আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষা ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লড়াই অনেক পুরোনো। মেসোপটেমীয় এলাকা থেকে আমাদের সেমিটিকদের পূর্বপুরুষেরা বালুচিস্তানের পথ বেয়ে এই উপমহাদেশের সিন্ধু অববাহিকায় প্রথম বসতি গড়েন। তারা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর মতো সভ্যতা নির্মাণ করেন। ক্রমে গঙ্গা অববাহিকায়ও তাদের সভ্যতার বিস্তার ঘটে।
মিসরে ইউসুফ (আ.)-এর নবুয়তের সময় পারস্যে জরদাশত বা জরাথুস্ট্রের একত্ববাদী সমর্থকদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে শেষে বহুত্ববাদী প্রকৃতি পূজারী আর্যদের একটি অংশ পামির মালভূমি পার হয়ে সিন্ধু অববাহিকায় আসে। তারা মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাসহ সেমিটিকদের ৮০টি পুর বা শহর বিনাশ করে ‘পুরন্দর’ বা ‘পুর বিনাশী’ নামে পরিচিত হয়। তারা পাঞ্জাব থেকে বেনারস পর্যন্ত এলাকা দখল করে এই এলাকাকে ‘আর্যাবর্ত’ বা আর্যদেশ ঘোষণা করে। এ আর্যদের হাতে সেমিটিক দ্রাবিড় সভ্যতার বিনাশকে গোপাল হালদার ‘অর্ধ সভ্যের হাতে গৃহস্থের পরাজয়’ বলেছেন।
আর্যরা তাদের দখল করা ভূমির জনগণের বিরুদ্ধে হিংসা, অসহিষ্ণুতা ও বিভাজনের নীতি অনুসরণ করে। তারা জন্ম পরিচয় ও গায়ের রঙের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বৈষম্য করে। তাদের শাস্ত্রীয় বিধানে বলা হয় : আর্যদের সাদা ঈশ্বর কালো অনার্যদের ঘৃণা করেন। তিনি আর্যদের গায়ের রঙ রক্ষা করতে কালোদের ধ্বংস করেন। বজ্রপাণি দেবতা শুধু সাদাদেরই জমি, সূর্যের আলো ও পানি দান করেন। ইন্দ্র দেবতাও শুধু আর্যদের রক্ষা করেন, মনুর অমান্যকারীদের দমন করেন। কালো অনার্যদের পরাজিত করে ‘স্বর্গরাজ্য’ থেকে তাদের বিতাড়িত করেন।
সিন্ধু অববাহিকার স্থিতিবান সভ্যতার নির্মাতা সেমিটিক দ্রাবিড়রা আর্যদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে কয়েকশ বছর লড়াই করে ধীরে ধীরে দক্ষিণ ও পূর্বদিকে দ্রাবিড় জ্ঞাতিভাইদের এলাকায় সরে যেতে থাকেন। উইলিয়াম হান্টার দেখিয়েছেন, সে তখন থেকেই এ এলাকায় আর্য ও দ্রাবিড় এই দুই বিপরীত স্রোত স্বতন্ত্রভাবে প্রবাহিত হয়েছে।
সিন্ধু অববাহিকায় দ্রাবিড়-আর্য সংঘাত চলাকালে গঙ্গা অববাহিকায় ঋষভ জৈন ধর্ম প্রচার করেন। বিশ্বাস, শিক্ষা, সৎকর্ম ও অহিংসার এ আদর্শে বাংলা বিহার ও চের রাজ্যের সেমিটিক দ্রাবিড় জনগণ আস্থাবান হন। যাযাবর আর্যরা ‘আর্যাবর্তে’ নিজেদের অবস্থান সংহত করে সেখান থেকে বের হয়ে দক্ষিণ ও পূর্বমুখী অভিযান শুরু করেন।
গঙ্গা অববাহিকার সেমিটিক দ্রাবিড় জনগণ জৈন ধর্ম অবলম্বনে আর্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ প্রতিরোধের মুখে আর্যদের এ অভিযান বাধাগ্রস্ত হয়। আর্য শাস্ত্রের বেদভাষ্যগুলোতেও স্বীকার করা হয়েছে, করতোয়ার পশ্চিম তীর পর্যন্ত এসে আর্যদের ‘হোমাগ্নি’ নিভে যায়।
আর্য বিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামের এক পর্যায়ে জৈন ধর্মে মতপার্থক্য ও বিভাজনের ফলে এই ধর্মের আবেদন দুর্বল হয়ে পড়ে। এর পেছনেও আর্য-ব্রাহ্মণদের সাংস্কৃতিক প্রভাব কাজ করেছে। জৈন ধর্মের ২৪তম ‘তীর্থঙ্কর’ বর্ধমান মহাবীরের (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৯-৫২৭) প্রায় সমসাময়িক গৌতম বুদ্ধ (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩-৪৮৩) অহিংসা, জীবে দয়া ও পবিত্র জীবন অনুসরণের মূলনীতিভিত্তিক বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। বেদ অস্বীকার করেন এবং মূর্তি পূজারীদের তিনি ‘সত্যের দুশমন’রূপে চিহ্নিত করেন। আর্যরাও গৌতম বুদ্ধকে ‘নাস্তিক’ ঘোষণা করেন।
গঙ্গা অববাহিকার সেমিটিক দ্রাবিড়দের মাঝে বৌদ্ধধর্ম দ্রুত জনপ্রিয় হয়। তারা বৌদ্ধ আদর্শ অবলম্বন করে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আর্যদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অশোকের নেতৃত্বে (খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩-২৩২) বিস্তীর্ণ এলাকায় মৌর্য সাম্রাজ্য কায়েম হয়। এমএন রায় এটিকে ‘বৌদ্ধ বিপ্লব’ নামে অভিহিত করেন। অশোক গায়েবে বিশ্বাসী হয়ে ‘এক অজানা প্রভুর’ সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষ্যে রাজ্য পরিচালনা করেন। তিনি জনকল্যাণ ও সুশাসনের নীতি অনুসরণ করেন। অশোকের সময় বৌদ্ধধর্মে কোনো মূর্তির প্রচলন ছিল না।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে বৌদ্ধধর্মে বিভাজন দেখা দেয়। ফলে এই ধর্মের আবেদন দুর্বল হতে থাকে। এই দুর্বলতার সমযে চার শতকে আর্যব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্ত শাসন (৩২০-৬০০ খ্রি.) কায়েম হয়। গুপ্ত শাসনামলে পশ্চিম ও উত্তর বাংলায় এনে বহু ব্রাহ্মণকে এনে জমি বরাদ্দ দিয়ে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী করে তাদের মাধ্যমে জনগণের ধর্ম-সংস্কৃতি-লোকাচারের ওপর আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্ম-সংস্কৃতি চাপানোর ব্যবস্থা করা হয়। তখন থেকে এ এলাকায় সংস্কৃত ভাষা ও আর্যপুরাণের দেব-দেবির কল্পকাহিনি জনসংস্কৃতির জায়গা দখল করতে থাকে। পাঁচ শতক থেকে এখানে জনপদ, ব্যক্তি ও জায়গার সংস্কৃত নাম পাওয়া যায়। ছয় শতকে কিছুটা দেরিতে হলেও পূর্ব বাংলায় আর্য সংস্কৃতির প্রভাব পড়তে থাকে। এই দেরির কারণে এখানে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব তুলনামূলকভাবে পশ্চিম ও উত্তর বাংলার তুলনায় কম পড়ে।
সাত শতকের শুরুতে গুপ্তদের সামন্ত শশাঙ্ক (৬০১-৬৩৫) রাঢ়ের (পশ্চিম বাংলা) রাজা হয়ে পুন্ড্র (উত্তরবাংলা) দখল করেন। শশাঙ্ক বৌদ্ধদের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলকে হত্যাযোগ্য ঘোষণা করে রাজকর্মচারীদের প্রতি হুকুম জারি করেন। তিনি বৌদ্ধ শিক্ষা-সংস্কৃতির বহু কেন্দ্র ধ্বংস করেন।
শশাঙ্কের রাজত্বের দশম বছরে মক্কায় মুহাম্মদ (সা.) নবী হন (৬১০-৬৩২)। তার নবুয়তের সপ্তম বছরে সাহাবি আবু ওয়াক্কাস (রা.)-এর নেতৃত্বে কজন সাহাবি হাবশা থেকে পালতোলা জাহাজে চীনের উদ্দেশে রওনা হয়ে চেররাজ্য ও বাংলায় প্রায় ৯ বছর যাত্রাবিরতি করে এখানে ইসলাম প্রচার করেন। পরে বাংলা থেকে চীনে যান। চীনের ক্যান্টনে আবু ওয়াক্কাস (রা.)-এর কবর ও মসজিদ এই এলাকায় ইসলামের প্রাচীনতম নিদর্শন।
আট শতকে বাগদাদে আব্বাসীয় খিলাফতের সূচনার একই বছর ৭৫০ সালে বাংলায় জন অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে গোপালের নেতৃত্বে বৌদ্ধধর্মী পাল রাজত্বের সূচনা হয়। ৪০০ বছরের পাল শাসনে বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক জীবনের উন্নতি ঘটে। বাংলাভাষা ও বাংলা লিপির প্রাথমিক আদল এ সময় গড়ে ওঠে। কিন্তু পাল আমলের শেষদিকে পাল শাসকরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সচেতন না থাকায় তাদের সদরে-অন্দরে, দরবারে-উপাসনালয়ে আর্য-ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতির ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বৌদ্ধদের উপাসনালয়ে তখন মূর্তিপূজা বিরোধী গৌতম বুদ্ধের মূর্তি বসানো হয়। মাইকেল এডওয়ার্ডসের ভাষায় ‘বৌদ্ধধর্মের হিন্দুকরণ’ ঘটার ফলে তখন বৌদ্ধধর্ম-সংস্কৃতির স্বতন্ত্র সীমানা বলে কিছু থাকল না। ফলে পাল রাজত্বের সামরিক প্রতিরক্ষাও অকার্যকর হয়ে পড়ল। এ সাংস্কৃতিক দুর্বলতার কারণে বারো শতকের মধ্যভাগে কর্ণাটী ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনরা এসে পাল রাজত্ব দখল করলো।
বাংলার প্রথম সেন রাজা বিজয় সেনের (১০৯৬-১১৫৯) পর তার ছেলে বল্লাল সেন (১১৫৯-৭৯ খ্রি.) ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিভেদ নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করেন। সেন শাসনে বাংলার সেমিটিক দ্রাবিড় সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক জীবনধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলার প্রাচীন বৌদ্ধ সংঘ-বিহার-স্তূপ-মঠগুলো বিরাণ হয়ে পড়ে। জনগণের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরি হয়। বাংলার বৌদ্ধ সাধক-কবি-সাহিত্যিক-কৌশলীরা নেপাল ও তিব্বতের পাহাড়-জঙ্গলে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন।
বাংলার ‘বৌদ্ধ বিপ্লব’-এর তখনকার ব্যর্থতার ফলে সৃষ্ট এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় ইসলাম প্রচারকরা ‘গতিময় পরিবর্তনের কান্ডারি’ রূপে নিপীড়িত জনগণের পাশে থেকে তাদের সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য কাজ করছিলেন। তাদের খানকাগুলো অভুক্তের জন্য লঙ্গরখানা, রোগীর জন্য হাসপাতাল, শিক্ষাহীনের জন্য বিদ্যালয় আর আশ্রয়হীনের ঠিকানারূপে একটি নীরব বিপ্লবের ধারা এগিয়ে নিচ্ছিল। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায় ‘ইসলাম-প্রভাবে প্রভাবান্বিত কিছু লোক’ তখন বাংলার সৃজ্যমান ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষীণ ধারাটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন।
ইসলাম প্রচারকদের দীর্ঘ সময়ের ত্যাগ ও কোরবানি আর জনসম্পৃক্ত খেদমতের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইসলামের প্রতি বিপুল জনসমর্থন তৈরি হয়। জনসমর্থনের সেই ভিত্তির ওপর ১২০৩ সালে বখতিয়ার খিলজী বাংলায় জনআকাঙ্ক্ষার অনুকূলে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। গরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগণ উৎসব করে এ বিজয়কে অভিনন্দন জানান। গোপাল হালদার এ বিজয় ছিল ‘ইসলামের বলিষ্ঠ ও সরল একেশ্বরবাদ এবং জাতিভেদহীন সাম্যদৃষ্টি আর উদার নীতি ও আত্মসচেতনতার কাছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ‘আত্মনিবেদন’।
বখতিয়ার খিলজী নদীয়া বিজয়ের প্রথম ১০০ বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় অর্ধেক এলাকা মুসলিম শাসনভুক্ত হয়। চৌদ্দ শতকের মধ্যে প্রায় পুরো এলাকা মুসলিম অধিকার আসে। ইসলাম প্রচারকরা এ সময় শাসক ও জনগণের মাঝে যোগসূত্ররূপে কাজ করেন। তারা জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো শাসকদের কাছে তুলে ধরেন। তাদের নানা বিষয়ে সতর্ক করেন। মুসলিম রাজ্য বিস্তারের জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গেও যুক্ত হন। তাদের নিঃস্বার্থ সমর্থনের ফলে মুসলিম রাজত্বে জনকল্যাণ ও সুশাসন নিশ্চিত হয়। এ সময় আইনের চোখে সমমর্যাদা এবং শিক্ষা ও পেশার অধিকার স্বীকৃত হয়। অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি আসে। জ্ঞান ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও মুক্তচর্চার জাগরণ ঘটে। সৃজ্যমান বাংলাভাষা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে দরবারে মর্যাদা পায়। মুসলিম শাসন কায়েমে আরো দেরি হলে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যেত বলে মনে করা হয়।
বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে মুসলমানদের অবদান উল্লেখ করতে যদুনাথ সরকার মন্তব্য করেনÑ‘প্রথম যুগের হিন্দু লেখকরা যখন নিজেদের সাধারণ রীতি অনুসারে তাদের রচিত পুস্তকাদি গোপন রাখতে পছন্দ করতেন, সেই যুগে পুস্তক নকল করার ও তা প্রচারের দ্বারা মুসলমানরা জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রথা প্রচলন করেন, এজন্য আমরা তাদের কাছে ঋণী।’
মুসলিম জীবনের সরলতা, শালীনতা, সুরুচি, সামাজিক সাম্য ও নৈতিকতা বাংলার বৃহত্তর জনজীবনকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন অববাহিকার এ এলাকার জন্য বঙ্গমূলে ‘বাঙ্গালা’, জনগণের পরিচয় ‘বাঙালি’ আর তাদের ভাষার পরিচয় ‘বাংলা’ নির্ধারণ করেন চৌদ্দ শতকের ইলিয়াসশাহী বংশের সুলতান শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৩৯-৫৮)। তখন থেকে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের ভিত্তি ও আত্মপরিচয় তৈরি হয়।
সাড়ে পাঁচশ বছরের মুসলিম শাসনের তৃতীয় শতকের শুরুতে পনেরো শতকে গণেশের স্বল্পস্থায়ী রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটে। তা ব্যর্থ হওয়ার প্রায় ১০০ বছর পর ষোল শতকের শুরুতে চৈতন্য সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেন। এই দুটি বিশেষ তাৎপর্যপূ্র্ণ ঘটনা বাংলায় মুসলিম শাসনের ব্যাপারে আর্য-ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য শুধু নয়, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ বোঝার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আর্য ও দ্রাবিড় দুই বিপরীত স্রোত এ এলাকায় ‘সব সময় স্বতন্ত্রভাবে প্রবাহিত’ হওয়ার বিষয়টিও এই প্রবণতা থেকে বোঝা সহজ।
বাংলায় মুসলিম শাসন কায়েমের ২০০ বছর পর ইলিয়াসশাহী সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের (১৩৯১-১৪১০) সময় তার দরবার প্রভাব বিস্তার করে আর্য-ব্রাহ্মণ্যবাদীরা মুসলিম শাসন উৎখাতের চেষ্টা শুরু করে। ইসলাম প্রচারক মুজাফ্ফর শামস বলখী সুলতানকে চিঠি লিখে এ সম্পর্কে সতর্ক করায় গিয়াসউদ্দীন পুরো দুই দশক অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে শাসন পরিচালনার সুযোগ পান। কিন্তু সেই চিঠি লেখার একযুগ পর গণেশ পরিকল্পিত অরাজকতা সৃষ্টি করে অল্প সময়ের মধ্যে চারজন শাসককে একের পর এক শিখণ্ডী হিসেবে রেখে শেষে সব ক্ষমতা নিজ আয়ত্তে নিয়ে ১৪১৫ সালে নিজেই মসনদ দখল করেন। তিনি তার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে শুরুতেই বহু আলেমকে হত্যা করেন এবং বহু দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেন। একদিনেই তিনি পান্ডুয়ার ২০০ আলেমকে হত্যা করেন। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিনা মসজিকে তিনি কাচারী বানান। ইসলাম প্রচারক নূর কুতুব-উল-আলমের নেতৃত্বে আলেমরা এক হয়ে গণবিদ্রোহের পরিস্থিতি তৈরি করেন। অন্যদিকে জৌনপুরের সুলতান ইবরাহিম শর্কি তার সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলার দিকে এগিয়ে আসেন। চারদিকে বিপদ দেখে গণেশ পিছু হটেন। তার ছেলে যদু ওরফে জিতমল ছিলেন নূর কুতুবের অনুসারী। তিনি জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ নামে মসনদে বসে অরাজক অবস্থা কাটিয়ে মুসলিম শাসনের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা করেন।
গণেশের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার পর প্রাসাদ চক্রান্তের পাশাপাশি পনেরো শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি শুরু হয়। তাদের লক্ষ্য হাসিলের বাধা দূর করতে তারা ইসলাম প্রচারকদের সঙ্গে শাসকদের দূরত্ব তৈরির কৌশল নেয়। ফলে রুকনউদ্দীন বারবাক শাহের (১৪৫৫-৭৬) সময় বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক ইসমাইল গাজী মক্কী ও শাহ জালাল দাকীনি শহীদ হন।
এরপরের ক’জন শাসক সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য প্রশ্নে আরো বেশি অজ্ঞতা ও অসচেতনতার পরিচয় দেন। সেই সুযোগে বাংলায় ইসলাম ও মুসলমানদের চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা আর্য-ব্রাহ্মণ্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন দ্রুত আরো বেশি শক্তি অর্জন করে। সে সময় ১৪৮৪ সালে চৈতন্যের জন্ম হয়। তিনি ১৫০৬ সালে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। চৈতন্যের ‘বৈষ্ণব’ আন্দোলনের দুটি বড় লক্ষ্যের মধ্যে প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল জাতিভেদের কারণে অচ্ছুত জনগণের ব্যাপক ইসলাম গ্রহণ ঠেকানো। আর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল মুসলিম শাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির পূর্ণ বাস্তবায়ন।
চৈতন্যের আন্দোলনের মতলব ও পরিচয় না জেনে না বুঝেই সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) প্রথম দিকে তার একজন ভক্ত হয়ে যান। তিনি এই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্য, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি উত্তর ভারতীয় আর্য সাহিত্য সংস্কৃত থেকে বাংলায় তরজমা করতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সে সময় মুসলিম দুনিয়ায় সমৃদ্ধ আরবি ভাষায় তাফসির, হাদিস, উসুল, তর্কশাস্ত্র, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাহিত্যের বিপুল জ্ঞানভান্ডার তৈরি থাকলেও বাংলার সুলতান মুসলিম সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন গঠনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মানবিক উপাদানসমৃদ্ধ এসব বই-কিতাব বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নেননি। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামি সাংস্কৃতিক ধারা শক্তিশালী করার ব্যাপারে মুসলিম সুলতানের উপেক্ষা এবং অন্যদিকে আর্য সাহিত্য-সংস্কৃতিকে একতরফা পৃষ্ঠপোষকতা দানের কারণে বাংলা সাহিত্যে আর্য-ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যিক উপাদান ও সাংস্কৃতিক ভাবধারা একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে। চৈতন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সুলতান হোসেন শাহ তার দুই শিষ্য রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামীকে দরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান।
চৈতন্য তার বৈষ্ণব আন্দোলনে দ্রাবিড় বাংলার আবহমান সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতিকূলে অবস্থান নেন। তিনি বেদবিরোধী হিসেবে মুসলমানদের ‘পাষণ্ডী’, ‘দুরাচারী’, ‘কলিকালের যবন’ নামে অভিহিত করেন। তিনি নিজেকে অবতার ঘোষণা করে ‘ভক্তি’ প্রচারের জন্য ‘পাষণ্ডী’ সংহারের সংকল্প প্রকাশ করেন। তিনি আর্য-ব্রাহ্মণ্য সাংস্কৃতিক এক জাতিত্ব কায়েম করার এই আন্দোলনে জাতিভেদী সমাজের সবাইকে একযোগে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মাঠে নামানোর জন্য মুসলিম বিদ্বেষী চরম সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা উসকে দেন। তিনি তার উত্তেজিত ভক্তদের নিয়ে নবদ্বীপের কাজীর বাড়িতে হামলা করে উপমহাদেশে প্রথম সাম্প্রদায়িক দাংগার সূচনা করেন।
চৈতন্যের মুসলিম বৈরী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আরেকটি বিশেষ অস্ত্র ছিল যৌনতা। বৃন্দাবনের গোপীদের সৃষ্ট ‘কিশোর কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার লাস্যলীলা’র প্রেমরসকে তিনি ‘ভগবতভক্তি ও ঈশ্বর প্রেমের বিকাশ’ বলে প্রচার করেন। ‘হরিণাম সংকীর্তন’-এর নামে তিনি নারী-পুরুষদের একাকার করে ঢাকঢোল, খোল-করতাল-মৃদঙ্গ বাজিয়ে নাচগানের তালে তালে নবদ্বীপের রাজপথে কীর্তনযাত্রার আয়োজন করেন। এভাবে উদ্বাহু উন্মাতাল রজকিনী প্রেমের পরকীয়া উচ্ছ্বাস তৈরি করে তিনি নিজেও কৃষ্ণপ্রেমের উচ্ছ্বাসে কখনো উন্মাদ ও সংজ্ঞাহারা হয়ে ভক্তদের দিওয়ানা করে তোলেন।
চৈতন্যের আন্দোলনে যৌনতার সয়লাব বৈষ্ণব সাহিত্যকে প্লাবিত করে। বৈষ্ণব সাহিত্যবিশারদ ডক্টর বিমল বিহারী মজুমদার চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ কাব্যকে ‘পর্নোগ্রাফি’ বলেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারও গীতগোবিন্দ কাব্যের রাধা-কৃষ্ণের কামকেলীর বর্ণনা সম্পর্কে লিখেছেন: এমন বর্ণনা বর্তমানের কোনো বইয়ে ছাপলে তা আদালতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হতো। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আর যৌনতার ঝাঁঝের মিশালে সৃষ্ট চৈতন্যের সর্বগ্রাসী বৈষ্ণব আন্দোলনের প্লাবন মোকাবিলার প্রস্তুতি তখন মুসলিম সমাজের ছিল না। কিছু সাংস্কৃতিক বোধহীন মুসলমান কবিও তখন বৈষ্ণবদের মিছিলে গা ভাসিয়েছিলেন।
বৈষ্ণব আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছলে সুলতানী দরবারের রূপ-সনাতনরা হোসাইন শাহকে উৎখাত করতে উদ্ধত হন। মুসলিম সমাজের সচেতন অংশ এ ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় দাঁড়ান। সুলতানও বৈষ্ণব আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে এ রূপ-সনাতনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করলে রূপ গোঁসাই সুলতানের ভান্ডার লুট করে চৈতন্যের সঙ্গে বৃন্দাবনে পালিয়ে যান। সনাতন গোঁসাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনিও কারারক্ষীদের ঘুস দিয়ে পালিয়ে চৈতন্যের কাছে চলে যান।
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এই আন্দোলনের পূর্বাপর ঘটনা বিশ্লেষণ করে লিখেছেনÑ‘ছোলতান হোছেনের প্রাথমিক দোষ দুর্বলতার সুযোগ লইয়া, গৌড় রাজ্যের সাধু-সন্ন্যাসীরূপ বৈষ্ণব জনতা বাংলাদেশ হইতে ইছলাম ধর্ম্ম ও মোছলেম শাসনকে সমূলে উৎখাত করিয়া ফেলিবার জন্য যে গভীর ও ব্যাপক ষড়যন্ত্রে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন ছোলতানের ও স্থানীয় মোছলেম নেতাদের যথাসময়ে সতর্ক হওয়ার ফলে তাহার অবসান ঘটিয়া যায়।’
রমেশচন্দ্র মজুমদার বৈষ্ণব সাহিত্যের অশ্লীলতার প্রশ্নে মন্তব্য করেও চৈতন্যের আন্দোলনকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘দুঃসাহসিক প্রতিশোধ’ বলেছেন। চৈতন্যের ভূমিকার মূল্যায়ন করে প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখেছেন: চৈতন্যের জন্ম না হলে শুধু জাতিভেদের কারণেই কিছু ‘উঁচুবর্ণ হিন্দু’ ছাড়া সবাই মুসলমান হয়ে যেতেন। অশীন দাশগুপ্ত চৈতন্যকে ষোল শতকের ‘মনু’ বলেছেন। তিনি লিখেছেন : বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজে একেক মনু একেক যুগে অবতীর্ণ হন। ষোল শতকের গোড়ার দিকের চৈতন্যও ছিলেন একজন মনুর মতো। মনুসংহিতার সমাজটাকে তিনিই এ সময় রক্ষা করেছিলেন।
চৈতন্যের মৃত্যুর পরও নবদ্বীপে বৈষ্ণব আন্দোলন জারি থাকে। সতেরো শতকের শেষদিকে ১৬৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জব চার্নক এই পটভূমিতে ‘সংস্কৃত পাণ্ডিত্যের কেন্দ্রভূমি’ নবদ্বীপকে তার কর্মকেন্দ্ররূপে বাছাই করেন। তখন থেকে নবদ্বীপে চৈতন্যের উত্তরসূরিদের সঙ্গে ‘ক্রুসেডার’ ইংরেজদের বিশেষ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ প্রহসনের ফলে মুসলিম শাসনের অবসান হয়।
চৈতন্যপন্থিদের বৈষ্ণব আন্দোলনের তৈরি সাংস্কৃতিক পাটাতনের ওপর ঊনিশ শতকের শুরুতে ১৮০০ সালে নবদ্বীপের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। খ্রিষ্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরিদের সঙ্গে চৈতন্যের উত্তরসূরি রামরাম বসুরা মিলে বাংলা ভাষার মুসলিম রূপ মুছে ফলতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালান। ঊনিশ শতকের শেষ নাগাদ এই ভাষাকে ‘মুসলমানি ছোঁয়া বাঁচিয়ে’, বাংলা ভাষার পূর্ব বাঙালি ঐতিহ্য মুছে ফেলে এটিকে ‘সংস্কৃতের দুহিতা’ নামে পরিচিত করার আয়োজন সম্পূর্ণ করা হয়। ফলে বাংলা ভাষায় মুসলমানদের ঐতিহ্য ও অবদান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। মুসলমানরা আদৌ বাঙালি কি না, বাংলা ভাষায় তাদের কোনো হিস্যা আছে কি না, তা নিয়েই তখন প্রশ্ন তৈরি করা হয়।
১৮৫৭ সালের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের পর ১৮৭০ সালে মওলানা কারামত আলী জৈনপুরী (১৮০০-১৮৭৩) বাংলার মুসলিম সমাজে ‘ভেতর থেকে সংস্কার’-এর ঐতিহাসিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৮৮২ সালে প্যান ইসলাম আন্দোলনের নেতা জামালউদ্দিন আফগানীর (১৮৩৯-১৮৯৭) কলকাতা ভাষণ বাংলার মুসলিম সাংস্কৃতিক জাগরণে গতি সঞ্চার করে। বাঙালি মুসলমানদের সংবাদসাময়িকী ও নসিহতমূলক বই-কিতাব প্রকাশনা ও বিভিন্ন জমিয়ত কায়েম হয়। মুসলিম-খ্রিষ্টান, ফরায়েজী-জৈনপুরী, হানাফি-আহলে হাদিস বাহাস-বিতর্কের বাইরে গিয়ে মুন্সী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭) গ্রামগঞ্জে ইসলামের বিশ্বাস-আচরণ-ইতিহাস-ঐতিহ্যভিত্তিক গণশিক্ষামূলক ওয়াজ মাহফিল জনপ্রিয় করেন। মুসলিম সমাজে যোগাযোগ বাড়ার ফলে বিভিন্ন জমিয়ত ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কায়েম হয়। এ সময় পর্বে ১৯০০ সালে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৯৮০-১৯৩১) ‘অনল প্রবাহ’ রচনা করেন। এরপর ১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে মুসলিম সমাজে আত্মবিশ্বাসের স্ফূরণ ঘটে।
১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক ও মুসলিম লীগ নেতা নাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলায় প্রজা-লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার ফলে বাংলার মুসলমানরা পলাশীর পর স্বশাসন ফিরে পাওয়ার প্রথম উপলব্ধি লাভ করেন। কলকাতাকেন্দ্রিক জমিদারদের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের বাধা ডিঙিয়ে ১৯৩৮ সালে ‘কৃষি খাতক আইন’, ‘কুসিদজীবী আইন’ ও ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব সংশোধন আইন’ পাস হয়। এর ফলেই বড় পদক্ষেপগুলো ছাড়াও মুসলমানদের শিক্ষার প্রসার ও সরকারি চাকরিতে ন্যায্য শরিকানা প্রতিষ্ঠার নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কৃষক-প্রজারা জমিদার-মহাজনদের জুলুম-শোষণের শিকল ভাঙতে আশাবাদী হন।
এ সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর্যব্রাহ্মণ্য পুরাণভিত্তিক পাঠ্যক্রম, ‘বন্দে মাতরম’ সংগীত, ‘শ্রীপদ্ম’ প্রতীক ইত্যাদি মুসলিম বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উপদান ৪০ কোটি জনসংখ্যার ইন্ডিয়ার ৯ কোটি মুসলমানের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পটভূমিতে ভবিষ্যৎ শাসন নীতিতে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের গ্যারান্টির প্রশ্নটি সামনে আসে। কংগ্রেস সাংস্কৃতিক প্রশ্নে মুসলমানদের কোনো ছাড় না দিতে অটল থাকলে তাদের সাংস্কৃতিক হেজেমনির মোকাবিলায় মুসলমানদের স্বতন্ত্র কর্মপন্থার বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ সময়সন্ধিক্ষণে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা আবুল কাসেম ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগ দেন। তিনি ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে মুসলমানদের স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পেশ করে বলেন: ‘১৯০৬ সালে বাংলা থেকেই মুসলিম লীগের নিশান প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল। এখন আমি বাংলার নেতা হিসেবে মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির প্রস্তাব উপস্থাপনের অধিকার লাভ করেছি।’
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর কলকাতা ও ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মীরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে কলকাতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ ও ঢাকায় ‘পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ গঠন করেন। বাংলার মুসলমানদের সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি করে এ সময় আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৮) তার এক বিশেষ অভিভাষণে বলেন : ‘রাজনৈতিক পাকিস্তান কায়েম হবে কি না জানি না, তবে সাংস্কৃতিক পাকিস্তান আমাদের অবশ্যই অর্জন করতে হবে।’
১৮৫৭ সাল থেকে প্রথম ১০০ বছর বাংলা ছিল এডাম স্মিথের ভাষায় ‘দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট’ বণিক কোম্পানির শাসনের অধীন। বাংলার মুসলমানরা এ ১০০ বছরে ছিয়াত্তুরের মন্বন্তর, চিরস্থায়ী জমিদারি বন্দোবস্ত, সূর্যাস্ত আইন, লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াফত আইন, অফিস-আদালতের ভাষা পরিবর্তনসহ প্রতিটি আঘাতে সবচেয়ে বেশি জর্জরিত ও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন। চিরস্থায়ী জমিদারি বন্দোবস্তের শৃঙ্খল এবং আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির নিগড় থেকে মুক্তির জন্য তারা স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করে ২০০ বছরের ‘আঁধার পর্দা’ পেরিয়ে স্বাধীন আবাসভূমি পাকিস্তান কায়েম করেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট শায়েস্তাখানের সময়ের লালবাগ কেল্লায় খাজা নাজিম উদ্দীন নতুন স্বাধীন দেশের পতাকা তোলেন। এ সময় ঢাকা ছিল অবকাঠামো বঞ্চিত এক নির্জিত মফস্বল শহর। দূর্বাঘাসে মাদুর পেতে আলপিনের বদলে বাবলা কাঁটায় কাগজ জুড়ে ঢাকায় অফিসের কাজ শুরু হয়। কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-গায়ক-শিল্পী-ক্রীড়াবিদরা ঢাকায় আবার নবনির্মাণের জোয়ার সৃষ্টি করেন। ঢাকায় যখন ছাপাখানা ছিল হাতেগোনা। তারও অধিকাংশ পাততাড়ি গুটিয়ে ইন্ডিয়া চলে যায়। মওলানা আকরম খাঁর ‘দৈনিক আজাদ’ কলকাতা থেকে ঢাকায় এনে প্রকাশ করতে এক বছর লেগে যায়।
নানা বাধা মোকাবিলা করে ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন জোয়ার শুরু হয়। ১৯৫০ সালের ১৬ মে খাজা নাজিমউদ্দীনের সরকার ‘জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন’ পাস করার ফলে বাংলার কৃষকরা জমিদারি দাসত্ব থেকে মুক্ত হন। পূর্ববাংলায় পাটকল-বস্ত্রকল-চিনিকলসহ নানা কলকারখানা গড়ে ওঠে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ফসলরূপে বাংলা একাডেমি ও বাংলা উন্নয়ন বোর্ড কায়েম হয়। ১৯৪৭ সাল থেকেই পূর্ববাংলার কলেজগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালের স্থলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬১ সালে মোমেনশাহী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীর নগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যলয় কায়েম হয়। বড় শহরগুলোতে মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মক্তব-মাদরাসা ও পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠে। ফলে ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন বদ্বীপ জেগে ওঠে।
ঐতিহাসিক কারণে ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা বই-কিতাব লেখা ও অনুবাদের কাজে কলকাতার তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। ঢাকার বাংলাবাজারের বইয়ের বাজার কলকাতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। সে সাহিত্যে বাঙালি মুসলিম জনজীবনের চিত্র প্রস্ফুটিত ছিল না। চকবাজার কেতাবপট্টি কোনোক্রমে একটি নতুন ধারা তৈরির চেষ্টা করছিল। বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্যের লেখকও ছিলেন নগণ্য। তাদের মধ্যে মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮), মওলানা আব্দুল্লাহিল বাকী (১৮৮৬-১৯৫২), মওলানা শামসুল হক ফরীদপুরী (১৮৯৫-১৯৬৮), আবদুল্লাহিল কাফী (১৯০০-১৯৬০) ও মওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী (১৯০০-১৯৭২) অগ্রণী ছিলেন। সেই পথে তরজমা ও মৌলিক বই-কিতাব রচনার ধারাকে অগ্রসর করেন মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (১৯১৮-১৯৮৭) ও মওলানা মুহীউদ্দীন খানসহ অল্প ক’জন। ১৯৪২ সালে মুফতি দীন মুহাম্মদ খান (১৯০০-১৯৭৪) ঢাকার চকবাজার শাহী মসজিদে প্রথম কোরআন তাফসির শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ মাসূম সেই ধারা আরো অগ্রসর করেন। সত্তরের দশকে মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ বেশ কয়েকজন আলেম কোরআন তাফসির বড় পরিসরে জনপ্রিয় করে ইসলামের মৌলিক গণশিক্ষার ধারাকে জোরালো করেন।
পাকিস্তান আমলের দুই যুগে আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় আমাদের ‘খামার বাংলা’য় মধ্যবিত্তের বৈঠকখানা তৈরি হয়। সেই অবকাঠামোর ওপর ১৯৭১ সালে পূর্ববাংলার কৃষক পরিবারের সন্তানরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ কায়েম করেন। এ পর্যায়ে ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলার সাংস্কৃতিক নির্মাণের ধারায় নতুন গতি সঞ্চার হয়। নবদ্বীপের সাংস্কৃতিক অধীনতা থেকে মুক্তির তাড়নাও এ সময় নানা মাত্রায় অব্যাহত থাকে। কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলার তুলনায় ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা এ সময়ের মধ্যে নানা দিক থেকে দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধন করে। ফলে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের রাজধানীরূপে ঢাকার গৌরব কয়েকশ বছর পর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এই সময়ের নানা অর্জনের মধ্যে একটি সূচকের দিকে এখানে ইঙ্গিত করছি। এক সময় মকসুদুল মুমিনিন কিংবা বড়জোর ‘বেহেশতি জেওর’ ছিল বাংলার সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানের দ্বীনি শিক্ষার প্রধান পুঁজি। এককভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’, সিরাত বিশ্বকোষ ও আল-কোরআন বিশ্বকোষ প্রণয়ন এবং বিভিন্নসহ তাফসির ও হাদিসগ্রন্থসহ সাড়ে চার হাজারের বেশি শিরোনামের বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করে বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক জীবনের বিরাট ঘাটতি পূরণ করে এ ধারায় আরো শত শত নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এভাবে বিভিন্ন দিক থেকে আমরা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনগুলো চিহ্নিত করতে পারি।
অতীতের বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের বর্তমান সাংস্কৃতিক অর্জন নিয়ে কিছুটা আশাবাদী হলেও নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে আমাদের অর্জন আরো বেশি হওয়া সম্ভব ছিল। সে সুযোগ আমরা নানা কারণে হারিয়েছি। বাংলার সেমিটিক দ্রাবিড় জনগণের স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত সাংস্কৃতিক প্রবাহকে বিপথগামী করতে জৈন-বৌদ্ধ আমলের মতো এবং ষোল-সতেরো-আঠারো শতকের মতোই আর্য-ব্রাহ্মণ্য সাংস্কৃতিক স্রোত সক্রিয় রয়েছে। এর মোকাবিলায় আমাদের সাংস্কৃতিক সীমানার পাহারা আরো শক্তিশালী করতে হবে। এ সচেতনতার ওপর আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক স্বাধীনতা নির্ভরশীল।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

