ড. একেএম মাকসুদুল হক
গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামে হামলার ঘটনায় যারা দায়ী তাদের পৃথিবীর শেষ সীমা পর্যন্ত ধাওয়া করার প্রতিজ্ঞা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি এ হামলার জন্য কোনো তদন্ত ও প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তান এই হামলার দায় পুরোপুরি অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে। পাকিস্তানে সামরিক হামলার আগে মোদি কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পানি যুদ্ধ শুরু করে সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি স্থগিত করার মাধ্যমে। পানি চুক্তি স্থগিত করার ঘটনাকে পাকিস্তান যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু এরই মধ্যে ৬ মে মধ্যরাতের পর ভারত সত্যি সত্যি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, যা এখন ভয়ংকর দিকে মোড় নেওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
২০২১ সালে কাশ্মীরে পর্যটকসংখ্যা ছিল সাড়ে ছয় লাখ। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ লাখে। কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করার পর সেখানে অনাবিল শান্তি বিরাজমান রয়েছে বলে ভারত প্রমাণ করতে চাইছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এখন যুদ্ধ যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে এসব ক্ষুদ্র চিন্তার আর কোনো সুযোগ নেই।
২২ এপ্রিলের হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করলেও সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। বরং উল্টো যে অভিযোগ সামনে এসেছে তা হলো ভারত কোনো সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নিজেরাই এটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সামর্থ্য সম্পর্কে আমরা সম্প্রতি অবগত হয়েছি। সুদূর কানাডায় তারা শিখ বিদ্রোহী হারদিপ সিং নিজ্জরকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও তারা বিদ্রোহী নেতা হত্যার কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু ‘এফবিআই’-এর তৎপরতার কারণে তা সফল হতে পারেনি। ভারতে অনেক দিন ধরে মুসলিম নির্যাতন চলছে। বিভিন্ন এলাকায় মসজিদ, মাদরাসা ও বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অতি সম্প্রতি ‘ওয়াক্ফ’ আইন পরিবর্তন করে মুসলমানদের ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সব স্থাবর সম্পত্তি জবর দখলের বন্দোবস্ত পাকাপাকি করে ফেলেছে। ফলে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় প্রকাশ্যে আন্দোলনে নেমেছে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো মুসলিম বিশ্ব এতে নাখোশ হচ্ছে। সম্প্রতি কাশ্মীরে সরকারি সামরিক বাহিনীর ওপর বেশ কয়েকটি হামলা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বাতিলের মাধ্যমে কাশ্মীরে বাইরের হিন্দুদের জমির মালিকানার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সেখানে অনেক দিন ধরে চলছে আন্দোলন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীরিদের ওপর আরো একটি ‘ক্র্যাকডাউনের’ একটি ন্যারেটিভ অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। ২২ এপ্রিলের ঘটনার পরপরই সন্দেহভাজন দুই হাজার কাশ্মীরি মুসলমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রায় ডজনখানেক বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি সেনাবাহিনী দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা ব্যবহার করে সন্দেহভাজনের বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে নিখোঁজ হয়ে থাকা একজন সন্দেহভাজনের আত্মীয়স্বজনের বাড়িও ধ্বংস করেছে সরকারি বাহিনী। ঘটনার পরপরই কোনো ধরনের প্রমাণ বা তদন্ত ছাড়াই দ্রুত পাকিস্তানকে দোষারোপ করে দুটি দেশকে হঠাৎই যুদ্ধাবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। ভারতীয়রা প্রকাশ করেছিল, ‘টিআরএফ’ বা ‘দ্য রেজিস্টেন্স ফ্রন্ট’ হামলার দায় স্বীকার করেছে। কিন্তু ‘টিআরএফ’ তাদের ওয়েবসাইটে এর দায় অস্বীকার করেছে। তবে ভারতের মিডিয়া বা সরকারি মুখপাত্রের মিথ্যা ন্যারেটিভ ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে।
বিজেপির ঐতিহ্য মোতাবেক ৭৫ বছর বয়সে নরেন্দ্র মোদির (৭৩ বছর) অবসরে যেতে হতে পারে। কাজেই এ সময় তার ক্যারিশমা প্রদর্শন অত্যন্ত প্রয়োজন যেন তার বিকল্প আর কাউকে ভাবা না হয়। আর এ ক্যারিশমা প্রদর্শনের জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন উগ্র হিন্দুত্ববাদকে আশ্রয় করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করা। বেশ কয়েক বছর ধরে ভারত একে একে সব প্রতিবেশীর বন্ধুত্ব হারিয়েছে। আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ—সব আঞ্চলিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেছেন মোদি। সর্বশেষ বাংলাদেশের সঙ্গেও দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে তালাক ঘটেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে লেগে যাওয়ার হিম্মত প্রদর্শন হয়তোবা অভ্যন্তরীণভাবে মোদির মুখরক্ষা করতে পারে!
১৯৬০ সালে ‘বিশ্বব্যাংকের’ মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তান সিন্ধু চুক্তি করে সিন্ধুর আগের তিনটি শাখা নদীর পানি ভারত এবং পশ্চিমের তিনটি শাখা নদীর পানি পাকিস্তান ব্যবহারের বন্দোবস্ত করে। তবে পাকিস্তানের অংশের তিনটি শাখা নদীর ওপর ভারত বেশ কয়েকবার বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে পাকিস্তানের বাধার মুখে ব্যর্থ হয়। তাই সিন্ধু চুক্তি বাতিলের কোনো সুযোগ খোঁজা হচ্ছিল কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার? তারা গত বছর সিন্ধু পানি চুক্তিতে পরিবর্তনের প্রস্তাব দিলে পাকিস্তান সাড়া দেয়নি।
সবচেয়ে বড় ইস্যুটি হলো মোদির ‘হিন্দুত্ববাদী’ ক্যারিশমা। যে হিন্দুত্ববাদের ওপর ভর করে মোদি টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তিনি কি এখন সেই হিন্দুত্ববাদের চাপে রয়েছেন। ইতিহাস বলে কোনো ‘ইজম’ যখন নিজ দেশে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপনে সফল হয়, তখন সেই ‘ইজম’ দেশের বাইরেও হাত প্রসারিত করে এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলেও কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চায়। তা ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে সফলতা না থাকায় এখন দেশকে স্থিতিশীল রাখার জন্য ‘হিন্দুইজম’ কার্ডই অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এই হিন্দুত্ববাদকে উসকে দিতে হলে চিরশত্রু মুসলিম দেশ পাকিস্তানের ওপর চড়াও হওয়া একটি বিকল্প হতে পারে। এদিকে মনিপুরে অস্থিতিশীলতা দমানো যাচ্ছে না। প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যই বিকল্প কৌশল হতে পারে? তা ছাড়া যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী জনগোষ্ঠীর ওপর ভর করে মোদি ক্ষমতায় আছেন, সেই উগ্রবাদীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। ফলে মোদি বিশাল এক চাপের মধ্যে পড়েন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য।
২২ এপ্রিলের ঘটনার ধরন, লক্ষ্যবস্তু, পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রভৃতি থেকে বোঝা যায়, ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়েছে। এই ব্যর্থতা কি প্রাকৃতিক নাকি কৃত্রিম, তা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীর পৃথিবীর সবচেয়ে অধিক সামরিকীকরণ অঞ্চল। এখানে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সীমান্ত নেই, আছে লাইন অব কন্ট্রোল বা ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’। আর এখানকার পর্যটনশিল্প ভারতের অর্থনীতির জন্য বড় অবদান রাখে। কাজেই এখানে পর্যটকরা কীভাবে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে পারে, তা কোনো হিসেবেই মিলছে না।
৬ মে রাতে ভারত পাকিস্তানের ছয়টি শহরে ৯টি বেসামরিক স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে শিশুসহ ৩১ পাক নাগরিককে হত্যা করেছে। তারা সেই পুরোনো ন্যারেটিভ সন্ত্রাসী ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেছে। এই অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ আখ্যা দেওয়ার মধ্যেও রয়েছে হিন্দুত্ববাদী কার্ড খেলার চেষ্টা।
চীনের সঙ্গে ভারতের সংঘাতময় পরিস্থিতি, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি, সেই সঙ্গে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠাসহ আরো বিভিন্ন কারণে বর্তমানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক অভিযান কোনো সুস্থ চিন্তা নয়। চীন ও বাংলাদেশ সীমান্ত দুর্বল করে পাক সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করা সামরিক কৌশলের পরিপন্থী হতে পারে। মনিপুরের বর্তমান পরিস্থিতিও ভারতের জন্য যুদ্ধসহায়ক সময় নয়। এর আগেও নিকট অতীতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দু-দুবার (১৯৯৮ ও ২০১৯) যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করলেও তা বড় সংঘাতের দিকে গড়ায়নি।
ভারত ইতোমধ্যে চেনাব ও ঝিলাম নদীর ওপরে নির্মিত বাঁধের মাধ্যমে পাকিস্তান অংশে পানিপ্রবাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান বলেছে, তারা ‘সিমলা চুক্তি’ বাতিল করতে পারে। সিমলা চুক্তি বাতিল মানেই ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’ ‘যুদ্ধবিরতি রেখা’য় পরিণত হবে, যা যেকোনো সময় পাকিস্তানকে ভারত আক্রমণের সুযোগ করে দিতে পারে। পাকিস্তান আক্রমণে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের ‘শিখরা’ ও কাশ্মীরের ‘মুসলমান’রা কোন পক্ষ নেবে, তাতে অনেক সন্দেহ ও ভয় রয়েছে ভারতের। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, মোদির যুদ্ধের বেলুন ফুটো হয়ে গেছে। কারণ তিনি সশস্ত্র বাহিনীর ওপর যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা লক্ষ্যবস্তু ও দিনক্ষণ ঠিক করার দায়িত্ব এবং আক্রমণের চরিত্র ছেড়ে দিয়েছেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় মোদির এই যুদ্ধ হালে পানি পায়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের সর্বশেষ হামলাকে লজ্জাকর বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও উভয় দেশকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভারত শক্তিশালী কোনো কারণ হাজির করতে পারেনি। অন্যদিকে সিন্ধুর পানি পাকিস্তানের জীবন-মরণ সমস্যা। পাকিস্তানের কৃষির ৮০ শতাংশই সিন্ধুনির্ভর। কাজেই সিন্ধুর পানি বন্ধ হলে পাকিস্তান বাঁচা-মরার লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হবে। যদিও ভারত-পাকিস্তান কোনো দেশই এখন পূর্ণ যুদ্ধে জড়ানোর অবস্থায় নেই, কিন্তু উগ্রবাদী গোষ্ঠীর চাপে অপরিণামদর্শী মোদি সর্বাত্মক যুদ্ধের ট্রিগার চাপতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামে হামলার ঘটনায় যারা দায়ী তাদের পৃথিবীর শেষ সীমা পর্যন্ত ধাওয়া করার প্রতিজ্ঞা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি এ হামলার জন্য কোনো তদন্ত ও প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তান এই হামলার দায় পুরোপুরি অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে। পাকিস্তানে সামরিক হামলার আগে মোদি কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পানি যুদ্ধ শুরু করে সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি স্থগিত করার মাধ্যমে। পানি চুক্তি স্থগিত করার ঘটনাকে পাকিস্তান যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু এরই মধ্যে ৬ মে মধ্যরাতের পর ভারত সত্যি সত্যি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, যা এখন ভয়ংকর দিকে মোড় নেওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
২০২১ সালে কাশ্মীরে পর্যটকসংখ্যা ছিল সাড়ে ছয় লাখ। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ লাখে। কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করার পর সেখানে অনাবিল শান্তি বিরাজমান রয়েছে বলে ভারত প্রমাণ করতে চাইছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এখন যুদ্ধ যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে এসব ক্ষুদ্র চিন্তার আর কোনো সুযোগ নেই।
২২ এপ্রিলের হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করলেও সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। বরং উল্টো যে অভিযোগ সামনে এসেছে তা হলো ভারত কোনো সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নিজেরাই এটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সামর্থ্য সম্পর্কে আমরা সম্প্রতি অবগত হয়েছি। সুদূর কানাডায় তারা শিখ বিদ্রোহী হারদিপ সিং নিজ্জরকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও তারা বিদ্রোহী নেতা হত্যার কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু ‘এফবিআই’-এর তৎপরতার কারণে তা সফল হতে পারেনি। ভারতে অনেক দিন ধরে মুসলিম নির্যাতন চলছে। বিভিন্ন এলাকায় মসজিদ, মাদরাসা ও বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অতি সম্প্রতি ‘ওয়াক্ফ’ আইন পরিবর্তন করে মুসলমানদের ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সব স্থাবর সম্পত্তি জবর দখলের বন্দোবস্ত পাকাপাকি করে ফেলেছে। ফলে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় প্রকাশ্যে আন্দোলনে নেমেছে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো মুসলিম বিশ্ব এতে নাখোশ হচ্ছে। সম্প্রতি কাশ্মীরে সরকারি সামরিক বাহিনীর ওপর বেশ কয়েকটি হামলা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বাতিলের মাধ্যমে কাশ্মীরে বাইরের হিন্দুদের জমির মালিকানার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সেখানে অনেক দিন ধরে চলছে আন্দোলন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীরিদের ওপর আরো একটি ‘ক্র্যাকডাউনের’ একটি ন্যারেটিভ অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। ২২ এপ্রিলের ঘটনার পরপরই সন্দেহভাজন দুই হাজার কাশ্মীরি মুসলমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রায় ডজনখানেক বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি সেনাবাহিনী দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা ব্যবহার করে সন্দেহভাজনের বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে নিখোঁজ হয়ে থাকা একজন সন্দেহভাজনের আত্মীয়স্বজনের বাড়িও ধ্বংস করেছে সরকারি বাহিনী। ঘটনার পরপরই কোনো ধরনের প্রমাণ বা তদন্ত ছাড়াই দ্রুত পাকিস্তানকে দোষারোপ করে দুটি দেশকে হঠাৎই যুদ্ধাবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। ভারতীয়রা প্রকাশ করেছিল, ‘টিআরএফ’ বা ‘দ্য রেজিস্টেন্স ফ্রন্ট’ হামলার দায় স্বীকার করেছে। কিন্তু ‘টিআরএফ’ তাদের ওয়েবসাইটে এর দায় অস্বীকার করেছে। তবে ভারতের মিডিয়া বা সরকারি মুখপাত্রের মিথ্যা ন্যারেটিভ ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে।
বিজেপির ঐতিহ্য মোতাবেক ৭৫ বছর বয়সে নরেন্দ্র মোদির (৭৩ বছর) অবসরে যেতে হতে পারে। কাজেই এ সময় তার ক্যারিশমা প্রদর্শন অত্যন্ত প্রয়োজন যেন তার বিকল্প আর কাউকে ভাবা না হয়। আর এ ক্যারিশমা প্রদর্শনের জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন উগ্র হিন্দুত্ববাদকে আশ্রয় করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করা। বেশ কয়েক বছর ধরে ভারত একে একে সব প্রতিবেশীর বন্ধুত্ব হারিয়েছে। আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ—সব আঞ্চলিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেছেন মোদি। সর্বশেষ বাংলাদেশের সঙ্গেও দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে তালাক ঘটেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে লেগে যাওয়ার হিম্মত প্রদর্শন হয়তোবা অভ্যন্তরীণভাবে মোদির মুখরক্ষা করতে পারে!
১৯৬০ সালে ‘বিশ্বব্যাংকের’ মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তান সিন্ধু চুক্তি করে সিন্ধুর আগের তিনটি শাখা নদীর পানি ভারত এবং পশ্চিমের তিনটি শাখা নদীর পানি পাকিস্তান ব্যবহারের বন্দোবস্ত করে। তবে পাকিস্তানের অংশের তিনটি শাখা নদীর ওপর ভারত বেশ কয়েকবার বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে পাকিস্তানের বাধার মুখে ব্যর্থ হয়। তাই সিন্ধু চুক্তি বাতিলের কোনো সুযোগ খোঁজা হচ্ছিল কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার? তারা গত বছর সিন্ধু পানি চুক্তিতে পরিবর্তনের প্রস্তাব দিলে পাকিস্তান সাড়া দেয়নি।
সবচেয়ে বড় ইস্যুটি হলো মোদির ‘হিন্দুত্ববাদী’ ক্যারিশমা। যে হিন্দুত্ববাদের ওপর ভর করে মোদি টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তিনি কি এখন সেই হিন্দুত্ববাদের চাপে রয়েছেন। ইতিহাস বলে কোনো ‘ইজম’ যখন নিজ দেশে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপনে সফল হয়, তখন সেই ‘ইজম’ দেশের বাইরেও হাত প্রসারিত করে এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলেও কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চায়। তা ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে সফলতা না থাকায় এখন দেশকে স্থিতিশীল রাখার জন্য ‘হিন্দুইজম’ কার্ডই অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এই হিন্দুত্ববাদকে উসকে দিতে হলে চিরশত্রু মুসলিম দেশ পাকিস্তানের ওপর চড়াও হওয়া একটি বিকল্প হতে পারে। এদিকে মনিপুরে অস্থিতিশীলতা দমানো যাচ্ছে না। প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যই বিকল্প কৌশল হতে পারে? তা ছাড়া যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী জনগোষ্ঠীর ওপর ভর করে মোদি ক্ষমতায় আছেন, সেই উগ্রবাদীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। ফলে মোদি বিশাল এক চাপের মধ্যে পড়েন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য।
২২ এপ্রিলের ঘটনার ধরন, লক্ষ্যবস্তু, পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রভৃতি থেকে বোঝা যায়, ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়েছে। এই ব্যর্থতা কি প্রাকৃতিক নাকি কৃত্রিম, তা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীর পৃথিবীর সবচেয়ে অধিক সামরিকীকরণ অঞ্চল। এখানে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সীমান্ত নেই, আছে লাইন অব কন্ট্রোল বা ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’। আর এখানকার পর্যটনশিল্প ভারতের অর্থনীতির জন্য বড় অবদান রাখে। কাজেই এখানে পর্যটকরা কীভাবে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে পারে, তা কোনো হিসেবেই মিলছে না।
৬ মে রাতে ভারত পাকিস্তানের ছয়টি শহরে ৯টি বেসামরিক স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে শিশুসহ ৩১ পাক নাগরিককে হত্যা করেছে। তারা সেই পুরোনো ন্যারেটিভ সন্ত্রাসী ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেছে। এই অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ আখ্যা দেওয়ার মধ্যেও রয়েছে হিন্দুত্ববাদী কার্ড খেলার চেষ্টা।
চীনের সঙ্গে ভারতের সংঘাতময় পরিস্থিতি, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি, সেই সঙ্গে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠাসহ আরো বিভিন্ন কারণে বর্তমানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক অভিযান কোনো সুস্থ চিন্তা নয়। চীন ও বাংলাদেশ সীমান্ত দুর্বল করে পাক সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করা সামরিক কৌশলের পরিপন্থী হতে পারে। মনিপুরের বর্তমান পরিস্থিতিও ভারতের জন্য যুদ্ধসহায়ক সময় নয়। এর আগেও নিকট অতীতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দু-দুবার (১৯৯৮ ও ২০১৯) যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করলেও তা বড় সংঘাতের দিকে গড়ায়নি।
ভারত ইতোমধ্যে চেনাব ও ঝিলাম নদীর ওপরে নির্মিত বাঁধের মাধ্যমে পাকিস্তান অংশে পানিপ্রবাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান বলেছে, তারা ‘সিমলা চুক্তি’ বাতিল করতে পারে। সিমলা চুক্তি বাতিল মানেই ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’ ‘যুদ্ধবিরতি রেখা’য় পরিণত হবে, যা যেকোনো সময় পাকিস্তানকে ভারত আক্রমণের সুযোগ করে দিতে পারে। পাকিস্তান আক্রমণে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের ‘শিখরা’ ও কাশ্মীরের ‘মুসলমান’রা কোন পক্ষ নেবে, তাতে অনেক সন্দেহ ও ভয় রয়েছে ভারতের। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, মোদির যুদ্ধের বেলুন ফুটো হয়ে গেছে। কারণ তিনি সশস্ত্র বাহিনীর ওপর যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা লক্ষ্যবস্তু ও দিনক্ষণ ঠিক করার দায়িত্ব এবং আক্রমণের চরিত্র ছেড়ে দিয়েছেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় মোদির এই যুদ্ধ হালে পানি পায়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের সর্বশেষ হামলাকে লজ্জাকর বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও উভয় দেশকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভারত শক্তিশালী কোনো কারণ হাজির করতে পারেনি। অন্যদিকে সিন্ধুর পানি পাকিস্তানের জীবন-মরণ সমস্যা। পাকিস্তানের কৃষির ৮০ শতাংশই সিন্ধুনির্ভর। কাজেই সিন্ধুর পানি বন্ধ হলে পাকিস্তান বাঁচা-মরার লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হবে। যদিও ভারত-পাকিস্তান কোনো দেশই এখন পূর্ণ যুদ্ধে জড়ানোর অবস্থায় নেই, কিন্তু উগ্রবাদী গোষ্ঠীর চাপে অপরিণামদর্শী মোদি সর্বাত্মক যুদ্ধের ট্রিগার চাপতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এখন বছর অতিক্রান্ত হয়নি। এর মধ্যে ফ্যাসিবাদের সফট পাওয়ারগুলো সরব হয়ে উঠেছে।
১৯ ঘণ্টা আগেকবি ও গীতিকার কাইফি আজমি সিনেমার গান লেখার একটা অদ্ভুত পদ্ধতির কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদির পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে এই পদ্ধতির বেশ মিল আছে।
১৯ ঘণ্টা আগেপৃথিবীতে ভারতই একমাত্র দেশ, যে দেশটির সঙ্গে তার সব প্রতিবেশীর সম্পর্ক তিক্ততায় ভরা। শুধু তা-ই নয়, ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার এমন একটি ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছে, যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হচ্ছে সংঘাতপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া।
২ দিন আগেফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গত মাসে দেওয়া এক ভাষণে হামাসের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সংগঠনটির সদস্যদের ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দেন। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত ওই ভাষণে তিনি অবিলম্বে হামাসকে অস্ত্র সমর্পণ করার এবং অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান।
২ দিন আগে