আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

রাজনৈতিক সুশাসন কতদূর

ড. শাফিউল ইসলাম

রাজনৈতিক সুশাসন কতদূর

আজকাল সুশাসন একটি খুবই পরিচিত প্রত্যয়। সবখানেই এর প্রয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ও রাজনৈতিক সুশাসন খুবই প্রয়োজনীয় অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে চব্বিশের জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সুশাসনের বিষয়টি আরো জোরেশোরে সামনে এসেছে।

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে বিকশিত ‘জুলাই বিপ্লব’ ছিল মূলত কর্তৃত্ববাদবিরোধী এবং গণতান্ত্রিক সুশাসনের দাবিতে সংগঠিত এক গণঅভ্যুত্থান, যা ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও পলায়নের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক পর্বের সূচনা করে। এই প্রেক্ষাপটে ২৪ জুলাইকে সাধারণত চূড়ান্ত সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং নাগরিক প্রতিরোধের এক টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা পরে রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক সুশাসনের ভিত্তি রচনা করে।

বিজ্ঞাপন

রাজনৈতিক সুশাসন বলতে সাধারণভাবে বোঝায়—স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, আইনের শাসন, মানবাধিকার রক্ষা, অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় সেবা-প্রদানের সমন্বিত কাঠামো। আবার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সুশাসনের উপাদানগুলোও যেন রাজনৈতিক সুশাসনের অঙ্গ। এই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সুশাসনের উপাদানগুলোকে (অংশগ্রহণমূলক, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, রেসপনসিভনেস, ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা এবং কার্যকারিতা ও দক্ষতাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা) যদি আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সুশাসন পরিমাপ করার নিক্তিতে তুলি, তাহলে সুশাসনের পরিবর্তে দুঃশাসনের পাল্লায় বেশি ভারী হবে। বলা যায়, রাজনৈতিক সুশাসনের অভাবেই দেশে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের ঘটনা ঘটেছে। সুশাসনের উপাদানগুলো রাজনৈতিক সুশাসনের নিরিখে বিশ্লেষণ করলে, বিগত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রায় ১৬ বছরের শাসনকালকে ‘রাজনৈতিক দুঃশাসনের’ কাল হিসেবে বিবেচনা করার পর্যাপ্ত উপাদন পাওয়া যায়।

যাই হোক, জুলাই বিপ্লবের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও নাগরিক সমাজের মধ্যে এক ধরনের ন্যূনতম ঐক্য গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এই ঐক্য, ফ্যাসিস্ট চরিত্রের আধিপত্যবাদী সরকারের পতনের কয়েক মাসের মধ্যেই ভেঙে যায়। দলগুলো নিজেদের স্বার্থে আবার নিজ মেরুতে ফিরতে থাকে। বিশেষভাবে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ হিসেবে আন্দোলনের ফসল ভোগ করতে চাইলেও, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও নতুন উদীয়মান নাগরিক প্ল্যাটফর্মগুলো রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর জোর দিতে থাকে, যা রাজনৈতিক সমঝোতার পরিসরকে সীমিত করে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সুশাসনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা খুবই জরুরি। এছাড়া আরো প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত ঐকমত্য। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অস্থায়ী স্বার্থ, প্রতিশোধÑমনোভাব ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক আলোচনার প্রবণতা প্রাধান্য পাওয়ায় স্থায়ী নীতিনির্ভরতা গড়ে উঠতে পারেনি এবং বর্তমানেও পারছে না। এর ফলে নির্বাচনব্যবস্থা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সাংবিধানিক সংস্কারের মতো মৌলিক ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য গঠন কঠিন হয়ে পড়ছে, যা সুশাসনের অর্জনের পথকে সীমিত করে ফেলে।

এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, চব্বিশের বর্ষা বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করার একটি মহাসুযোগ আমরা পেয়েছি। কিন্তু এটি কি কাজে লাগাতে পারছে রাজনৈতিক দলগুলো? বা কাজে লাগানোর কোনো চেষ্টা করেছে অথবা করছে? গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করেই যে কেউ বলে দিতে পারেÑরাজনৈতিক দলগুলো সে পথে হাঁটেনি। অর্থাৎ রাজনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তেমন কোনো গরজ দেখা যায়নি। বরং দু-একটি দল বাদে বাকি সব দলই পুরোনো রীতিতেই চলছে। বরং বলা যায়, রাজনৈতিক সুশাসন আংশিকভাবে অগ্রসর হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলেও তা এখনো নাজুক, বিতর্কিত এবং অসম্পূর্ণ রূপে বিদ্যমান। গণতান্ত্রিক জবাবদিহি, মানবাধিকার ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা গেলেও, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী জন-আকাঙ্ক্ষা—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, সমঝোতামূলক, দায়িত্বশীল ও সহিষ্ণুতামূলক রাজনীতির চর্চা দেখা যাচ্ছে না। বরং সব ক্ষেত্রেই এর ঘাটতি লক্ষণীয়। এই ঘাটতি শুধু রাজনৈতিক সুশাসনকে নয়; পুরো দেশের শাসনব্যবস্থার মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়। যার উদাহরণ বিপ্লব-পরবর্তী সময়েও দেখা যায়।

এখনো শোনা যায়, ‘এরা তো শিবির স্যার, আমাদের এখানে নতুন কিছু ফোর্স লাগবে।’ (দেশ রূপান্তর, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫) রাজনৈতিক বিশ্লেষক, একাডেমিক ও গবেষকরা মনে করেন, এ রকম ‘ট্যাগিং’ পুলিশ প্রশাসনসহ আমলাতন্ত্রের অন্যান্য শাখাতে ‘রাজনৈতিক দুঃশাসনের’ সময়ে দেখা যেত। তা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসহিষ্ণু আচরণ দেখা যাচ্ছে। আন্তঃকোন্দলে খুনোখুনি, বিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিকভাবে সুস্থাধারায় মোকাবিলা না করে হামলা-খুনের মতো ঘটনা এখনো পত্রপত্রিকায় হরহামেশাই প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলো রাজনৈতিক সুশাসনের অনুপস্থিতির উদাহরণ। আরো পরিতাপের বিষয় হলোÑবাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর পরিচালন (শাসন) ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, ‘খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপি, শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগ আর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে তার বংশধর ছাড়া জাতীয় পার্টি চলবে না’—এমন ব্যবস্থা। বংশ পরম্পরা এমন রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা কখনো রাজনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এই দলের মধ্যে এমন নজির দেখা যায় না। জুলাইযোদ্ধাদের নিয়ে সদ্য গঠিত এনসিপিকে নিয়ে এখনো মূল্যায়নের মতো তেমন কিছু আসেনি। তবে তাদের দলের মূল্যায়নের উপাদান (সুশাসনের উপাদানগুলো বিবেচনায় নিয়ে) তারা তৈরি করতে পারত। সেটি তারা পারেননি। তবে তারা শুরুতেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সমকামিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে/দের দলীয় পদ-পদবি প্রদান, চাঁদাবাজির অভিযোগ, আন্তঃকোন্দল ইত্যাদি কারণে দলটি দেশের তরুণ সমাজ তথা প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বাইরে নতুনত্ব কিছু দিতে পারেনি। বরং পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতিই তাদের শিরায়-উপশিরায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। এমতাবস্থায় ভবিষ্যতে দেশে এই দলের ‘একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল’র মতো হয়ে উঠতে না পারার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, একাডেমিক ও গবেষকরা এখন থেকেই তাদের এই অভিমত নানা সময়ে নানাভাবে প্রকাশ করছে।

অন্যদিকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের চোরা-গুপ্তা জঙ্গি মিছিল আর নাশকতা সৃষ্টির জন্য গণপরিবহনে আগুন লাগানো-বোমাবাজির কর্মকাণ্ডও রাজনৈতিক সুশাসনেরই অভাব হিসেবে বিবেচিত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে অফিশিয়ালি কার্যক্রম নিষিদ্ধ না থাকলেও সেই সময়ের সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্রশিবিরের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একপ্রকার নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। তাদের রাজনৈতিক কার্যালয়গুলোও বন্ধ রেখেছিল। শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। আওয়ামী লীগ যদি তাদের শাসনামলে রাজনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা কিংবা সুষ্ঠুধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চর্চা করার সুযোগ দিত; তাহলে আজকের পরিণতি তাদের ভোগ করতে হতো না। রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এই অপমৃত্যুর জন্যÑরাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, একাডেমিক, গবেষক এমনকি সাধারণ জনগণও আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করছে। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বাকশাল’ কায়েমের মতো আজকের ‘রাজনৈতিক দুঃশাসন’ কায়েমের প্রবক্তা হিসেবে শেখ হাসিনাকেই সবাই দায়ি করছে।

প্রকৃতপক্ষে, দু-একটি বাদে এই দেশের সব বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চার ব্যাপক ঘাটতি দেখা যায়। যার ফলে, রাজনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়নি। বড় দুটি রাজনৈতিক দল ‘পরিবার-তান্ত্রিক’ এই তকমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। যেমন : উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের কথা বলা যায়। মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে তার সরকারের গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তিনি এখন পলাতক। বর্তমানে তিনি ভারতের মোদি সরকারের আশ্রিত অতিথি হিসেবে রয়েছেন। তার অবর্তমানে তার দলের অবস্থা এখন নাজুক বললে কমই বলা হবে। দলের নেতৃস্থানীয় সবাই এখন হয় পলাতক, না হয় কারাগারে। প্রাচীন এই দলের এমন পরিস্থিতির জন্য এই দলের নেতাদেরই দায়ী বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। এই দলের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারÑএমন মন্তব্যও চারদিকে শোনা যায়। এরূপ হওয়ার কারণই হচ্ছেÑদলের মধ্যে সুশাসনের ঘাটতি বা অভাব। অন্যদিকে, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’র কথা বলা যাক। এই দলের আমির (দলের প্রধান) ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ (সাধারণ সম্পাদক) শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘ফাঁসি’ দিয়ে আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। সেই দলটি তছনছ হয়নি। নেতৃত্বহীনও হয়নি। ছন্নছাড়াও হয়নি। জেল-জুলুমের হুলিয়া মাথায় নিয়ে নতুন নেতৃত্ব সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। ভয়ে হারিয়ে যায়নি। পালিয়ে থেকেছে কিন্তু দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। তাই অভিজ্ঞ মহল মনে করে, এই দলের মধ্যে ‘রাজনৈতিক সুশাসনের ঐক্য’ একটি বড় শক্তি হিসেবে কাজ করে। এই দলেও ভাঙনের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেটি বড় আকার ধারণ করতে পারেনি। নিপীড়িত এ-দলই এখন দেশের ক্ষমতার মসনদের কাছাকাছি। বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমানে বিএনপির কী অবস্থা হবেÑএখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন হলেও অনুমান করা যায় দলের মধ্যে ভাঙন ধরবে। এ জন্য দেশি-বিদেশি শক্তির প্রভাব থাকবে। বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমানেই সাইফুর রহমান-মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বিএনপির ভাঙন আমরা অবলোকন করেছি। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও বিএনপিকে ভাঙনের মুখে নিয়ে গিয়েছিল। শমসের মোবিন চৌধুরী-তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বেও বিএনপির ভাঙনের চেষ্টা আমরা দেখেছি। এর কারণ কী? উত্তর রাজনৈতিক সুশাসনের অভাব। জাতীয় পার্টি তো ভাঙা-গড়ার দল হিসেবে পরিচিত। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশাতেই এই দল শতধাবিভক্তে বিভক্ত ছিল। এখনো আছে। এসবের কারণ একটিইÑদলের মধ্যে সুশাসনের অভাব। এছাড়া অন্যান্য ছোটখাটো রাজনৈতিক দল যেমনÑগণফোরাম, গণ অধিকার পরিষদসহ বাম কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে রাজনৈতিক সুশাসনের চর্চা কিছুটা দেখা গেলেও সেগুলোর ব্যক্তিনির্ভরতার বাইরে সেভাবে বেরিয়ে আসতে পারেনি। পারবে বলেও তেমন মনে হয় না। অভিজ্ঞ মহল এমনটিই মনে করেন।

রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে এখনো প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীতে পুরোনো প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট ধারা বহুলাংশে অটুট রয়েছে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি এখনো বিদ্যমান। এসব কু-সংস্কৃতি ভাঙা তো যায়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিমাত্রায় রূপ নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তাহলে কি রাজনৈতিক সুশাসনের রূপান্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই? অবশ্যই আছে। এ জন্য দরকার সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। উচ্চশিক্ষিত, সৎ চরিত্রবান ও দুর্নীতির অভিযোগমুক্ত রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে আসতে হবে। অন্যদিকে, জনগণের মতামতও এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে সচেতন হতে হবে। রাজনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর জনমতের চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সুশাসনের রূপান্তর ত্বরান্বিত করতে কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শাসনব্যবস্থা, প্রশাসন কাঠামোর সংস্কার ও রাজনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহীত এসব উদ্যোগ আসন্ন গণভোটের মাধ্যমে বাস্তবায়নের সুযোগ জনগণকেই নিতে হবে। জনমতের প্রতিফলন এখানেই ঘটানো সম্ভব। জনগণ এভাবে রাজনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যৎ ক্ষমতার জবাবদিহিমূলক কাঠামো তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, চব্বিশের জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক সুশাসনের যাত্রা শুরু হয়েছে, কিন্তু তা এখনো রূপান্তরের মাঝপথে অবস্থান করছে। একদিকে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার বিরুদ্ধে গণ-উত্থান, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রাথমিক সংস্কার, মানবাধিকার ও নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্মূল্যায়ন—এসব সুশাসনের দিকে অগ্রগতির সূচক। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিভাজন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও নিরাপত্তা খাতের অপব্যবহার প্রবণতা—সুশাসনের পূর্ণ বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। সুতরাং গণতান্ত্রিক সংকট উত্তরণে চব্বিশের বর্ষা বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক সুশাসন কতটা অর্জিত হলো—এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায়—সুশাসনের দিকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু আংশিক অগ্রগতি হয়েছে; এই অগ্রগতিকে স্থায়ী ও গভীর করতে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সমঝোতা, কার্যকর সংবিধান সংশোধন, নিরাপত্তা খাতের গভীর সংস্কার এবং দুর্নীতিবিরোধী বাস্তববাদী পদক্ষেপ অপরিহার্য।

লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন