জুলাই বিপ্লব ও প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায়

শাহীদ কামরুল
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ৩৯

মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের ওপর অনন্ত মালিকানা দাবি করে গণতন্ত্রকে সামন্ততন্ত্রে পরিণত করার চর্চা হয়েছে দেশে ১৬ বছর ধরে হাসিনার শাসনামলে। তবে ছাত্রদের জুলাই বিপ্লব ইতোমধ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে, ওই যুগটির ইতি ঘটেছে এবং আমরা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছি।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগ তার ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য রাষ্ট্রের পেয়াদা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত প্রশাসনের সব স্তরে দলীয় চাটুকার সেট আপ করেছিল, তৈরি করেছিল অনেক ন্যারেটিভ। যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি, রাজাকার ইস্যু। তারা ভেবেছিল এই শাসনের কখনো বিলোপ ঘটবে না। আওয়ামী লীগ সরকার রাজাকার ইস্যুটা রাখছেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভের লেন্স ঠিক রাখতে। এটা ছিল একটা চশমা, যা তারা সেট করেছিল জনগণের সামনে।

এই বিষয়টি অ্যান্তনীয় গ্রামসির ‘Theory of Cultural Hegemony’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যাতে তিনি বলেন, শাসকশ্রেণি কেবল শক্তির মাধ্যমে নয়, বরং Ideology ও Discourse নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের আধিপত্য বজায় রাখে।

আদতে তারা গোটা জাতির মধ্যে একটা ডুয়ালিজম সৃষ্টি করেছিল এবং মানুষের মধ্যে বিভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ ও ঘৃণা প্রভৃতির চাষাবাদ করতে লাগল, গোটা দেশটাকে দুভাগ করে দিল—মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও বিপক্ষের শক্তি। অর্থাৎ যে আওয়ামী লীগ করবে, সে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তি; আর আওয়ামী লীগ না করলে সে হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী, স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী।

আওয়ামী লীগ না করলে সে যদি মুক্তিযোদ্ধাও হয় বা সেক্টর কমান্ডারও হয়, তবু সে রাজাকার, দেশের শত্রু। সুতরাং তাকে মারা, পেটানো, নানা রকম অত্যাচার ও হয়রানি করা—সবকিছু বৈধ। এভাবেই বাকশালি আওয়ামী সরকার দেশটা চালিয়ে আসছিল।

আসলে আমরা যদি একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই তা হলে আমরা দেখব, পৃথিবীর সব ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরশাসক রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য বা তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এভাবে কিছু বয়ান তৈরি করত, যা হচ্ছে তার ক্ষমতার মূল ভিত্তি। আসলে ফ্যাসিবাদ সমাজকে মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য হিটলার কিংবা মুসোলিনির মতো বিশাল ‘মহানায়ক’ বানায়; বিস্তর মিথ্যা কেচ্ছা ও বয়ান তৈরি করে এবং ইতিহাসবিকৃতি ঘটায়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট বিরাট ছবি ও ম্যুরাল পথেঘাটে, এয়ারপোর্টে ও অফিস-আদালতে ভরিয়ে ফেলা দেখেও ফ্যাসিবাদের কায়কারবার আপনি বুঝতে পারেন। এ ব্যাপারে জগদ্‌বিখ্যাত দার্শনিক

মিসেল ফুকুর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, পৃথিবীতে সর্বজনীন সত্য বলে কিছু নেই; Truth is an effect of power. বিভিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো ডমিনেন্ট ডিসকোর্স তৈরি করে; পরে এটাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয় এবং এটাকে প্রতিষ্ঠিত করে তাদের ক্ষমতা স্থায়ী করার চেষ্টা করে, যেমনটা করেছে আওয়ামী লীগ ১৬ বছর ধরে।

অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব হঠাৎ করে ঘটে গেছে। আসলে কথাটি সঠিক নয়। জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেন, বিপ্লব কখনো হঠাৎ করে ঘটে না, এর জন্য একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি দরকার হয়। আসলে বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই একটা বিপ্লবের মাঠ হিসেবে প্রস্তুত হয়ে ছিল, যা প্রকাশ পেয়েছে ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই।

আমরা দেখেছি কীভাবে গণআন্দোলন ও গণসংগ্রাম গণশক্তিতে রূপ নেয়, যার ধ্রুপদী পূর্বানুবৃত্তি আমরা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ও দেখেছি। জাতি দেখেছে, কীভাবে শত চেষ্টা করেও বাকশালি আওয়ামী সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। ক্ষমতা চলে এসেছিল ছাত্র-জনতার কাছে ঢাকার রাজপথে। কারণ পতিত সরকারের প্রতিপক্ষ এবার কিন্তু ২০১৮ সালের আন্দোলনকারী কিংবা বিএনপি-জামায়াত নয়; বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সাহসী ছিল ২০২৪ সালের নতুন জেনারেশন। তবে এই জেনারেশনের শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন করে অনেক পরিপক্ব হয়েছে এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেছে, যার কারণে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে অকপটে জীবন দিয়েছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আমরা এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নই, আমরা নৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছি। তার কথায় পরিষ্কার—ছাত্ররা সরকার পতন করতে পারবে কি পারবে না, তারা এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। তারা অপেক্ষা করছিলেন ছাত্ররা কোন পর্যায় পর্যন্ত আন্দোলনটাকে নিতে পারে; যদি সফল হয় তখন ছাত্রদের পক্ষে আসবে, আর যদি সফল না হয় তা হলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে যাবে না, বা আন্দোলনে শরিক হবে না।

আদতে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ক্ষমতায় থাকার মূল যুক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা ছাড়া জনগণকে তাদের স্বাভাবিক জীবনে চলতে দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। তখন এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারবে না।

পৃথিবীতে অনেক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে, যেমন ১৭৭৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, ১৭৭৬ সালের আমেরিকান বিপ্লব, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ও ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব। বাংলাদেশেও কয়েকটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, তবে এবারের গণঅভ্যুত্থানটি একটু ব্যতিক্রম। কারণ এবারের গণঅভ্যুত্থান কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি, হয়েছে ছাত্রদের নেতৃত্বে।

একইভাবে দেশের বাইরে পৃথিবীর যেখানেই বাংলাদেশিরা আছেন, তারা এবারের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার বাংলাদেশি সম্প্রদায় অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ করেছেন অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়ে এবং ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রের বিভিন্ন নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তি এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো, বিশেষ করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো যারা গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করে থাকে, তাদের সঙ্গে ডায়াসপোরা কমিউনিটি সার্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করেছে এবং বাংলাদেশে কী হচ্ছে, কী ঘটছে সবকিছু তুলে ধরেছে। আর সরকার যখন পুরা দেশকে ব্ল্যাক আউট করে দিল তখন এ ডায়াসপোরা কমিউনিটি তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে দেশের জন্য, ছাত্র-জনতাকে রক্ষা করার জন্য এবং ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রে নিজেরা আন্দোলনে শরিক হয়েছে, বিক্ষোভ করেছে এবং বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে খবরগুলো প্রদান করেছে। সত্যিই এটি ছিল একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য। ভিনদেশে থেকেও নিজের দেশের জন্য তাদের এই দরদ ও চেষ্টা বিশ্বে নজির স্থাপন করেছে। এটা ছিল বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ‘Long-Distance Nationalism’ ধারণার প্রতিধ্বনি, যেখানে ডায়াস্পোরিক সম্প্রদায়গুলো তাদের স্বদেশের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে জড়িত থাকে। নির্বাসিত অ্যাক্টিভিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠেন, যা বিশ্ব রাষ্ট্রের নৃশংস দমন-পীড়নের সাক্ষ্য দেয়। তাদের সম্পৃক্ততা বিপ্লবকে একটি বৈশ্বিক মাত্রা দিয়েছে, যা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে জাতীয় সীমানার মধ্যে সংকটকে ধারণ করা অসম্ভব করে তুলেছে। আন্দোলনের শেষ তিন দিন অনেক প্রবাসী চাকরি, অফিস গমন ও কাজকর্ম বন্ধ রেখে সার্বক্ষণিকভাবে দেশের খবর জানার চেষ্টা করেছেন, দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। অনেকে বিদেশে বসে প্রবাসীদের সংগঠিত করার কাজ করেছেন, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও কর্মসূচির আয়োজন করেছেন এবং অংশ নিয়েছেন। নিজ নিজ দেশের সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও রাজনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাদের অবহিত করেছেন দেশের পরিস্থিতি। আমিও ছিলাম তাদের একজন। আমি জার্মানির অনেক কর্মসূচির আয়োজন করে তাতে অংশ নিয়েছি। জার্মানির চারটি মন্ত্রণালয়ের চার মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে একটা নিন্দা আদায়ের চেষ্টা করেছি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পরিচিত সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে অবহিত করেছি বাংলাদেশের বিষয়ে।

সত্যিই এটা ছিল মনে রাখার ও গৌরব করার মতো একটা ঘটনা। দেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রবাসীদের অবদান কোনোদিন লিখে শেষ করা যাবে না। দেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করার যে আনন্দ তারা অনুভব করেছে, তাও প্রকাশ করার কোনো ভাষা জানা নেই আমাদের। বাংলাদেশের এই স্মরণকালের অভূতপূর্ব ঘটনা এবং ছাত্র-জনতার এই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে অংশ নিতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত ও গর্বিত প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইবোনেরা।

আদতে আমরা এক নতুন ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। জনগণ যেভাবে তরুণদের ডাকে রাস্তায় চলে এসেছে, সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছে এবং অকাতরে শহীদ হয়েছে, তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার—গণচেতনা, বৈপ্লবিক সংকল্প ও নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির সম্ভাবনার দিক থেকে বাংলাদেশ প্রায় একশ বছর এগিয়ে গেছে। পুরোনো, প্রাচীন ও পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করা এখন আর সহজ হবে না।

কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকাশের মঞ্চে যুগপৎভাবে বদলেছে মানুষের জীবনধারণ ও দৃষ্টিভঙ্গি। পুরোনো জায়গায় নতুনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রগতিশীলতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ঐতিহ্যের ভিত্তিপ্রস্তরে।

আমরা প্রবাসী সম্প্রদায় আগামীতে এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে আর কোনো মায়ের আর্তনাদ, কোনো বোনের দীর্ঘশ্বাস বা কোনো বিধবার আহাজারি কোনোকিছুই থাকবে না। যেখানে মানুষের নিরাপত্তা থাকবে, মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে এবং একটু ভালোভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি থাকবে।

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক; গবেষণারত : ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত