ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল মেগাসিটি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার সন্ধানে এই শহরে আসেন, আর তাদের একটি বড় অংশ থিতু হন বিভিন্ন বস্তিতে—যেগুলোর অধিকাংশই অনিরাপদ, অনিয়ন্ত্রিত ও ন্যূনতম মানবিক সুযোগ-সুবিধাবিহীন। কড়াইল বস্তি এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে আলোচিত। কিন্তু বস্তির নাম এলেই যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি করে, তা হলো অগ্নিকাণ্ড। ঢাকার বস্তিগুলোয় আগুন লাগা যেন একটি দুষ্টচক্রের মতো। বস্তিতে সারা বছর আগুন লাগে, ঘর পুড়ে যায়, তদন্ত কমিটি হয়, সহায়তা ঘোষণা দেওয়া হয়—তারপর আবার সব আগের মতো। যেন বস্তির মানুষের দুর্ভাগ্যও একরকম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। তাই মেগাসিটি বস্তির এই মেটা অগ্নিকাণ্ড আর ক্ষয়ক্ষতির কোনো শেষ নেই।
ঢাকার বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড এক অনন্তচক্রের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। ঢাকায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বস্তিতে বাস করে। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বস্তিগুলোয় প্রতিবছর শতাধিক ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যার মধ্যে কয়েকটি বিপর্যয়কর মাত্রা ধারণ করে। আগুনের কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, গ্যাস সিলিন্ডারের ত্রুটি, দাহ্য উপকরণে নির্মিত ঘরবাড়ি এবং অত্যন্ত ঘিঞ্জি পরিবেশ। কিন্তু কেবল এসব কারণেই আগুন লাগে, এমনটি ভাবলে ভুল হবে। কারণ বস্তিতে আগুনের ঘটনাগুলো বারবার যে সময় ও জায়গায় ঘটে, তা নিয়ে প্রশ্ন অনেক।
কিছুদিন আগে কড়াইল বস্তিতে ভয়ংকর আগুন জ্বলেছিল। কড়াইল বস্তিটি রাজধানীর অভিজাত এলাকার পাশে হলেও এটা যেন তিলোত্তমা ঢাকার অনানুষ্ঠানিক নগরের প্রতিচ্ছবি। গুলশান-বনানীর পাশেই কড়াইল বস্তি। ভাবলে বিস্ময় লাগে, শহরের সবচেয়ে ধনী এলাকার পাশেই অবস্থান করছে সবচেয়ে বড় অনিরাপদ বসতি। প্রায় ৮৫-৯০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই বস্তিতে বসবাস করেন প্রায় ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৮ লাখ মানুষ। জনঘনত্ব বিশ্বের সর্বোচ্চ বস্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঘরগুলো প্রধানত টিন, বাঁশ, কাঠ, প্লাস্টিক ও বিভিন্ন বর্জ্য উপাদান দিয়ে তৈরি। ফায়ার সার্ভিসের ভাষায় এটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। তবুও বছরের পর বছর কোনো টেকসই উন্নয়ন হয়নি।
২০০৪ সাল থেকে কড়াইল বস্তিতে ১২টিরও বেশি বড় ধরনের আগুন লেগেছে। ২০১২, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২১—প্রায় প্রতি বছরই বস্তির কোনো না কোনো অংশ পুড়িয়ে দিয়েছে আগুন। প্রতিবারই শত শত ঘর ভস্মীভূত হয়, হাজার হাজার মানুষ রাতারাতি গৃহহীন হয়ে পড়ে, আর প্রতিবারই বলা হয়, এই আগুন নাকি দুর্ঘটনা!
এখানেই মেটা অগ্নিকাণ্ড কথাটির গুরুত্ব। কেননা আগুন শুধু ঘর পুড়িয়ে দেয় না; এটি নগর ব্যবস্থাপনা, আবাসন নীতি, দখল রাজনীতি, ভূমির মালিকানা, শ্রমবাজার ও বৈষম্যের স্থায়ী সংকটগুলোর ওপর আলো ফেলে দেয়।
মেগাসিটি ঢাকার বস্তির অগ্নিকাণ্ড ক্রমান্বয়ে কেন ‘মেটা’ সংকটে পরিণত হয়েছে? মেটা অগ্নিকাণ্ড বলতে বোঝানো হচ্ছে, এটি আর কেবল আগুন নয়। এটি আগুনের চেয়েও বড় একটি কাঠামোগত, মানবিক ও নীতিগত ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। এর তিনটি প্রধান কারণ হচ্ছে—
১. কাঠামোগত বৈষম্য : মেগাসিটির কেন্দ্রেই বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, শপিং মল ও আকাশচুম্বী ভবন; কিন্তু তাদের সেবা দেওয়া শ্রমিকদের থাকতে হয় টিনশেড, ঘিঞ্জি ও আগুন লাগার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে। এই বৈষম্যই আগুনকে শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, সামাজিক অন্যায়ের প্রতীক করে তোলে।
২. অনিরাপদ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক আবাসন : এখানে অধিকাংশ বস্তিতে বৈদ্যুতিক সংযোগ অবৈধ ও অনিয়ন্ত্রিত। গ্যাস সিলিন্ডার অযাচিতভাবে ব্যবহৃত হয়, ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই এবং জরুরিভাবে বের হওয়ার পথ নেই। ঘরগুলো একে অপরের সঙ্গে লেগে লেগে তৈরি। ফলে আগুন লাগলে তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বলতে থাকে।
৩. তদন্তের স্বচ্ছতার অভাব : প্রতিটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও অধিকাংশ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় না। যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে সন্দেহ তৈরি হয়—কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কি এসব অগ্নিকাণ্ডকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে?
কড়াইল বস্তির ভূমি মালিকানা জটিল। এটি মূলত সরকারি বিভিন্ন সংস্থার নামে নিবন্ধিত। দীর্ঘদিন ধরে এখানে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও স্থানীয় প্রভাবশালী দখলচক্র সক্রিয়। ফলে এসব বস্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া যায় না। এদের বাসিন্দাদের স্থায়ীভাবে রাখা হয় না। ফলে পুনর্বাসন পরিকল্পনা বারবার আটকে যায়। এ কারণেই আগুন লাগার পর দ্রুত জায়গা খালি করার বিভিন্ন উদ্যোগকে বস্তিবাসী সন্দেহের চোখে দেখেন।
এসব অগ্নিকাণ্ডে বস্তির শিশুদের বেশি ক্ষতি হয়, কারণ এই শিশুরা স্কুলবই হারায়। নারীরা কাজের কাপড়, বাসন ও নথিপত্র হারায়। বস্তি এলাকার ছোট ব্যবসাগুলো ধ্বংস হয়, মানুষ মানসিক আঘাত পায় এবং কর্মসংস্থান ব্যাহত হয়। বস্তির মানুষ কয়েক দিন পর আবার একই ঝুঁকিপূর্ণ ঘর তৈরি করে, কারণ তাদের যাওয়ার জায়গা কোথাও নেই।
তাই বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দরকার। শুধু কিছু চাল বা কম্বল দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হয় না। সরকারি এসব খাসজমি কাউকে দখল করতে না দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের বসতঘর পুনর্নির্মাণে সহায়তা করা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা আবার দাঁড় করানো প্রয়োজন। বস্তির শিশুদের শিক্ষায় ফেরানো, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা—এসব বেশি প্রয়োজন।
আগুনের চেয়েও ভয়ংকর যেটি, সেটি হলো শহুরে জীবনের বড় সংকটের জন্মদাতা এসব দুর্ঘটনা। ঢাকার বস্তির অগ্নিকাণ্ড এখন মানবিক, সামাজিক, কাঠামোগত ও রাজনৈতিক সংকটের বহুমাত্রিক প্রতিফলন। কড়াইলের মতো বস্তিগুলোর আগুন যখন রাতের আকাশ লাল করে তোলে, তখন সেটি শুধু একটি বস্তির চিত্র প্রকাশ করে না। সেটি এই শহরের বৈষম্য, অদক্ষতা ও অবহেলার কঠিন সত্যকে উন্মোচন করে।
মেগাসিটি ঢাকার আকাশে ধোঁয়ার কালো রেখা এখন আর কারও জন্যই বিস্ময় সৃষ্টি করে না। ঢাকার বস্তিগুলোতে প্রায় ৪০ লাখের বেশি মানুষ মেগাসিটির সব প্রয়োজনীয় শ্রমসেবার জোগান দেন এবং পরিবহন, গার্মেন্ট, কনস্ট্রাকশন, পরিষেবা খাতসহ নানা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রতিদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের বসবাসের জায়গাটা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, সবচেয়ে অরক্ষিত এবং সবচেয়ে অবহেলিত। এক টুকরো স্পার্ক অনেক সময় চোখের পলকে হাজার হাজার মানুষের সব স্বপ্ন ছাই করে দেয়।
এজন্য বাংলাদেশের নগরায়ণকে কেন্দ্রীয়ভাবে বিশৃঙ্খল বলা হয়। রাজধানী ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ বেড়ে গেলেও আবাসননীতি বাস্তবায়নে দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা আছে। নগরে গরিবদের বসবাসের অধিকার এখানে এখনো বিতর্কিত বিষয়। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রায়ই বাস্তুচ্যুতি ঘটায়, কিন্তু পুনর্বাসনের কাঠামো থাকে নড়বড়ে বা অনুপস্থিত। ফলে মানুষ বস্তিতে ফিরে আসে, আবার অনিরাপদভাবে বসবাস শুরু করে; কিছুদিন পর আগুনে সব হারায়।
এখানে আরেকটি গভীর শঙ্কা বারবার সামনে আসে—তা হচ্ছে দখলচক্র। বিভিন্ন সময় বস্তিতে আগুন লাগার পরপরই দেখা গেছে, সেই জায়গা দ্রুতই অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও এটি সব বস্তির ক্ষেত্রে সত্য নয়, কিন্তু পর্যবেক্ষিত ঘটনা মানুষকে সন্দেহের জায়গা তৈরি করে দেয়।
এজন্য প্রথম করণীয় হচ্ছে, বস্তিবাসীকে অস্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে। তারা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ শ্রমশক্তি; তাদের নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে পরিকল্পিতভাবে বহুতল আবাসন নির্মাণ এবং বস্তি উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়ন হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন। বস্তিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট, প্রশস্ত পথ, নিয়মিত বৈদ্যুতিক সংযোগ পরিদর্শন, গ্যাসের নিরাপদ ব্যবহার—এসব মৌলিক ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।
তৃতীয়ত, তদন্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি বড় অগ্নিকাণ্ডের রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা জরুরি। দোষীদের শাস্তি হলে ভবিষ্যতে কেউ আর স্বার্থের জন্য আগুন ব্যবহার করার সাহস পাবে না। চতুর্থত, বস্তিবাসীর অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
অন্তত একটি প্রশ্ন আমাদের করা উচিত, মেগাসিটি যদি সবাইকে ধারণ করতে পারে, তবে কেন বস্তিবাসীকে নিরাপত্তার বাইরে রাখা হবে? নগর উন্নয়নের কেন্দ্রীয় দর্শন হওয়া উচিত, কেউ বাদ যাবে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর গড়ে তুলতে হলে প্রথমে বস্তিবাসীর নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জীবনের মূল্যও সমান। তাদের স্বপ্নও সমান। তাদের ভবিষ্যতও সমানভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত।
আগুনের লেলিহান শিখা যেমন মুহূর্তে সব নিভিয়ে দিতে পারে, ঠিক তেমনই সঠিক নীতিনির্ধারণ ও মানবিক নগর পরিকল্পনা অনেক মানুষের জীবনকে বাঁচাতে পারে। যতদিন না আমরা আগুনের উৎস না খুঁজে আগুনের জন্ম দেওয়া কাঠামোগত বৈষম্য, অনিয়ম, দখলনীতি, আর অবহেলাকে আগুনের মতোই নিভিয়ে ফেলি, ততদিন আগুন থামবে না। মেগাসিটি ঢাকাকে শুধু আয়তনে বাড়ানোই যুক্তিযুক্ত নয়, ন্যায়সংগত ও মানবিক শহর হিসেবে পুনর্গঠনেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মানবিকতার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা হলে এসব অগ্নিকাণ্ডসংশ্লিষ্ট ঘটনার বিরুদ্ধে সার্বিকভাবে লড়াই করা সম্ভব।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd

