রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে যা ঘটে গেল, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। ধর্মের নামে কিংবা শরিয়তের দোহাই দিয়ে এই উন্মাদনা কিংবা এই পৈশাচিকতা মেনে নেওয়ার মতো নয়। এই সভ্য সমাজে এটি কী করে সম্ভব যে, কবর থেকে লাশ তুলে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেওয়া হলো! বিবেক আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? মানুষের লাশ নিয়ে এই হিংস্রতা শুধু সভ্যতাকে নয়, পবিত্র ধর্মকেও কটাক্ষ করছে।
যার লাশ নিয়ে এই ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার নাম নুরাল পাগলা। অভিযোগ উঠেছে, মৃত্যুর পর তাকে শরিয়ত মোতাবেক দাফন সম্পন্ন করা হয়নি। আরো অভিযোগ রয়েছে, জীবিত অবস্থায় নুরাল পাগলা নিজেকে ইমাম মাহাদী বলে দাবি করতেন। কিন্তু যত অভিযোগই থাকুক না কেন, কোনো আইনসিদ্ধ পন্থা ছাড়া মাজার জ্বালিয়ে দেওয়া যায় না। এছাড়া একজন মৃত মানুষের লাশ কবর থেকে তুলে নিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া শরিয়ত-সিদ্ধ তো নয়ই; বরং প্রচলিত আইনেরও পরিপন্থী।
ওই ঘটনা এমন একসময় ঘটেছে, যখন পলাতক ফ্যাসিস্টরা জুলাই বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিকে মৌলবাদের উত্থান হিসেবে দেখছে। তারা তাদের হীন প্রচারের জন্য এই ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হবে। এটি এমন একটি বিষয়, যার সঙ্গে না আছে সভ্যতার সম্পর্ক, না আছে ধর্মের প্রতি আনুগত্য। বরং এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ অনুমোদিত শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে।
কারণ ইসলামে বাড়াবাড়ির কোনো সুযোগ নেই, নেই কোনো জবরদস্তি। এমনকি জীবিত কিংবা মৃত উভয় অবস্থায় কোনো মুসলমানকে অসম্মান ও অপদস্থ করা হারাম। সুতরাং শরিয়তের দোহাই দিয়ে মৃত্যুর পরও মানুষকে এভাবে পুড়িয়ে ভস্ম করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি যুদ্ধের সময় মৃত মুসলিম সৈনিকের মুখমণ্ডল বা শরীর বিকৃত করার প্রতিশোধ হিসেবে মৃত অমুসলিম সৈনিকের শরীর বিকৃত করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে আর পুড়িয়ে ভস্ম করা তো দূরের কথা। এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রিয়নবী রাসুলপাক (সা.) বলেছেন, ‘মৃতব্যক্তির হাড় ভেঙে ফেলা জীবিত ব্যক্তির হাড় ভেঙে ফেলার মতোই।’ আবু দাউদ, হাদিস-৩২০৭। কারণ মৃতব্যক্তি জীবিত ব্যক্তির মতোই কষ্ট পেয়ে থাকেন।
অন্যদিকে জীবিত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা যেমন হারাম, তেমনি মৃত ব্যক্তিকে পোড়ানোও হারাম। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকেও পুড়িয়ে হত্যা করা হারাম করা হয়েছে। সুতরাং, জীবিত ব্যক্তিকে পুড়িয়ে হত্যা করলে যেমন পাপ হবে, তেমনি পাপ হবে মৃত মানুষের শরীর পুড়িয়ে ভস্ম করলে। তাই গোয়ালন্দে যারা নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে ছাই করেছেন, তারা চরম ইসলামবিরোধী কাজ করেছেন এবং তাদের শরিয়তবিরোধী কাজের জন্য বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।
শুধু তাই নয়, মানুষের মৃত্যুর পর কে দোজখের আগুনে পুড়বে এবং কে বেহেশতের প্রশান্তি লাভ করবে, তা সম্পূর্ণ আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। ইহজগতে মানুষের কিছু স্বাধীনতা থাকলেও মৃত্যুর পর সে চলে যায় পরজগতে অনন্তকালের বসতিতে, সেখানে তার কিছুই করার থাকে না। শেষ বিচারের দিন আল্লাহতায়ালা সবার কৃতকর্মের বিচার করবেন। সেই বিচারের আগে লাশ তুলে পোড়ানোর ঘটনা আল্লাহুতায়ালার একক এক্তিয়ারের মধ্যে হাত ঢোকানো, যা চরম সীমালঙ্ঘন।
এদিকে আগেই উল্লেখ করেছি, ইসলামে জবরদস্তি বলে কিছু নেই। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরা বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ অন্যদিকে হেদায়াতের মালিক স্বয়ং আল্লাহুতায়ালা নিজে। তাই কোনো মানুষের পক্ষে কাউকে হেদায়েত করা সম্ভব নয়। যেমন : কোরঅনুল আরিমে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যদি তোমার রবের ইচ্ছা হতো, তাহলে দুনিয়াবাসী ঈমান আনত। তবে কি তুমি মুমিন হওয়ার জন্য লোকদের ওপর জবরদস্তি করবে।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত-৯৯) এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, যেহেতু শুধু আল্লাহ হেদায়েতের মালিক, সেহেতু কে ঈমানদার হবেন, কে হবেন না, তা মানুষের হাতে নেই।
যদিও আমাদের প্রিয়নবী (সা.) চাইতেন সব মানুষই ঈমান আনুক। এ প্রসঙ্গে হজরত আব্বাস রাজিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু বলেছেন, রাসুলপাক (সা.) ঐকান্তিকভাবে সেটি চাইতেন। তখন আল্লাহতায়ালা জানিয়ে দিলেন, ‘যাদের ঈমান আনার কথা, তথা আগেই যাদের তকদিরে লেখা আছে, তারাই শুধু ঈমান আনবেন আর দুর্ভাগ্যের কথা, যাদের তকদিরে লেখা আছে, তারা দুর্ভাগা হবেন।’
যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ যাকে চান বিপথগামী করেন, আবার যাকে চান সৎ ও সরলপথে পরিচালিত করেন।’ (সুরা আনআম, আয়াত-৩৯) আবার আল্লাহতায়ালা এই একই সুরার ২২৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘আল্লাহ যাকে সৎপথ দেখানোর ইচ্ছা করেন, তার বক্ষদেশ উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে তিনি গুমরাহিতে নিক্ষেপ করার ইচ্ছা করেন, তার বক্ষদেশ খুব সংকীর্ণ করে দেন, যাতে মনে হয়, সে কষ্ট করে আকাশের দিকে ওঠার চেষ্টা করছে।’
তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা উত্তম জাতি, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজ করতে নিষেধ করবে।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০) এসব আয়াত থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে যায়, আল্লাহর বান্দা হিসেবে বাড়াবাড়ির কোনো সুযোগ নেই, যেটি গোয়ালন্দবাসী করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নুরাল পাগলা যদি শরিয়তবিরোধী কাজ করে থাকেন, তাহলে তার জীবিত অবস্থায় তাকে খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করা হয়েছিল কি না? দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশের যেহেতু কোনো শরিয়াহ আদালত নেই; কিংবা কেন্দ্রীয়ভাবে বা স্থানীয়ভাবে অনুমোদিত কোনো ফতোয়া বোর্ড নেই, তাহলে কীসের ভিত্তিতে বা কাদের উসকানিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে হজরত মনসুর হাল্লাজ (র.)-এর বিচারের কথা উল্লেখ করা যায়।
সে সময় তাকে শরিয়তবিরোধী হিসেবে অধিকাংশ আলেম-ওলামা সাব্যস্ত করলে সরকারি আদালতে তার বিচার হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেই বিচার কতটা সঠিক ছিল, সেটি অন্য কথা। তবে তখন অধিকাংশ আলেম-ওলামার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিচার হয়েছিল। এছাড়া সৌদি আরবসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে শরিয়াহ আইন বহাল আছে। সে অনুযায়ী তারা বিচার করে। সৌদি আরবে তো বিচার করে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লোককে কতল করা হয়। বাংলাদেশের সে রকম কিছু নেই। সুতরাং রাষ্ট্রের বিধিবদ্ধ শরিয়াহ আইন যেখানে নেই; কিংবা যেখানে দেশের প্রখ্যাত ওলামাদের কোনো মতামত নেই, সেখানে স্থানীয় কিছু আলেম কিংবা মুসল্লিদের সিদ্ধান্তে গোয়ালন্দে যা ঘটেছে, তা একদমই গ্রহণযোগ্য নয়।
এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকায় মাজারে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো মহল থেকে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে এসব ঘটনা ঘটে চলছে। কারণ শত শত বছর ধরে উপমহাদেশে মাজার সংস্কৃতি চলে আসছে, যা আমাদের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু অতীতে কখনো এমনটা ঘটেনি, যা এখন বাংলাদেশে আমরা দেখছি। প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে শত শত মানুষ ভারতের আজমির শরিফে যান হজরত মইনুদ্দিন চিশতী (র.)-এর মাজার জিয়ারত করতে। প্রতিদিনই শত শত মুসলমান সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজার জিয়ারত করে থাকেন।
এমনকি নির্বাচন এলে অনেক নেতানেত্রী হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজার জিয়ারত করে নির্বাচনে প্রচার শুরু করেন। আমি পাকিস্তানের লাহোরে দাতাগঞ্জে বক্সের মাজারে গিয়েছি। সেখানে দেখেছি সব সময় লোকজন আছে এবং প্রার্থনা করছে। অতীতে কখনো এসব মাজার কিংবা অন্য কোনো মাজার নিয়ে ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির কথা শোনা যায়নি। অতিসম্প্রতি এসব ঘটনা ঘটছে, যা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির একটি পরিকল্পিত অভিসন্ধি বলে মনে হচ্ছে। মূলত এটি হচ্ছে নন-ইস্যুকে ইস্যু করার একটি পাঁয়তারা।
পরিশেষে ঢাকার নুরাল পাগলাকে নিয়ে লেখা শেষ করতে চাই। ৭০-এর দশকে ঢাকার রাজপথে নুরাল পাগলা নামে এক ব্যক্তিকে চলাচল করতে দেখা যেত। সুঠাম শরীর, লম্বা চুল, গায়ে জড়ানো থাকত অনেকগুলো শিকল। একদম দিগম্বর শরীর। অধিকাংশ সময় কাটাত হাইকোর্টের মাজারে। সে যখন হেঁটে চলত, তখন এদিক-ওদিক তাকাত না, মাথা নিচু করে সোজাসুজি হাঁটত। সে সময় কখনো শুনিনি যে, পাগল ভেবে তাকে কেউ ঢিল মেরেছে কিংবা ভণ্ড বলে কটাক্ষ করেছে।
কিংবা শরিয়তের বিধান অমান্য করার জন্য ফতোয়া দিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মূলত এই দেশের মানুষ সালাফি, আহলে হাদিস, দেওবন্দি, আহলে সুন্নত ইত্যাদি নানা মতবাদ দ্বারা বিভক্ত থাকলেও শত শত বছর ধরে একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে বাস করে আসছে। কখনো এই মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে কেউ সংঘাতে জড়ায়নি। বলা যায়, অসাধারণ এক সহনশীলতা বজায় ছিল আমাদের এই সমাজে। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর একে অন্যের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র পাকানো হচ্ছে। যার প্রতিফলন ঘটেছে গোয়ালন্দসহ আরো কিছু স্থানে। আমরা দ্রুত অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি। এর ফলে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সামাজিক ঐকতান

