ইরানে আগ্রাসন ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য

ব্রি. জে. (অব.) রোকন উদ্দিন
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫, ১২: ৩৪
ব্রি. জে. (অব.) রোকন উদ্দিন

মধ্যপ্রাচ্য আবারও অস্থিরতার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ইসরাইল সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে ইরানের ওপর সামরিক হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে। এই হামলায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ইরানের সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও রয়েছে। জবাবে ইরানও পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যার ফলে প্রতিদিনই উত্তেজনা বেড়ে চলেছে।

এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলী মধ্যস্থতার ভান করে ইরানকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু ইরান সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ইসরাইলকে উপযুক্ত শিক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত তারা কোনো আলোচনায় যাবে না। এ এক ধরনের আঘাত, যার শিকড় ইতিহাসে গাঁথা এবং যার প্রতিধ্বনি আজকের ইরানি জনমানসে গভীরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরাইলের এই আগ্রাসনের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ মদত ছিল। যদিও ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে তা অস্বীকার করছে, কিন্তু বাস্তবতা এবং ইতিহাস একত্র করলে সাধারণ মানুষের কাছে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইতিহাস বলে, ইসরাইল যখন আগ্রাসী হয়, তখন তার পেছনে মার্কিন ছায়া থাকে।

কিন্তু এই ঘটনা শুধুই ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্ব নয়, এটি বৃহত্তর একটি ষড়যন্ত্রের অংশ—একটি সুপরিকল্পিত নীতির বাস্তবায়ন, যার লক্ষ্য হলো মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোকে একে একে দুর্বল করা। আমরা এরই মধ্যে দেখেছি, ইরাক, লিবিয়া, সুদান, আফগানিস্তান ও সিরিয়ার করুণ পরিণতি। এসব দেশের সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে, রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে; আর সবকিছুই ‘গণতন্ত্র’, ‘মানবাধিকার’, কিংবা ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’-এর মোড়কে। আজ সেই একই নীলনকশার পরবর্তী টার্গেট ইরান।

এদিকে ইরানের পতিত রাজা রেজা শাহ’র ছেলে প্রিন্স রেজা পাহলভি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করছেন। প্রবাসে থেকে তিনি ইরানি জনগণকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছেন, যেন পশ্চিমা দাসত্বে ফিরে গিয়ে আবার রাজতন্ত্র কায়েম করা যায়। এটি একটি ঐতিহাসিক চক্রান্তের পুনরাবৃত্তি, যেখানে পশ্চিমা শক্তিগুলো মুসলিম দেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে।

আরো গভীর হতাশার বিষয় হলো—জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বা ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের পক্ষে নীরব সমর্থন দিয়েছে। তারা ভুলে গেছে, আজ যে আগুন ইরানে জ্বলছে, কাল তা তাদের ঘরেও পৌঁছাতে পারে। এই ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতকতা কেবল উম্মাহর ঐক্যকেই ব্যাহত করছে না, এটি ইসলামের মূল আদর্শেরও অবমাননা।

অন্যদিকে রাশিয়া, চীন, তুর্কি ও পাকিস্তান ইরানের পাশে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে—মুসলিমদের সম্মান ও অধিকার রক্ষায় কেন বারবার অমুসলিমদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে? কেন মুসলিম বিশ্ব নিজেদের সম্মিলিত শক্তির ওপর ভরসা করতে পারছে না?

ইতিহাসের আয়নায় তাকালে স্পষ্ট দেখা যায়, পশ্চিমা আগ্রাসন ও মুসলিম উম্মাহর বিভক্তির এই চিত্র কোনো নতুন ঘটনা নয়। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা একটি পুনরাবৃত্তি, যার নেপথ্যে রয়েছে সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক নকশা, সাম্রাজ্যবাদী লোভ এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বহীনতা।

১৯২৪ সালে ওসমানীয় খেলাফতের পতনের মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে একটি গভীর বিপর্যয় নেমে আসে। ছয় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ওসমানীয় খেলাফত মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিরক্ষার প্রতীক ছিল। যদিও খেলাফতের শেষ যুগে রাজনৈতিক দুর্বলতা, ইউরোপীয় প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন প্রবল হয়ে উঠেছিল, তবুও এটি ছিল মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সম্মিলিত শক্তির শেষ সাংগঠনিক কাঠামো। ১৯২৪ সালে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক যখন আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাফত বিলুপ্তির ঘোষণা করেন, তখন গোটা মুসলিম বিশ্ব যেন ছিন্নমূল হয়ে পড়ে।

খেলাফতের পতনের ফলে মুসলমানরা শুধু একটি রাজনৈতিক কাঠামো হারায়নি, তারা হারিয়েছে নেতৃত্ব, আত্মবিশ্বাস ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সম্মানজনক অবস্থান। এই শূন্যতা কাজে লাগায় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা। ব্রিটিশ, ফরাসি ও পরবর্তী সময়ে আমেরিকান শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ে অস্ত্র প্রয়োগ না করেই দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলে।

এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো সাইক্স-পিকো চুক্তি (১৯১৬)। এটি ছিল একটি গোপন ব্রিটিশ-ফরাসি চুক্তি, যেখানে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ভূখণ্ডগুলোকে কৃত্রিমভাবে ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল ইউরোপীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাকের মতো কৃত্রিম রাষ্ট্র, যেগুলোর সীমানা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং বিদেশি স্বার্থের হিসাব করে টানা হয়েছিল।

এরপর আসে বেলফোর ঘোষণা (১৯১৭)—ব্রিটেনের সেই ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেওয়া হয়। এটি ছিল মুসলিম ভূখণ্ডের ওপর সরাসরি একটি বিশ্বাসঘাতকতা, যার পরিণতি আজও রক্তে লেখা হচ্ছে গাজা, পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে।

এই চুক্তিগুলো শুধু কূটনৈতিক কাগজ ছিল না—এগুলো ছিল মুসলিম ঐক্য ধ্বংসের মন্ত্রণা, যার মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়। পশ্চিমারা আমাদের বিভক্ত করে দিল জাতিসত্তা, ভাষা, গোত্র, মাজহাব, জাতীয়তা—এসবের নামে। এরপর তারা নিজেদের পছন্দসই পুতুল শাসকদের বসিয়ে দিল, যারা তাদের প্রভুদের নির্দেশে চলত এবং নিজের জনগণকে শোষণ করত। সেই শাসকদের দায়িত্ব ছিল একটি কাজ—নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং জনগণের মধ্যে এমন বিভাজন জিইয়ে রাখা, যাতে তারা কখনো সংগঠিত না হতে পারে।

ফলাফল যা হয়েছে, তা আজ আমাদের চোখের সামনে একটি অপমানিত, অবহেলিত ও অস্তিত্বসংকটে ভোগা মুসলিম বিশ্ব। পশ্চিমারা অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং সামরিক শক্তিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে; আর মুসলিম উম্মাহ রয়ে গেছে বিভক্ত, দুর্বল ও নির্ভরশীল।

এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান ইরান-ইসরাইল সংকটকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যাবে না। এটি সেই একই ইতিহাসের আধুনিক রূপ—একটিকে দুর্বল করা, অন্যকে দাঁড় করানো, মুসলিমদের পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা।

পশ্চিমা নীতি কখনো পরিবর্তিত হয়নি—‘Divide and Rule.’ তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, আবার নিজেরাই শান্তি-প্রতিষ্ঠার বুলি আওড়ায়।

সুতরাং, যদি মুসলিম উম্মাহ সত্যিকার অর্থে তাদের অতীত ভুল থেকে শিক্ষা না নেয়, যদি নেতৃত্ব, শিক্ষা ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি পূরণ না করে, তবে এই ঐতিহাসিক দাসত্বের চক্র কখনো ভাঙবে না। খেলাফতের পতনের পর যে বিভক্তি শুরু হয়েছিল, তার প্রতিকার এখনো অসমাপ্ত।

আজকের ২১শ শতকেও সেই একই নীলনকশা চলছে। শুধু পাত্র-প্রেক্ষাপট ও অজুহাত বদলেছে। এখন সময় এসেছে মুসলিম উম্মাহর ঘুম ভাঙার। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সবাই একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা আল-ইমরান ৩:১০৩)। রাসুল (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, একসময় মুসলিম উম্মাহ সংখ্যায় অনেক হবে, কিন্তু সমুদ্রের ফেনার মতো দুর্বল হয়ে পড়বে; কারণ তারা দুনিয়াকে ভালোবাসবে এবং মৃত্যুকে ভয় পাবে। আজ সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

আজ আমাদের মধ্যে ঐক্য নেই, নেতৃত্ব নেই, ভবিষ্যৎ চিন্তা নেই। যেসব মুসলিম দেশ শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের মুসলিম ভাইদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা এখনই নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করুক। সাময়িক নিরাপত্তা ও আরাম তাদের রক্ষা করতে পারবে না—না ইতিহাসের বিচারে, না আল্লাহর আদালতে।

এখনই সময় একতা, কৌশল ও সম্মিলিত প্রতিরোধের। ইরানের ওপর আজকের আঘাত—কাল আরেকটি মুসলিম দেশের ওপর পড়বে। একের পর এক শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র ভেঙে পড়ছে। পশ্চিমারা এই কৌশল বোঝে এবং তা বাস্তবায়ন করছে। আমাদের বুঝতে কত দেরি?

মুসলিম দেশগুলোকে এখনই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে—শুধু কথায় নয়, কাজে, কূটনীতিতে, প্রতিরক্ষায় ও অর্থনীতিতে। আমাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, নিজস্ব জোট গঠন করতে হবে, যেগুলো আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলবে, পশ্চিমাদের দয়ায় নয়। আমাদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা আমাদের শত্রুদের আরো সাহসী করে তুলছে। আমাদের ভাঙনই তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

এই বিষয়টি কোনো শিয়া বা সুন্নি, আরব বা অনারবের দ্বন্দ্ব নয়—এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। ইরানের ওপর এই হামলা, প্রতিটি মুসলমানের সম্মানের ওপর হামলা। যদি আমরা এখনো তা না বুঝি, তাহলে একেক করে আমাদের সবারই পতন অনিবার্য।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত