, সততা হলো মহত্ত্ব এবং বারবার নির্বাচিত হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশিরা উপমহাদেশের অন্যদের তুলনায় অনেক পরে প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছি। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বেতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯২১ সালে, প্রায় ৬৩ বছর পর। এই ঐতিহাসিক বিলম্ব আমাদের সামাজিক ও আচরণগত মানদণ্ডে একটি চিরস্থায়ী ব্যবধান তৈরি করেছে। ভারতীয় রাষ্ট্রনায়ক গোপাল কৃষ্ণ গোখলের বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা প্রয়োজন—‘আজকের বাংলা যা ভাবে, বাকি ভারত তা কাল ভাবে।’ এই উক্তিটি একসময় বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ও প্রগতিশীল চেতনাকে প্রতিফলিত করত, যা পুরো উপমহাদেশকে অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু আজ যখন বাঙালি জাতি অজ্ঞতা, দুর্নীতি এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ে জর্জরিত, তখন সেই উত্তরাধিকার থেকে আমাদের এই বিচ্যুতি কষ্ট দেয়।
যদি আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগি এবং নিজেদের পরিবর্তনে সাহসী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই, তবে আমাদের এই ৬৩ বছরের ঐতিহাসিক পিছিয়ে পড়া অব্যাহত থাকবে। কেবল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জাতীয় চরিত্রে আত্ম-উন্নয়নের প্রতি আক্রমণাত্মক প্রতিশ্রুতির মাধ্যমেই আমরা এই ঐতিহাসিক ব্যবধান কমিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমান অবস্থানে দাঁড়াতে পারব। জনগণকে সচেতন হতে হবে যে, দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ধ্বংস করছে। জনমত গঠন করতে হবে যে, দুর্নীতিবাজরা জাতীয় শত্রু। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যে, জনগণ একজোট হলে পরিবর্তন সম্ভব। এখন এই গণ-জাগরণের নতুন লক্ষ্য হওয়া উচিত দুর্নীতি। আমাদের বিশ্বাস, এই লেখাটি পাঠকের এবং দেশের কাজে লাগলে আমার অভিজ্ঞতা প্রকাশ সার্থক হবে।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি

সৃষ্টির শুরু থেকেই জীবজগতে ছোট-বড় প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের অলিখিত লড়াই চলছে। বিরামহীন এই লড়াইয়ে সবল প্রাণীরা অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের হারিয়ে ক্রমে এই গ্রহে নিজেদের দখল নিশ্চিত করেছে।
২ ঘণ্টা আগে
ভারত আর ইসরাইল বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। বিশ্বকে চমকে দিয়েছে এই চুক্তি। দক্ষিণ এশিয়া আর মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব পড়বে অনেক। চুক্তির সময়টাও তাৎপর্যপূর্ণ। সারা বিশ্বের মানুষ এখন গাজা আর পশ্চিম তীরে ইসরাইলের অপকর্মের জন্য তাদের তীব্র নিন্দা করছে।
২ ঘণ্টা আগে
রোহিঙ্গা সংকট দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী মানবিক এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যার একটি। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের কোনো বাস্তব সম্ভাবনা নেই।
২ ঘণ্টা আগে
চলমান রাজনীতির বৃহত্তর দুই শক্তি বিএনপি ও জামায়াত তাদের অধিকাংশ সংসদ সদস্য প্রার্থীকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগেই। অন্যসব দল অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে কথাবার্তা বললেও এজেন্ডাভিত্তিক প্রাক-নির্বাচনি বিতর্কে যোগদান করেনি এখনো।
২ ঘণ্টা আগে