
মাহমুদুর রহমান

প্রফেসর ইউনূসের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে আর মাত্র সাড়ে তিন মাস বাকি আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সপ্তাহ দুয়েক আগে বলেছিলেন, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুসারে তফসিল ঘোষণা হলেই সরকারের দৈনন্দিন প্রশাসনিক ক্ষমতা অনেকটাই নির্বাচন কমিশনের হাতে চলে যায়।
তখন থেকে জেলা প্রশাসক এবং এসপিদের কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা বাধ্যতামূলক। তফসিল ঘোষণার পর সরকারি কর্মকর্তাদের পদায়ন, বদলি, দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদির সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। ফলে ইউনূস সরকারকে তখন প্রবাদবাক্যের খোঁড়া হাসের (Lame Duck) ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। সুতরাং, আর মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রশাসনকে ‘ইন্টেরিমের’ এমন বন্দোবস্তে রেখে যেতে হবে যাতে করে ড. ইউনূসের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাংলাদেশে ইতিহাসের সেরা নির্বাচনটি হতে পারে।
গত সপ্তাহে বিএনপি তাদের ইদানীংকালের স্বভাবসুলভ নালিশের পসরা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে হাজির হলে ড. ইউনূস যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন যে তিনি নিজে নিরপেক্ষ প্রশাসন সাজিয়ে দিয়ে তবেই দায়িত্ব ছাড়বেন। কিন্তু সরকারের গত চৌদ্দ মাসের প্রশাসন চালানোর ভালোমন্দ অভিজ্ঞতার আলোকে জনগণের বোধহয় তেমন একটা আশাবাদী হওয়া সহজ নয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে এবার দৃষ্টিপাত করা যাক।
১. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : এই সত্য আমাদের সবারই মেনে নেওয়া উচিত যে, প্রফেসর ইউনূস গত বছর ৮ আগস্ট প্রশাসনিকভাবে একটি বিধ্বস্ত সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। জাতি হিসেবে আমাদের স্মরণশক্তি কম হলেও, এত তাড়াতাড়ি আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি যে সেই সময়, আমার নাতি-নাতনির বয়সি কিশোর-কিশোরীদের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। কারণ হাসিনার পতনের পর তীব্র জনরোষের ভয়ে ট্রাফিক পুলিশও পালিয়ে গিয়েছিল। দেশের অনেক থানা আক্রান্ত হয়েছিল এবং যেগুলো অক্ষত ছিল সেগুলোতেও জনবল ছিল না।
বলতে গেলে প্রায় সম্পূর্ণ অকার্যকর অবস্থা থেকে পুলিশ বাহিনীতে যতটা সম্ভব শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। একটি বাহিনীর শৃঙ্খলা ও নৈতিক শক্তি একবার ভেঙে গেলে সেটা ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। তার ওপর পনেরো বছরে আওয়ামী লীগের মাত্রাহীন দলীয়করণের ফলে পুলিশে কোনোরকম পেশাদারিত্ব আর অবশিষ্ট ছিল না। পুলিশের মতো সেনাবাহিনীকেও শেখ হাসিনা রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিস্বার্থে অনৈতিক ও বেআইনিভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্বল, হতোদ্যম এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন।
কদিন আগে গুম ও গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে সেনাবাহিনীর ১৫ জন অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মরত সিনিয়র কর্মকর্তাদের আইসিটি আদালতে নেওয়া হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে আনন্দ প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে জনমনে সামরিক বাহিনীর সার্বিক ভাবমূর্তির দুঃখজনক পতনের প্রমাণ মিলেছে। যেসব জেনারেল সাহেব এখন সেনাবাহিনী চালাচ্ছেন, তারা মন খারাপ না করে বরং জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসা কেন হারালেন তা নিয়ে খোলামনে ভাবনাচিন্তা করুন।
‘আমরা কেউ কিছু জানতাম না’-এই আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে বেরিয়ে এসে ভুল স্বীকার করুন। যা-ই হোক, নৈতিক বল ও জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলা, উদ্যমহীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা সাহস, পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা এবং দেশপ্রেম নিয়ে আগামী নির্বাচনে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে-এ নিয়ে আমি শঙ্কামুক্ত হতে পারছি না।
২. ফ্যাসিস্ট দোসরদের সহিংসতা : দিল্লির আশ্রয়ে থেকে শেখ হাসিনা এবং ভারতে পলাতক অন্যান্য ফ্যাসিস্ট রাজনীতিবিদ, পুলিশ, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা গত চৌদ্দ মাসে বাংলাদেশে সহিংসতা সৃষ্টি করে সরকারকে অকার্যকর করার জন্য সব ধরনের উপায়ে চেষ্টা করে চলেছে। দেশে অবস্থানরত তাদের সমর্থকরা কেবল যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে তা-ই নয়, তারা নিশ্চিতভাবে আসন্ন নির্বাচনও হয় ভন্ডুল কিংবা নিদেনপক্ষে প্রশ্নবিদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টাও চালাবে।
জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে এত বিপুল সংখ্যায় ফ্যাসিস্ট সরকারের চিহ্নিত সহযোগীদের নিরাপদে দেশ ত্যাগ করে ভারতে ঘাঁটি গাড়তে দেওয়াটা ইউনূস সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর এক বিশাল ব্যর্থতা। অহেতুক রক্তপাত এড়াতে শেখ হাসিনাকে ভারতে চালান করে দেওয়ার স্বপক্ষে নানা ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করা গেলেও, ফ্যাসিবাদের সহযোগী খুনি ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ এবং সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের এভাবে সীমান্ত পার করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বিরাট ঝুঁকি তৈরি করেছে।
দেড় দশকে দেশকে যারা ধ্বংস করেছে, তাদের শত্রুদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ যেসব ক্ষমতাবান করে দিয়েছেন, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক ও যুক্তিসংগত। অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন যে, সাম্প্রতিক সিরিজ অগ্নিকাণ্ডে উপরোক্ত পলাতক অপরাধীগোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের যোগসাজশ রয়েছে। তার ওপর প্রতিদিন নিত্যনতুন দাবিনামা নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী মাঠে নেমে সরকারকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলেছে। ড. ইউনূস বুঝতে পারছেন কি না জানি না, এসব বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা প্রতিরোধ করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে তার সরকারকে বিশেষভাবে বেগ পেতে হবে।
৩. প্রশাসনের অসহযোগিতা : শেখ হাসিনা সর্বব্যাপী দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান যে চরমভাবে কলুষিত ও অকার্যকর করে গেছেন, সে বিষয়ে প্রথমেই উল্লেখ করেছি। বর্তমান সরকার এক বছরে প্রশাসনকে কতখানি দলনিরপেক্ষ করতে সক্ষম হয়েছে তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তার ওপর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় একেবারে ‘নিজেদের লোক’ বসানো নিয়ে আগামী নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। বাংলাদেশের নির্বাচনি কালচার হলো, সব প্রার্থীই চান যেন জেলার ডিসি এবং এসপিরা তাদের কথা শুনে চলেন এবং থানার ওসি যেন নির্বাচনে কারচুপি করতে সহায়তা করেন।
একদিকে ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া অসৎ কর্মকর্তা; অন্যদিকে দলীয় ভাবধারায় কলুষিত প্রশাসনকে দিয়ে নির্বাচন কমিশন কোন জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে একটি নিরপেক্ষ ও বিতর্কহীন নির্বাচন করতে সক্ষম হবে, সেটা বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। পরিচিত অনেক উপদেষ্টা এবং সিনিয়র কর্মকর্তার কাছ থেকে রাজনৈতিক চাপের যেসব কাহিনি শুনি তাতে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত হই। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে আমলাতন্ত্র সম্ভাব্য বিজয়ী দলকে নির্বাচনের আগে থেকেই নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে খুশি রাখতে চায় যাতে নতুন সরকার গঠনের পর তাদের চাকরি করতে সুবিধা হয়। ড. ইউনূস তথাকথিত ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করার জন্য নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা তার সফলতা কামনা করি।
৪. আওয়ামী অঞ্চলে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা প্রদান : গোপালগঞ্জের কথাই ধরা যাক। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত শেখ পরিবারের দুর্গে অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা গেছে এমন দাবি সম্ভবত খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও করতে পারবেন না। গত বছর আগস্টের পর সেখানে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের কুপিয়ে হত্যা করেছে, সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে তাদের গাড়ি পোড়ানো হয়েছে, এনসিপির তরুণ নেতারা দেশব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে গোপালগঞ্জ সফরে গেলে পলাতক হাসিনার নির্দেশে তাদের হত্যা করার জন্য রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ও পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে এবং এসপি ও ডিসির অফিসসহ অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় একাধিকবার আগুন দেওয়া হয়েছে। শুধু গোপালগঞ্জেই নয়, পার্শ্ববর্তী আওয়ামী লীগ সমর্থিত জেলাতেও নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত বিরোধে হাজার হাজার মানুষ থানা আক্রমণ করে পুলিশের গাড়িতে আগুন দিয়ে এমন তাণ্ডব করেছে যে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন।
এসব পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে আগাম কোনো সতর্কবার্তা জানাতে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। গোপালগঞ্জের মতো কট্টর আওয়ামী সন্ত্রাসী অধ্যুষিত জেলার সংখ্যা অন্তত আধাডজনের কম হবে না বলেই আমার ধারণা। শেখ হাসিনা অবশ্যই ভারতীয় ডিপ স্টেটের সহায়তা নিয়ে বিশেষ করে এই জেলাগুলোতে নির্বাচন বানচালের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। আমি জানি না, সেসব জেলার সাধারণ মানুষ যাতে নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন এবং নির্বাচন চলাকালে সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে আয়ত্তে থাকে, তার জন্য নির্বাচন কমিশন এবং সরকার আদৌ কোনো আগাম পরিকল্পনা তৈরি করেছেন কি না। না করে থাকলে সময় কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
৫. গণভোট বনাম সংসদ নির্বাচন বিতর্ক : বেশ কয়েকদফা ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়িয়েও রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক বিষয়েই ঐকমত্যে আনা সম্ভব হয়নি। তবে দেরিতে হলেও শেষপর্যন্ত একটি গণভোটের ব্যাপারে তারা একমত হতে পেরেছেন। এখন সেই গণভোট কবে হবে, সে নিয়ে গোল বেধেছে। বিএনপি চাচ্ছে একই দিনে গণভোট এবং সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। অপরদিকে জামায়াতের দাবি আগে গণভোট, তারপর জাতীয় নির্বাচন।
পিআর নিয়ে জামায়াতের আরো একটি দাবি রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্তত আগামী নির্বাচনে নিম্নকক্ষে পিআরের পক্ষে নই। এটি একটি জটিল পদ্ধতি হওয়ায় বাংলাদেশের জনগণকে সেই নির্বাচনি ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত করতে অনেক তর্কবিতর্ক, ব্যাখ্যা ও প্রশিক্ষণের দরকার হবে। এর জন্য যে সময় প্রয়োজন তা আমাদের হাতে আপাতত নেই। কাজেই পিআরের দাবি থেকে জামায়াতের আর দেরি না করে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে আসা উচিত। তবে, জামায়াতের অন্য দাবি অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটকে আমি অধিক আইনসংগত মনে করি। সব বিবেচনায় গণভোট আগে হওয়াটাই সমীচীন ছিল। একই দিনে দুই ভিন্ন প্রকৃতির নির্বাচন হলে অনেক ভোটারই বিভ্রান্ত হতে পারেন।
তাদের দুই ব্যালটের পার্থক্য বোঝানো সহজ হবে না। সমস্যা হলো, ফেব্রুয়ারি আসতে আর মাত্র তিন মাস বাকি রয়েছে। এই তিন মাসের মধ্যে দুটি নির্বাচন করার মতো অবস্থা ও সংগতি রাষ্ট্রের নেই। আমার ধারণা, নির্বাচন কমিশনও এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত নয়। গণভোটের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রথমেই সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ব্যর্থতার দায় ঐকমত্য কমিশন এবং এক বছর ধরে দফায় দফায় মিটিং করে আসা সব রাজনৈতিক দলকে নিতে হবে। সমস্যা যেহেতু আপনারা তৈরি করেছেন, একটি বাস্তবসম্মত সমাধানও আপনাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।
৬. নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন : আমি বহুবার বলেছি এবং লিখেছি যে, আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা নির্বাচন ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই অসাধারণ নির্বাচনের পরও পরাজিত দল আওয়ামী লীগ জনগণের রায় মানতে চায়নি। আজন্ম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনা নিজে ঢাকার দুই আসনে সাদেক হোসেন খোকা এবং মেজর (অব.) মান্নানের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন।
এরপর হাসিনার পদত্যাগ নাটক, ড. কামাল হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার, ইত্যাকার ঘটনা আমরা দেখেছিলাম। সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা সদম্ভে বলেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে তিনি একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। ১৭৩ দিন হরতাল করে, সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে এবং অকাতরে মানুষ মেরে তিনি অক্ষরে অক্ষরে কথা রেখেছিলেন। আজকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া সেই সময় থাকলে জেন-জি শেখ হাসিনার নাম পাল্টে অশান্তি বেগম ভাইরাল করে দিত।
১৯৯১ সালের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সরকারের তুলনায় ‘ইন্টেরিমের’ মাথার ওপর বিপদের বোঝা অনেক বেশি ওজনদার। সুতরাং, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শেষে পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ তুলে দেশে যে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এর আগে একাধিক লেখায় ড. ইউনূসকে শুধু একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের এজেন্ডা নিয়ে দেশের বড় দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসার পরামর্শ দিলেও তিনি এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। সরকারকে পুনরায় সতর্ক করে বলছি যে, কোনো কারণে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে সেই ব্যর্থতার সম্পূর্ণ দায় প্রফেসর ইউনূসকেই নিতে হবে।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর এবং ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর দুইবার আমরা রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ নষ্ট করেছি। মহান জুলাই বিপ্লবে আমাদের সন্তানরা অকুতোভয়ে তাদের প্রাণের বিনিময়ে আবার নতুন করে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, কল্যাণমুখী, মানবিক এবং প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দিয়েছে। আশা করি, বর্তমান কালের প্রবীণ ও নবীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তৃতীয়বার জাতিকে হতাশ করবেন না।

প্রফেসর ইউনূসের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে আর মাত্র সাড়ে তিন মাস বাকি আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সপ্তাহ দুয়েক আগে বলেছিলেন, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুসারে তফসিল ঘোষণা হলেই সরকারের দৈনন্দিন প্রশাসনিক ক্ষমতা অনেকটাই নির্বাচন কমিশনের হাতে চলে যায়।
তখন থেকে জেলা প্রশাসক এবং এসপিদের কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা বাধ্যতামূলক। তফসিল ঘোষণার পর সরকারি কর্মকর্তাদের পদায়ন, বদলি, দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদির সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। ফলে ইউনূস সরকারকে তখন প্রবাদবাক্যের খোঁড়া হাসের (Lame Duck) ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। সুতরাং, আর মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রশাসনকে ‘ইন্টেরিমের’ এমন বন্দোবস্তে রেখে যেতে হবে যাতে করে ড. ইউনূসের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাংলাদেশে ইতিহাসের সেরা নির্বাচনটি হতে পারে।
গত সপ্তাহে বিএনপি তাদের ইদানীংকালের স্বভাবসুলভ নালিশের পসরা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে হাজির হলে ড. ইউনূস যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন যে তিনি নিজে নিরপেক্ষ প্রশাসন সাজিয়ে দিয়ে তবেই দায়িত্ব ছাড়বেন। কিন্তু সরকারের গত চৌদ্দ মাসের প্রশাসন চালানোর ভালোমন্দ অভিজ্ঞতার আলোকে জনগণের বোধহয় তেমন একটা আশাবাদী হওয়া সহজ নয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে এবার দৃষ্টিপাত করা যাক।
১. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : এই সত্য আমাদের সবারই মেনে নেওয়া উচিত যে, প্রফেসর ইউনূস গত বছর ৮ আগস্ট প্রশাসনিকভাবে একটি বিধ্বস্ত সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। জাতি হিসেবে আমাদের স্মরণশক্তি কম হলেও, এত তাড়াতাড়ি আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি যে সেই সময়, আমার নাতি-নাতনির বয়সি কিশোর-কিশোরীদের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। কারণ হাসিনার পতনের পর তীব্র জনরোষের ভয়ে ট্রাফিক পুলিশও পালিয়ে গিয়েছিল। দেশের অনেক থানা আক্রান্ত হয়েছিল এবং যেগুলো অক্ষত ছিল সেগুলোতেও জনবল ছিল না।
বলতে গেলে প্রায় সম্পূর্ণ অকার্যকর অবস্থা থেকে পুলিশ বাহিনীতে যতটা সম্ভব শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। একটি বাহিনীর শৃঙ্খলা ও নৈতিক শক্তি একবার ভেঙে গেলে সেটা ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। তার ওপর পনেরো বছরে আওয়ামী লীগের মাত্রাহীন দলীয়করণের ফলে পুলিশে কোনোরকম পেশাদারিত্ব আর অবশিষ্ট ছিল না। পুলিশের মতো সেনাবাহিনীকেও শেখ হাসিনা রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিস্বার্থে অনৈতিক ও বেআইনিভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্বল, হতোদ্যম এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন।
কদিন আগে গুম ও গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে সেনাবাহিনীর ১৫ জন অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মরত সিনিয়র কর্মকর্তাদের আইসিটি আদালতে নেওয়া হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে আনন্দ প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে জনমনে সামরিক বাহিনীর সার্বিক ভাবমূর্তির দুঃখজনক পতনের প্রমাণ মিলেছে। যেসব জেনারেল সাহেব এখন সেনাবাহিনী চালাচ্ছেন, তারা মন খারাপ না করে বরং জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসা কেন হারালেন তা নিয়ে খোলামনে ভাবনাচিন্তা করুন।
‘আমরা কেউ কিছু জানতাম না’-এই আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে বেরিয়ে এসে ভুল স্বীকার করুন। যা-ই হোক, নৈতিক বল ও জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলা, উদ্যমহীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা সাহস, পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা এবং দেশপ্রেম নিয়ে আগামী নির্বাচনে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে-এ নিয়ে আমি শঙ্কামুক্ত হতে পারছি না।
২. ফ্যাসিস্ট দোসরদের সহিংসতা : দিল্লির আশ্রয়ে থেকে শেখ হাসিনা এবং ভারতে পলাতক অন্যান্য ফ্যাসিস্ট রাজনীতিবিদ, পুলিশ, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা গত চৌদ্দ মাসে বাংলাদেশে সহিংসতা সৃষ্টি করে সরকারকে অকার্যকর করার জন্য সব ধরনের উপায়ে চেষ্টা করে চলেছে। দেশে অবস্থানরত তাদের সমর্থকরা কেবল যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে তা-ই নয়, তারা নিশ্চিতভাবে আসন্ন নির্বাচনও হয় ভন্ডুল কিংবা নিদেনপক্ষে প্রশ্নবিদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টাও চালাবে।
জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে এত বিপুল সংখ্যায় ফ্যাসিস্ট সরকারের চিহ্নিত সহযোগীদের নিরাপদে দেশ ত্যাগ করে ভারতে ঘাঁটি গাড়তে দেওয়াটা ইউনূস সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর এক বিশাল ব্যর্থতা। অহেতুক রক্তপাত এড়াতে শেখ হাসিনাকে ভারতে চালান করে দেওয়ার স্বপক্ষে নানা ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করা গেলেও, ফ্যাসিবাদের সহযোগী খুনি ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ এবং সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের এভাবে সীমান্ত পার করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বিরাট ঝুঁকি তৈরি করেছে।
দেড় দশকে দেশকে যারা ধ্বংস করেছে, তাদের শত্রুদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ যেসব ক্ষমতাবান করে দিয়েছেন, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক ও যুক্তিসংগত। অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন যে, সাম্প্রতিক সিরিজ অগ্নিকাণ্ডে উপরোক্ত পলাতক অপরাধীগোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের যোগসাজশ রয়েছে। তার ওপর প্রতিদিন নিত্যনতুন দাবিনামা নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী মাঠে নেমে সরকারকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলেছে। ড. ইউনূস বুঝতে পারছেন কি না জানি না, এসব বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা প্রতিরোধ করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে তার সরকারকে বিশেষভাবে বেগ পেতে হবে।
৩. প্রশাসনের অসহযোগিতা : শেখ হাসিনা সর্বব্যাপী দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান যে চরমভাবে কলুষিত ও অকার্যকর করে গেছেন, সে বিষয়ে প্রথমেই উল্লেখ করেছি। বর্তমান সরকার এক বছরে প্রশাসনকে কতখানি দলনিরপেক্ষ করতে সক্ষম হয়েছে তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তার ওপর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় একেবারে ‘নিজেদের লোক’ বসানো নিয়ে আগামী নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। বাংলাদেশের নির্বাচনি কালচার হলো, সব প্রার্থীই চান যেন জেলার ডিসি এবং এসপিরা তাদের কথা শুনে চলেন এবং থানার ওসি যেন নির্বাচনে কারচুপি করতে সহায়তা করেন।
একদিকে ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া অসৎ কর্মকর্তা; অন্যদিকে দলীয় ভাবধারায় কলুষিত প্রশাসনকে দিয়ে নির্বাচন কমিশন কোন জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে একটি নিরপেক্ষ ও বিতর্কহীন নির্বাচন করতে সক্ষম হবে, সেটা বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। পরিচিত অনেক উপদেষ্টা এবং সিনিয়র কর্মকর্তার কাছ থেকে রাজনৈতিক চাপের যেসব কাহিনি শুনি তাতে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত হই। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে আমলাতন্ত্র সম্ভাব্য বিজয়ী দলকে নির্বাচনের আগে থেকেই নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে খুশি রাখতে চায় যাতে নতুন সরকার গঠনের পর তাদের চাকরি করতে সুবিধা হয়। ড. ইউনূস তথাকথিত ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করার জন্য নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা তার সফলতা কামনা করি।
৪. আওয়ামী অঞ্চলে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা প্রদান : গোপালগঞ্জের কথাই ধরা যাক। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত শেখ পরিবারের দুর্গে অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা গেছে এমন দাবি সম্ভবত খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও করতে পারবেন না। গত বছর আগস্টের পর সেখানে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের কুপিয়ে হত্যা করেছে, সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে তাদের গাড়ি পোড়ানো হয়েছে, এনসিপির তরুণ নেতারা দেশব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে গোপালগঞ্জ সফরে গেলে পলাতক হাসিনার নির্দেশে তাদের হত্যা করার জন্য রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ও পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে এবং এসপি ও ডিসির অফিসসহ অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় একাধিকবার আগুন দেওয়া হয়েছে। শুধু গোপালগঞ্জেই নয়, পার্শ্ববর্তী আওয়ামী লীগ সমর্থিত জেলাতেও নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত বিরোধে হাজার হাজার মানুষ থানা আক্রমণ করে পুলিশের গাড়িতে আগুন দিয়ে এমন তাণ্ডব করেছে যে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন।
এসব পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে আগাম কোনো সতর্কবার্তা জানাতে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। গোপালগঞ্জের মতো কট্টর আওয়ামী সন্ত্রাসী অধ্যুষিত জেলার সংখ্যা অন্তত আধাডজনের কম হবে না বলেই আমার ধারণা। শেখ হাসিনা অবশ্যই ভারতীয় ডিপ স্টেটের সহায়তা নিয়ে বিশেষ করে এই জেলাগুলোতে নির্বাচন বানচালের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। আমি জানি না, সেসব জেলার সাধারণ মানুষ যাতে নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন এবং নির্বাচন চলাকালে সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে আয়ত্তে থাকে, তার জন্য নির্বাচন কমিশন এবং সরকার আদৌ কোনো আগাম পরিকল্পনা তৈরি করেছেন কি না। না করে থাকলে সময় কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
৫. গণভোট বনাম সংসদ নির্বাচন বিতর্ক : বেশ কয়েকদফা ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়িয়েও রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক বিষয়েই ঐকমত্যে আনা সম্ভব হয়নি। তবে দেরিতে হলেও শেষপর্যন্ত একটি গণভোটের ব্যাপারে তারা একমত হতে পেরেছেন। এখন সেই গণভোট কবে হবে, সে নিয়ে গোল বেধেছে। বিএনপি চাচ্ছে একই দিনে গণভোট এবং সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। অপরদিকে জামায়াতের দাবি আগে গণভোট, তারপর জাতীয় নির্বাচন।
পিআর নিয়ে জামায়াতের আরো একটি দাবি রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্তত আগামী নির্বাচনে নিম্নকক্ষে পিআরের পক্ষে নই। এটি একটি জটিল পদ্ধতি হওয়ায় বাংলাদেশের জনগণকে সেই নির্বাচনি ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত করতে অনেক তর্কবিতর্ক, ব্যাখ্যা ও প্রশিক্ষণের দরকার হবে। এর জন্য যে সময় প্রয়োজন তা আমাদের হাতে আপাতত নেই। কাজেই পিআরের দাবি থেকে জামায়াতের আর দেরি না করে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে আসা উচিত। তবে, জামায়াতের অন্য দাবি অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটকে আমি অধিক আইনসংগত মনে করি। সব বিবেচনায় গণভোট আগে হওয়াটাই সমীচীন ছিল। একই দিনে দুই ভিন্ন প্রকৃতির নির্বাচন হলে অনেক ভোটারই বিভ্রান্ত হতে পারেন।
তাদের দুই ব্যালটের পার্থক্য বোঝানো সহজ হবে না। সমস্যা হলো, ফেব্রুয়ারি আসতে আর মাত্র তিন মাস বাকি রয়েছে। এই তিন মাসের মধ্যে দুটি নির্বাচন করার মতো অবস্থা ও সংগতি রাষ্ট্রের নেই। আমার ধারণা, নির্বাচন কমিশনও এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত নয়। গণভোটের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রথমেই সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ব্যর্থতার দায় ঐকমত্য কমিশন এবং এক বছর ধরে দফায় দফায় মিটিং করে আসা সব রাজনৈতিক দলকে নিতে হবে। সমস্যা যেহেতু আপনারা তৈরি করেছেন, একটি বাস্তবসম্মত সমাধানও আপনাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।
৬. নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন : আমি বহুবার বলেছি এবং লিখেছি যে, আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা নির্বাচন ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই অসাধারণ নির্বাচনের পরও পরাজিত দল আওয়ামী লীগ জনগণের রায় মানতে চায়নি। আজন্ম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনা নিজে ঢাকার দুই আসনে সাদেক হোসেন খোকা এবং মেজর (অব.) মান্নানের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন।
এরপর হাসিনার পদত্যাগ নাটক, ড. কামাল হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার, ইত্যাকার ঘটনা আমরা দেখেছিলাম। সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা সদম্ভে বলেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে তিনি একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। ১৭৩ দিন হরতাল করে, সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে এবং অকাতরে মানুষ মেরে তিনি অক্ষরে অক্ষরে কথা রেখেছিলেন। আজকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া সেই সময় থাকলে জেন-জি শেখ হাসিনার নাম পাল্টে অশান্তি বেগম ভাইরাল করে দিত।
১৯৯১ সালের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সরকারের তুলনায় ‘ইন্টেরিমের’ মাথার ওপর বিপদের বোঝা অনেক বেশি ওজনদার। সুতরাং, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শেষে পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ তুলে দেশে যে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এর আগে একাধিক লেখায় ড. ইউনূসকে শুধু একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের এজেন্ডা নিয়ে দেশের বড় দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসার পরামর্শ দিলেও তিনি এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। সরকারকে পুনরায় সতর্ক করে বলছি যে, কোনো কারণে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে সেই ব্যর্থতার সম্পূর্ণ দায় প্রফেসর ইউনূসকেই নিতে হবে।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর এবং ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর দুইবার আমরা রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ নষ্ট করেছি। মহান জুলাই বিপ্লবে আমাদের সন্তানরা অকুতোভয়ে তাদের প্রাণের বিনিময়ে আবার নতুন করে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, কল্যাণমুখী, মানবিক এবং প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দিয়েছে। আশা করি, বর্তমান কালের প্রবীণ ও নবীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তৃতীয়বার জাতিকে হতাশ করবেন না।

বাংলাদেশের রাজনীতি এক অদ্ভুত মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দিন দিন আরো জটিল হয়ে উঠছে। নির্বাচন কমিশনের সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এখন নতুন করে নেড়ে দিয়েছে রাজনৈতিক মাঠ। সংশোধিত নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে জোটের প্রার্থীরা আর প্রধান দলের প্রতীকে ভোট করতে পার
৬ ঘণ্টা আগে
উচ্চাঙ্গসংগীত—উপমহাদেশের সংগীত ঐতিহ্যের এক মহার্ঘ শাখা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা বা তরানা রীতি পরিবেশিত হয়ে এসেছে হিন্দি ও উর্দু ভাষায়। দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, বেনারস বা পাটনার মঞ্চে রাতের পর রাত শ্রোতারা মুগ্ধ হয়েছেন ওস্তাদদের সুরলহরিতে। বাংলা ভাষা, যেন এই ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে শুধু শ্রোত
৭ ঘণ্টা আগে
আয়নাঘরে আট বছর কাটিয়ে মায়ের কোলে ফিরে এসেছেন ভাগ্যবান আরমান। একইভাবে, একই সময়, আয়নাঘরে কাটিয়ে ঘরে ফিরলেও, রেখে যাওয়া মাকে জীবিত পাননি ব্রিগেডিয়ার আমান আজমী। যতদিন জীবিত থাকবেন, এই কষ্ট তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। কষ্টের অনেক পরত বা স্তর রয়েছে। পরের পরত থেকে আগের পরতকে তাই ভাগ্যবান মনে হয়।
৭ ঘণ্টা আগে
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তথাকথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তথা সেক্যুলারিজমের নামে সমাজকে বিভাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। কোথাও স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ ছিল না। স্বৈরাচারের পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত না হলে চাকরি পাওয়া যেত
১ দিন আগে