যুদ্ধবিরতি যেসব সমস্যায় ফেলেছে নেতানিয়াহুকে

সাইমন স্পিকম্যান কোরডাল
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৫৮
ছবি: সংগৃহীত

গাজায় গত দুই বছরে ভয়াবহ গণহত্যার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের জন্য অকল্পনীয় মানবিক দুর্ভোগ তৈরি করেছে ইসরাইল। কিন্তু এর পরও নেতানিয়াহু যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে মরিয়া ছিলেন ইসরাইলের রাজনীতিতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুর ওপর যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দেওয়ায় তিনি এটা মেনে নিতে বাধ্য হন। পর্যবেক্ষক ও সমালোচকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নেতানিয়াহু যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন, তা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে যুদ্ধকে ব্যবহার করেছেন দুই বছর ধরে। গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর এই চ্যালেঞ্জগুলোর কোনোটিই সরে যায়নি, বরং নেতানিয়াহুর সামনেই সেগুলো এখন আরো বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

ঘুস, জালিয়াতি এবং বিশ্বাসভঙ্গ করার অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বর্তমানে তিনটি দুর্নীতি মামলার বিচার চলছে। গাজায় যুদ্ধ চলাকালে এসব মামলার শুনানিতে বিলম্ব সত্ত্বেও এগুলো চলমান আছে। বিচারে নেতানিয়াহুর ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। গাজায় দীর্ঘ যুদ্ধ এবং নেতানিয়াহুর দুর্নীতির বিচারের মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকার কথা ট্রাম্প প্রায় স্বীকার করেই নিয়েছেন। ইসরাইলি পার্লামেন্ট নেসেটে সম্প্রতি দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করার জন্য ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জোগের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন।

যুদ্ধ না থাকলে নেতানিয়াহুর ভাগ্যে যে বিপর্যয় নেমে আসবে, তা এখন অনেকটাই নিশ্চিত।

এ জন্যই নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতিকে পার্লামেন্টে একটি বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য ব্যথিত ছিলেন। কারণ সেটাকে তার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, মেনে নিতে তাকে বাধ্য করা হয়েছে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে। কেননা, ইসরাইলের এই যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান আর্থিক ব্যয় ও কূটনৈতিক চাপের মুখে হোয়াইট হাউস ধৈর্য হারাচ্ছিল, সবকিছুই তাদের সহ্যের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছিল বলে মনে করেন সাবেক ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত অ্যালন পিঙ্কাসসহ অনেক বিশ্লেষকই।

সামনে বিপদের এই পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষার জন্য নেতানিয়াহু যদি আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে না পারেন, তাহলে ইসরাইলে আগামী বছরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে এবং পরে বেশ কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। সেগুলো তার জন্য কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, সে ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসরাইল এখনকার মতো এত বিচ্ছিন্ন আগে কখনো ছিল না এবং অনেকের কাছে নেতানিয়াহু দেশটির এই বিচ্ছিন্নতার মুখ হয়ে উঠেছেন। গাজায় গত দুই বছরের আগ্রাসনে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের চিত্র বিশ্বজুড়ে ইসরাইলবিরোধী মনোভাবকে জোরালো করে তুলেছে। নেতানিয়াহু যদি স্বল্প মেয়াদে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ না করেন, তবে তার সরকার এই উপত্যকায় যা করেছে, মিডিয়ায় তার ব্যাপক প্রচার ইসরাইলের বিচ্ছিন্নতাকে আরো জোরদার এবং দেশটিকে কিছু সময়ের জন্য হলেও একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করবে।

ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা কয়েক মাস ধরেই স্পষ্ট হচ্ছিল এবং এটি অব্যাহত রাখার ভিত্তি নেতানিয়াহু নিজেই তৈরি করেছেন। প্রাচীন আমলের গ্রিক রাষ্ট্র স্পার্টার অনুকরণে ইসরাইলকে ‘সুপার স্পার্টা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নেতানিয়াহু যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন, যা ইসরাইলকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে গেছে।

নেতানিয়াহুর এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে খুব একটা কাজ করেনি। ইসরাইলি স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারের দর প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে পড়ে যায় এবং অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে শেকেলের দামও কমে যায়। দেশের ২০০টি বৃহত্তম কোম্পানির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইসরাইল বিজনেস ফোরাম সংগত কারণেই নেতানিয়াহুর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছে, ‘আমরা স্পার্টা নই’।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় নেতানিয়াহুর সংকট আঁচ করে কট্টর ডানপন্থি দলগুলো কি জোট সরকার ছেড়ে চলে যেতে পারে? এর উত্তর হচ্ছে, এটা হতে পারে। তবে, নেতানিয়াহু এই সংকট এড়াতে এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। সরকার থেকে তাদের চলে যাওয়ার সম্ভাবনা সামনে রেখে নেতানিয়াহু কট্টর-অর্থোডক্স ইয়েশিভা শিক্ষার্থীদের খসড়া থেকে বাদ দিতে আইন প্রণয়ন করছেন এই আশায় যে, তা পার্লামেন্টের কট্টরপন্থি অর্থোডক্স দলগুলোকে তার সরকারে ফিরে আসতে উৎসাহিত করবে। এর ফলে কোনো দল জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও অন্য দলকে অন্তর্ভুক্ত করে নেতানিয়াহুর সরকার টিকে থাকতে সক্ষম হবে।

গাজায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ইসরাইলে যুদ্ধবিরোধী প্রবল বিক্ষোভের সময় নেতানিয়াহু কট্টর ডানপন্থি দলগুলোর সমর্থনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছেন। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এবং জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের দলের সমর্থন ছিল নেতানিয়াহুর সরকারের টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কট্টর ফিলিস্তিনবিদ্বেষী এই দুই মন্ত্রী নেতানিয়াহুর শাসক জোটে থাকার সময় গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রবল বিরোধিতা করেছেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) কি এখনো নেতানিয়াহু এবং ইসরাইলকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারবে? এর স্পষ্ট উত্তর হচ্ছে তারা পারে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আইসিসি ২০২৪ সালের নভেম্বরে নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং ইসরাইলি হামলায় নিহত হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

আইসিজে ইসরাইলের বিরুদ্ধেও গণহত্যার অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। আমলে নেওয়া হলে ইসরাইলের অনেকেই এর জন্য নেতানিয়াহুকে যে দায়ী করবেন, তা নিশ্চিত। গ্যালান্ট এবং নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আইসিসির মামলার রায় ঘোষণার জন্য কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা নেই এবং ২০২৭ সাল শেষ হওয়ার আগে আইসিজের মামলার রায় ঘোষণারও কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে তারা দোষী সাব্যস্ত হলে আইসিজে ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারে। তবে যেকোনো দোষী সাব্যস্ত রায় কার্যকর করার জন্য আইসিজেকে তাদের আদেশটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাঠাতে হয়।

ট্রাম্প কি নেতানিয়াহুকে ত্যাগ করতে পারবেন? এ ক্ষেত্রে বলা যায়, এটা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রধান অর্থনৈতিক ও সামরিক পৃষ্ঠপোষক এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতার মুখে দেশটির কূটনৈতিক ভিত্তি। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া ইসরাইল এবং নেতানিয়াহু সত্যিকার অর্থে বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে।

নেতানিয়াহু যাই দাবি করুন না কেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থনেরও একটা স্পষ্ট সীমা আছে।

২০২১ সালে নেতানিয়াহু যখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে তার নির্বাচনি জয়ের জন্য অভিনন্দন জানানো প্রথম কয়েকজন নেতার একজন হয়ে ওঠেন, তখন ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে ব্যবহারের বা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন এমন উদ্বেগের কারণে মে মাসে তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেছিলেন বলেও জানা গেছে। সেপ্টেম্বরে কাতারের রাজধানী দোহায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় যোগ দেওয়া হামাস নেতাদের ওপর ইসরাইলের হামলার পর নেতানিয়াহুর প্রতি ট্রাম্পের ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছিল, তিনি বলেছিলেনÑ‘সে আমার সবকিছু গোলমাল করে দিচ্ছে!’

যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার বিষয়ে বলতে গিয়ে ট্রাম্প বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তিনি নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার ‘ঝগড়া মিটিয়েছেন’ এবং এটাও বলেছেন, ‘আমি কথা না বলা পর্যন্ত’ ইসরাইলকে গাজায় আবার সেনা মোতায়েন করার অনুমতি দেবেন না তিনি। পরে ইসরাইলি পার্লামেন্টে যুদ্ধবিরতির উদ্বোধন উদযাপন করে ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতিকে ৩,০০০ বছরের পুরোনো বিবাদ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘এটি টিকে থাকবে।’

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১,১৩৯ জন নিহত হন এবং প্রায় ২৫০ জনকে অপহরণ করা হয়েছিল। এই হামলা ঠেকাতে নেতানিয়াহুর ব্যর্থতা নিয়ে তদন্ত হবে কি না সে বিষয়টিও এখন সামনে আসছে। এ সম্পর্কে বলা যায়, তদন্তের সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। ওই হামলার ঠেকাতে আগাম ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা নিয়েও পৃথক তদন্ত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এ ধরনের একটি হামলা ঠেকাতে আগে থেকেই যে সতর্কতা নেওয়া দরকার ছিল, সে ধরনের কোনো প্রস্তুতি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে ছিল না এবং তারা এ ধরনের একটি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এই ব্যর্থতার কারণে সেনা এবং গোয়েন্দা প্রধান উভয়ই পদত্যাগ করেছেন।

নেতানিয়াহু যদিও এই তদন্তগুলো নিয়ে কোনো আপত্তি জানাননি, তবে ওই হামলার সময় তার সরকারের ভূমিকা নিয়ে তদন্তের উদ্যোগ তিনি প্রতিহত করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, যুদ্ধের সময়ে এ ধরনের তদন্ত রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট এবং অবাস্তব হবে। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর ইসরাইলের হাইকোর্ট সর্বসম্মতভাবে রায় দিয়েছে, এই তদন্ত বিলম্বিত করার জন্য আর ‘কোনো বাস্তব যুক্তি’ নেই। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে সরকারকে ৩০ দিন সময় দিয়েছে আদালত।

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত