একটি কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো প্রাইমারি হেলথ কেয়ার। এই স্তরটি শক্তিশালী না হলে উন্নত সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি সেবাও টেকসই হয় না। স্বাস্থ্যসেবা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকার বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশ আজ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঘিরে নানা অভিযোগ ও অনুযোগ রয়েছে, তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে এ খাতে দৃশ্যমান উন্নতি ঘটছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও স্বাস্থ্যসেবা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
বর্তমান সরকার সরকারি ও বেসরকারি উভয়পর্যায়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। এরই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে সারা দেশের ঘনবসতিপূর্ণ সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোয় প্রতি এক থেকে দুই লাখ জনসংখ্যার জন্য একটি করে ‘প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ও নিউট্রিশন সেন্টার’ স্থাপন করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, এটি সময়োপযোগী এবং একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ।
তবে বাস্তবে প্রতিটি পদক্ষেপই সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় শতভাগ পৌঁছে দেওয়া সহজ নয়। আমরা স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিগত প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে যা উপলব্ধি করেছি, তার একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। আমাদের বিশ্বাস, এই অভিজ্ঞতা সরকার ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার জন্য সহায়ক হবে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের বিবরণ ও স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির সুযোগ
নগরবাসী স্বল্প আয়ের জনসাধারণের কাছে সরাসরি স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ও নিউট্রিশন সেন্টার স্থাপন করা যেতে পারে। কৌশলগতভাবে সেন্টারগুলোর অবস্থান নির্ধারণে শহরে বসবাসকারী দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসস্থল হতে সবচেয়ে কাছাকাছি এবং সুবিধাজনক স্থানগুলো প্রাধান্য পাবে।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দুটি শিফটে হেলথ সেন্টারগুলো চালু থাকবে। তবে, সার্বক্ষণিক সেবা দেওয়া লক্ষ্যে কিছুসংখ্যক প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টার ২৪ ঘণ্টা চালু থাকবে।
প্রতিটি সেন্টারে স্বাস্থ্যসেবায় থাকবেন দুজন এমবিবিএস চিকিৎসক, দুজন নার্স, দুজন ফার্মাসিস্ট, একজন পুষ্টিবিদ, একজন প্যারামেডিকস কাম রেডিওগ্রাফার এবং একজন অভ্যর্থনাকারী কাম সহায়ক। এছাড়া, কিছুসংখ্যক প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টার সম্পূর্ণভাবে নারীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।
প্রতিটি হেলথ কেয়ার সেন্টারের আওতাধীন জনগোষ্ঠীদের বিভিন্নভাবে এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটিভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করা যেতে পারে। নিয়মিত কমিউনিটির পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি, যেকোনো রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় (যেমন : কোভিড-১৯, ডেঙ্গু) অথবা অন্যান্য জরুরি অবস্থা, যেমন—বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা কিংবা শিল্প দুর্ঘটনার সময় স্বেচ্ছাসেবকরা যাতে জরুরি দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেই লক্ষ্যে তাদের দক্ষ করা হবে।
রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসাসেবায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সংযোজন
সেন্টারগুলো প্রয়োজনীয় সব উপকরণ দ্বারা এমনভাবে গড়ে তোলা হবে, যাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পুরোটাই এখানে সেবাপ্রার্থীরা পেতে পারেন। রোগ শনাক্তকরণের লক্ষ্যে এক্সরে ও ইসিজিসহ (ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম) কিছু প্রাথমিক ল্যাব টেস্টের সুবিধা সংযোজন করা হবে। এখানে পাওয়া যাবে হোম কেয়ারের জন্য স্মার্ট ডিজিটাল ওয়্যারেবল প্রাইমারি কিট, যা দ্বারা সহজেই রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণয়, শরীরের তাপমাত্রা যাচাইকরণ, উচ্চতা ও ওজন পরিমাপ করা সম্ভব হবে। তাপমাত্রা-সংবেদনশীল ওষুধগুলো নিরাপদে সংরক্ষণের জন্য ফার্মেসি-রেফ্রিজারেটরের ব্যবস্থাও রাখা হবে সব সেন্টারে।
সেন্টারগুলোয় আরো কিছু সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যেমন : চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে অপেক্ষারত রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা থাকবে। জরুরি সেবাপ্রার্থী এবং দুর্ঘটনার শিকার রোগীদের জন্য পর্যবেক্ষণ-শয্যার ব্যবস্থাও থাকবে।
সেন্টারগুলোর ডিজিটাল সরঞ্জাম এবং বিশেষায়িত সুবিধাগুলো
সেন্টারের পেশেন্ট কাউন্টারগুলো দক্ষভাবে পরিচালনার স্বার্থে ট্যাবলেট পিসি এবং পয়েন্ট অব সেল মেশিন থাকবে। ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ড (ইএমআর), প্রেসক্রিপশন এবং সুপারিশপত্র বিশেষায়িত সফটওয়্যারের মাধ্যমে সমন্বয় করা হবে। প্রতিদিনের কার্যক্রমকে নির্ভুল পরিচালনার স্বার্থে ইআরপি সিস্টেম তৈরি করা হবে। এছাড়া, সব ধরনের পূর্ব-তথ্য বা রেকর্ড সংরক্ষণ করতে কেন্দ্রীয় ক্লাউড পরিষেবা করা হবে।
সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য অ্যাম্বুলেন্স এবং মোটরসাইকেল বরাদ্দ দেওয়া হবে, যেগুলো রোগী ও রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত রোগীর নমুনা জরুরি পরিবহনে নিয়োজিত থাকবে। প্রাইমারি সেন্টারে আসা ডায়ালাইসিস চাহিদাসম্পন্ন রোগীদের কথা মাথায় রেখে জনমিতি অনুযায়ী কিছুসংখ্যক ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করা হবে। প্রতিটি সিটি করপোরেশন এলাকায় আলট্রাসনোগ্রাফির সুবিধাসম্পন্ন উন্নত ও পূর্ণাঙ্গ রোগ-নির্ণয় ল্যাব স্থাপন করা হবে।
প্রায় দুই কোটি মানুষের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সূচনা
প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ও নিউট্রিশন সেন্টার হবে স্বল্প ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের ব্যক্তিগত এবং পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির প্রথম মাধ্যম। এটি এমনভাবে গড়ে তোলা হবে, যাতে তারা জীবনব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারে। লক্ষ্য হবে সিটি করপোরেশনজুড়ে বসবাসরত দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের প্রায় দুই কোটি মানুষকে এই সেবার অধীনে নিয়ে আসা। এখানে যে সেবাগুলো পাওয়া যাবে, তার মধ্যে প্রধানত থাকবে—বিভিন্ন জরুরি সেবা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং স্ক্রিনিং, সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা ও যেকোনো আঘাতের চিকিৎসা, গর্ভকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ গর্ভবতী মা ও শিশুর যত্ন। আরো থাকবে, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা যেমন—টিকা প্রদান, পুষ্টিবিষয়ক পরামর্শ, ক্লাস্টারভিত্তিক ডায়ালাইসিস সেবা প্রভৃতি। পাশাপাশি রোগীর যাবতীয় ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ড একটি ইউনিক হেলথ আইডি কার্ডের মাধ্যমে এনআইডির সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
একই ছাদের নিচে সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা!
প্রতিটি প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ও নিউট্রিশন সেন্টার (পিএইচসি) এমনভাবে সজ্জিত হবে, যেখানে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার রোগীকে সেবা দেওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে। রোগীদের দ্রুত সেবা প্রদানে এআইনির্ভর ট্রায়াজ ব্যবহার করা হবে। দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের সেলাই এবং ড্রেসিংসহ জরুরিভিত্তিক সব চিকিৎসার ক্ষেত্রে সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। বাজারমূল্যের অর্ধেক দামে সরকার নির্ধারিত ওষুধগুলো জেনেরিক নামে প্রাপ্তির সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া কিছু বিশেষায়িত কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। যেগুলোর আওতায় থাকবে অসংক্রামক ব্যাধি, যেমনÑঅ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, পিঠে ব্যথা, ভিটামিন ডি ঘাটতি এবং থাইরয়েড রোগের সেবা। গর্ভকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ মা ও শিশুর প্রয়োজনীয় সেবাও দেওয়া হবে। ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী, গর্ভবতী নারীসহ সুস্থ নারীরাও যেন নিয়মিত বিরতিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারেন, সেই সুব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ঘরে বসেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ এবং ক্লাস্টারভিত্তিক ডায়ালাইসিস সেবারও ব্যবস্থা করা হবে। সঠিক পুষ্টি, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন এবং রোগীদের উন্নতমানের চিকিৎসা নিশ্চিতকরণে পরামর্শ প্রদানসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এছাড়া সেন্টারগুলো জটিল রোগে আক্রান্তদের বড় হাসপাতালে পাঠানোর রেফারেল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।
যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেই অর্জিত হবে প্রত্যাশিত ফল!
প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনবে। প্রায় দুই কোটি নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষের জন্য এটি হবে অত্যন্ত ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। এর ফলে সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র অনেকটাই বদলে যাবে। নির্ধারিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার অধিকাংশ চাহিদা এই সেন্টারেগুলোর মাধ্যমে পূরণ হবে। সঠিক সময়ে সুচিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং সচেতনতা কার্যক্রম ও নিয়মিত স্ক্রিনিং রোগপ্রতিরোধে সহায়ক হবে। এতে অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্য জটিলতা কমবে। সর্বোপরি, প্রাইমারি হেলথ কেয়ার (পিএইচসি) কর্মসূচিটি সবার জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বা ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) অর্জনে সরকারের প্রচেষ্টাকে আরো ত্বরান্বিত করবে।
ব্যবস্হাপনা পরিচালক , ল্যাব এইড

