ড. মো. ফখরুল ইসলাম
মে ১৬, ১৯৭৬ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত একটি দিন। আজ থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগে ফারাক্কা অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রার দিনটি প্রতিবছর মে মাস এলেই বেশি করে সবার নজরে আসে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ অভিন্ন নদীর পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের কল্যাণের জন্যই আন্দোলনে নেমেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
মওলানা ভাসানী কোনো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর, একজন মজলুম জননেতা। তার নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল পদ্মা নদীর পানিসুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক পদযাত্রা যেটি ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ নামে পরিচিত।
ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকে মওলানা ভাসানীর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারত ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে তৎপরতা শুরু হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর প্রতিবাদ করে। তখন ভারত বলেছিল এটা অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে ১৯৬০ সালে এ বিষয়ে ভারত-পাকিস্তান বৈঠক হয়। তবে ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজে সহায়তাকারী দেশ সোভিয়েত রাশিয়া এবং খরচ ধরা হয় এক বিলিয়ন ডলার। ফিডার খাল খননের কাজ ব্যতিরেকে ১৯৭০ সালে ফারাক্কা ব্যারাজের নির্মাণকাজ শেষ করে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলাকে সংযুক্ত করা ২ হাজার ২৪০ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মিত হয়ে চালু হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত ফারাক্কার সংযোগ খালের কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে। ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর নানা কৌশলে ২১ এপ্রিল থেকে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করা হয়। যেটি আর বন্ধ হয়নি, আজ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেটা পরীক্ষামূলকভাবে চালুই রয়ে গেছে।
মওলানা ভাসানী ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর থেকে পদ্মায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশÑসবকিছুর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্য ছিল তার এই আন্দোলন। ভারত প্রতিবছর ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে বর্ষার অতিরিক্ত পানি আটকাতে না পেরে সব গেট খুলে দিলে বাংলাদেশের জীবনরেখা পদ্মা নদীতে বর্ষায় ভয়াল রূপ, বন্যা ও নদীভাঙন দেখা দেয়। খরায় গেট বন্ধ করে সামান্য জলধারা ছেড়ে দিলেও শীর্ণ-শুষ্ক নদীর কারণে জীবিকা হারানো দরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মওলানা ভাসানীর হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করে।
১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মওলানা ভাসানী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি পত্র লেখেন। তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করেন।
সেই চিঠির উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যিনি আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন। তিনি আমাদের এত বেশি ভুল বুঝেছেন, এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।’ (বিবিসি বাংলা নিউজ মে ১৭, ২০১৫)।
এ বিষয়ে মওলানা ভাসানির প্রত্যুত্তর ছিল, ‘আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার ওপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপুরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মেয়ের কাছ থেকে এরূপ প্রত্যাশা ছিল না।’ ... ‘বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো সফর করে প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি… সমস্যার ব্যাপকভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দুমাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বণ্টনভিত্তিক হওয়া উচিত।’
এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সমস্যা আড়ালে থেকে যায়। যার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার জন্ম দেয় এই লংমার্চ।
এই লংমার্চ কর্মসূচির রুট ছিল পদ্মাতীরের বিভাগীয় নগর রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে ১৬ মে সকাল ১০টায় দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে প্রেমতলী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পেরিয়ে কানসাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারাজ এলাকার পয়েন্টে গিয়ে সমাপ্তি হওয়া। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দিয়ে তিনি এই যাত্রা শুরু করেন। এ সময় ৯০ বছর বয়সি বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানী বেশ অসুস্থ ছিলেন। তার অনবরত প্রস্রাব হচ্ছিল। তবুও তিনি দুজন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বজ্র-কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটাকে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা আশ্চর্য ঘটনা মনে করেন।
মওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল ‘শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির ওপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।’ তিনি মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করাটাকে অত্যন্ত অন্যায় ও জুলুম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং ‘আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচার পথ করে দেবেন।’ বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্ট স্বীকার করে লাখ লাখ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই দীর্ঘপদযাত্রা শুরু করেন। লংমার্চকারীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ফারাক্কা পয়েন্টে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও সীমান্ত অতিক্রম করার আগে সরকারি পরামর্শে কানসাট স্থলবন্দরে উপনীত হয়ে লংমার্চ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।
এর প্রায় ২০ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গাচুক্তি সম্পন্ন হয়। যেটা অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে। তবে গঙ্গাচুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কী পেয়েছে বাংলাদেশ তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। একদিকে ফারাক্কা ব্যারাজের আয়ু ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গাচুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে। এই চুক্তির নবায়ন কীভাবে করা হবে, তা নিয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি।
ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে চুক্তি হয়েছে, সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে বর্ষায় অকালবন্যা হলেও শীতের আগেই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়ে পদ্মা। এককালের প্রমত্তা পদ্মা নদী যেখানে বড় বড় স্টিমারে চড়ে ঢাকা-কলকাতা আসা-যাওয়া চলত, এখন সেখানে নৌকা চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে ভারতের আন্তরিকতার অভাব ও একাই খাব নীতির কাছে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষ যুগ যুগ ধরে শুধু আর্তনাদ করেই চলেছে। এমনকি বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রচেষ্টার ফলেও নানা ভূরাজনৈতিক হিসেবের গরমিলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আন্তরিকতার ঘাটতি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, চুক্তি নিয়ে দোদুল্যমানতা ও বারবার প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশ অনেকটা অসহায়ভাবে অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় পানি সমস্যার মোকাবিলা করে চলেছে।
তবে নদীর পানি ভাগাভাগির বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে এ কথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন এখন শেষ হয়েছে। বরং মওলানা ভাসানীর সেই ফারাক্কা লংমার্চের বজ্র-কঠিন ভাষণের দৃঢ়তা আজও ফুরায়নি। আজও হারিয়ে যায়নি বাংলাদেশের চলার পথ, এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়। নানা কূটকৌশল ও প্রতারণায় অনেক বঞ্চিত হয়েও মওলানা ভাসানীর মতো নৈতিক শক্তিমান অগ্রজদের দোয়া ও অনুপ্রেরণায় চারদিকের শত বাধা পেরিয়ে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশÑসবার সামনে নিকট ভবিষ্যতে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
মে ১৬, ১৯৭৬ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত একটি দিন। আজ থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগে ফারাক্কা অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রার দিনটি প্রতিবছর মে মাস এলেই বেশি করে সবার নজরে আসে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ অভিন্ন নদীর পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের কল্যাণের জন্যই আন্দোলনে নেমেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
মওলানা ভাসানী কোনো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর, একজন মজলুম জননেতা। তার নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল পদ্মা নদীর পানিসুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক পদযাত্রা যেটি ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ নামে পরিচিত।
ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকে মওলানা ভাসানীর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারত ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে তৎপরতা শুরু হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর প্রতিবাদ করে। তখন ভারত বলেছিল এটা অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে ১৯৬০ সালে এ বিষয়ে ভারত-পাকিস্তান বৈঠক হয়। তবে ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজে সহায়তাকারী দেশ সোভিয়েত রাশিয়া এবং খরচ ধরা হয় এক বিলিয়ন ডলার। ফিডার খাল খননের কাজ ব্যতিরেকে ১৯৭০ সালে ফারাক্কা ব্যারাজের নির্মাণকাজ শেষ করে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলাকে সংযুক্ত করা ২ হাজার ২৪০ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মিত হয়ে চালু হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত ফারাক্কার সংযোগ খালের কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে। ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর নানা কৌশলে ২১ এপ্রিল থেকে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করা হয়। যেটি আর বন্ধ হয়নি, আজ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেটা পরীক্ষামূলকভাবে চালুই রয়ে গেছে।
মওলানা ভাসানী ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর থেকে পদ্মায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশÑসবকিছুর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্য ছিল তার এই আন্দোলন। ভারত প্রতিবছর ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে বর্ষার অতিরিক্ত পানি আটকাতে না পেরে সব গেট খুলে দিলে বাংলাদেশের জীবনরেখা পদ্মা নদীতে বর্ষায় ভয়াল রূপ, বন্যা ও নদীভাঙন দেখা দেয়। খরায় গেট বন্ধ করে সামান্য জলধারা ছেড়ে দিলেও শীর্ণ-শুষ্ক নদীর কারণে জীবিকা হারানো দরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মওলানা ভাসানীর হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করে।
১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মওলানা ভাসানী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি পত্র লেখেন। তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করেন।
সেই চিঠির উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যিনি আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন। তিনি আমাদের এত বেশি ভুল বুঝেছেন, এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।’ (বিবিসি বাংলা নিউজ মে ১৭, ২০১৫)।
এ বিষয়ে মওলানা ভাসানির প্রত্যুত্তর ছিল, ‘আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার ওপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপুরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মেয়ের কাছ থেকে এরূপ প্রত্যাশা ছিল না।’ ... ‘বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো সফর করে প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি… সমস্যার ব্যাপকভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দুমাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বণ্টনভিত্তিক হওয়া উচিত।’
এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সমস্যা আড়ালে থেকে যায়। যার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার জন্ম দেয় এই লংমার্চ।
এই লংমার্চ কর্মসূচির রুট ছিল পদ্মাতীরের বিভাগীয় নগর রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে ১৬ মে সকাল ১০টায় দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে প্রেমতলী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পেরিয়ে কানসাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারাজ এলাকার পয়েন্টে গিয়ে সমাপ্তি হওয়া। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দিয়ে তিনি এই যাত্রা শুরু করেন। এ সময় ৯০ বছর বয়সি বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানী বেশ অসুস্থ ছিলেন। তার অনবরত প্রস্রাব হচ্ছিল। তবুও তিনি দুজন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বজ্র-কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটাকে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা আশ্চর্য ঘটনা মনে করেন।
মওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল ‘শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির ওপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।’ তিনি মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করাটাকে অত্যন্ত অন্যায় ও জুলুম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং ‘আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচার পথ করে দেবেন।’ বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্ট স্বীকার করে লাখ লাখ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই দীর্ঘপদযাত্রা শুরু করেন। লংমার্চকারীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ফারাক্কা পয়েন্টে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও সীমান্ত অতিক্রম করার আগে সরকারি পরামর্শে কানসাট স্থলবন্দরে উপনীত হয়ে লংমার্চ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।
এর প্রায় ২০ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গাচুক্তি সম্পন্ন হয়। যেটা অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে। তবে গঙ্গাচুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কী পেয়েছে বাংলাদেশ তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। একদিকে ফারাক্কা ব্যারাজের আয়ু ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গাচুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে। এই চুক্তির নবায়ন কীভাবে করা হবে, তা নিয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি।
ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে চুক্তি হয়েছে, সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে বর্ষায় অকালবন্যা হলেও শীতের আগেই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়ে পদ্মা। এককালের প্রমত্তা পদ্মা নদী যেখানে বড় বড় স্টিমারে চড়ে ঢাকা-কলকাতা আসা-যাওয়া চলত, এখন সেখানে নৌকা চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে ভারতের আন্তরিকতার অভাব ও একাই খাব নীতির কাছে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষ যুগ যুগ ধরে শুধু আর্তনাদ করেই চলেছে। এমনকি বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রচেষ্টার ফলেও নানা ভূরাজনৈতিক হিসেবের গরমিলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আন্তরিকতার ঘাটতি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, চুক্তি নিয়ে দোদুল্যমানতা ও বারবার প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশ অনেকটা অসহায়ভাবে অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় পানি সমস্যার মোকাবিলা করে চলেছে।
তবে নদীর পানি ভাগাভাগির বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে এ কথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন এখন শেষ হয়েছে। বরং মওলানা ভাসানীর সেই ফারাক্কা লংমার্চের বজ্র-কঠিন ভাষণের দৃঢ়তা আজও ফুরায়নি। আজও হারিয়ে যায়নি বাংলাদেশের চলার পথ, এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়। নানা কূটকৌশল ও প্রতারণায় অনেক বঞ্চিত হয়েও মওলানা ভাসানীর মতো নৈতিক শক্তিমান অগ্রজদের দোয়া ও অনুপ্রেরণায় চারদিকের শত বাধা পেরিয়ে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশÑসবার সামনে নিকট ভবিষ্যতে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
নেপালের ভূখণ্ড নিয়ে ভারতীয় শক্তির দৃষ্টি পড়ে রয়েছে। নেপাল-ভারত সীমান্তে ভারতীয় আগ্রাসনের যে অভিযোগ উঠেছে, তা ঘিরে বেশ কিছু বিরোধ দেখা দিয়েছে
১৬ ঘণ্টা আগেইরানে ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলা দেশটিতে সরকারবিরোধী ক্ষোভ উসকে দেওয়ার পরিবর্তে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকেই আরো জোরদার করেছে।
১৬ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের ইতিহাস সংগ্রাম আর গর্বের। সামান্য কয়েকজন নেতা সত্যিকার অর্থে এই জাতির চেতনাকে ধারণ করতে পেরেছেন
১৬ ঘণ্টা আগেইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সাথে সাথে এসব দেশে থাকা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো শুধু লক্ষ্যবস্তু হবে না, পুরো আরব বিশ্বে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে পারে। একই সাথে যে কোনা মার্কিন স্বার্থ আঘাত হানা হতে পারে। ফলে যুদ্ধ নতুন মাত্রা পেতে পারে এবং অন্য দেশগুলো তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
১ দিন আগে