বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের কৃষি ছিল পারিবারিক চাহিদানির্ভর। পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য কৃষিকাজ করা হতো। সময় গড়াতে থাকল। এখন বাংলাদেশের কৃষি সেই পারিবারিক স্বনির্ভরতার গণ্ডি পার করে শিল্পভিত্তিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কৃষি এখন বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করেছে, যার ফলে আমরা এখন ফসল উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরের দেশে রপ্তানি করছি। অপরদিকে পর্যটনশিল্প বাংলাদেশের একটি বিকাশমান ও সম্ভাবনাময় শিল্প। এক্ষেত্রে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে যদি কৃষির সেতুবন্ধ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে পর্যটনশিল্প নগরভিত্তিক কাঠামোর পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক এলাকাগুলোয় সম্প্রসারিত হবে। এতে করে কৃষকরা তাদের জমিগুলোকে পর্যটনের একটি গন্তব্যে পরিণত করতে পারবে এবং আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের যেকোনো মৌসুমেই সবুজ ও সজীবতা প্রকৃতির মাঝে বিদ্যমান। কৃষিভিত্তিক পর্যটন হলো অবকাশ যাপনের এমন এক মাধ্যম, যেখানে কৃষি খামারগুলোয় আতিথেয়তার পাশাপাশি কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে। কৃষি পর্যটন কৃষকদের জন্য আয়ের নতুন ও উদ্ভাবনী পথ সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি কৃষক খাদ্যশস্য সরবরাহের জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী গ্রামগুলোয় বসবাস করছেন। এরপরও আমাদের জিডিপিতে কৃষির অবস্থা আশানুরূপ নয়। কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ (শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২, বিবিএস) হলেও জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ। এক্ষেত্রে আমাদের সুযোগ রয়েছে বিদ্যমান কৃষিব্যবস্থায় অতিরিক্ত উপার্জনমূলক কার্যক্রম যুক্ত করার। এতে আমাদের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান আরো বাড়বে।
বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক পর্যটন একটি নতুন ধারণা হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধারণাকে মাথায় রেখে কার্যক্রম শুরু হয়েছে আরো আগে থেকে। বিভিন্ন দেশে পর্যটনের সম্প্রসারণের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ এবং এর বহুমুখী ব্যবহার চোখে পড়ে। এর মধ্যে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, চীন, রাশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো উল্লেখযোগ্য। এ দেশগুলো কৃষি পর্যটনের ধারাকে গ্রহণ করে এর বিকাশে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। থাইল্যান্ডে হোমস্টে এবং জৈব খামারের প্রচারের মাধ্যমে কৃষি পর্যটনের বিকাশ ঘটছে। তারা পর্যটকদের স্থানীয় পরিবারের সঙ্গে থাকার, গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী রান্নার সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়ার সুযোগ করে থাকে। এ রকম আরেকটি উদাহরণ হলো ফ্রান্সের প্যারিস থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার অদূরে অবস্থিত লাকুলুয়ে দো সারজি এলাকায় গড়ে ওঠা একটি কৃষি খামার। এখানে বিভিন্ন ধরনের ফল, ফসল ও শাকসবজি উৎপাদন করা হয়। পর্যটকরা সরাসরি ভ্রমণ করে পছন্দের পণ্য সংগ্রহ করে নিতে পারেন।
বাংলাদেশে কৃষি পর্যটনের বর্তমান পরিস্থিতি ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষিভিত্তিক পর্যটন এখনো একটি নতুন ধারণা। কৃষিপ্রধান এ দেশে কৃষি পর্যটনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কৃষি পর্যটনের জন্য রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। আঞ্চলিক কৃষিবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে নিম্নলিখিত কৃষি পরিষেবাগুলোর উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা রয়েছে—
চা-বাগানকেন্দ্রিক ভ্রমণ : বাংলাদেশে কৃষি পর্যটনের স্থানের কথা বললে প্রথমেই আসবে চা-বাগানকেন্দ্রিক স্থানগুলো। পাহাড়ি এলাকার চা-বাগান থেকে শুরু করে সমতলের চা-বাগানগুলো ভ্রমণের মাধ্যমে পর্যটকরা এখানে চা-বাগানকেন্দ্রিক সব কাজকর্ম এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রামের পাহাড়ের ঢালের চা-বাগান এবং নীলফামারী ও পঞ্চগড়ের সমতল এলাকার চা-বাগানের চমৎকার সৌন্দর্য শুধু দেশীয় পর্যটক নয়, বিদেশি পর্যটকদেরও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে।
কৃষিবাজার ভ্রমণ : বাংলাদেশের ভাসমান পেয়ারা বাজার জলের দেশ বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের বিভিন্ন জায়গায় বসে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ভিমরুলি, আটঘর ও কুড়িয়ানা বাজার। শত বছরের পুরোনো ঝালকাঠি জেলার ভিমরুলির ভাসমান পেয়ারা বাজার একটি ব্যতিক্রমী কৃষিবাজার। বর্ষার ভরা মৌসুমে শত শত পেয়ারাভর্তি নৌকা খালের ওপর একত্র হয়ে বেচাকেনা করে, যা পর্যটকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। অনেকে ভাসমান এই বাজারগুলোকে থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেটের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।
ফলবাগান ভ্রমণ : ফলবাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এবং ফলের স্বাদ নিতে বাগান থেকে নিজে ফল সংগ্রহ ও ক্রয় করতে ফলের বাগানে ভ্রমণ করা যায়। ফলবাগানকেন্দ্রিক এ কার্যক্রম বাংলাদেশের পর্যটকদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগান, নরসিংদীর লটকন বাগান, দিনাজপুরের লিচুবাগান ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির পেয়ারা বাগান এ ধরনের ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
ফুলের বাগানকেন্দ্রিক ভ্রমণ : বাংলাদেশে ফুলের বাগানকেন্দ্রিক পর্যটনও বিকশিত হচ্ছে। ফুলের জন্য বিখ্যাত যশোরের গদখালীর ফুলচাষের এলাকাগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এছাড়া সাভারের বিরুলিয়ায় আছে ‘গোলাপ গ্রাম’, যেখানে একসঙ্গে বিভিন্ন রকমের গোলাপের সৌন্দর্য দর্শনার্থীরা উপভোগ করতে পারে। শীত মৌসুমে সূর্যমুখীর জমি দেখতেও ভিড় লেগে যায়। ফরিদপুর সদরের ধর্মকান্দিতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সূর্যমুখী ফুলের খামার দেখতেও অনেক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরেও সূর্যমুখীর চাষকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ফুলকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশের সুযোগ রয়েছে।
ভাসমান কৃষিব্যবস্থা : বাংলাদেশের ভাসমান চাষের ঐতিহ্য শত বছরের পুরোনো। চাষাবাদ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জের অববাহিকায় প্লাবনভূমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। আমাদের আদি কৃষি ঐতিহ্যের বিবেচনায় ২০১৫ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা দক্ষিণের ভাসমান চাষব্যবস্থাকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এখানে পর্যটকদের নৌকায় ভ্রমণের পাশাপাশি অরগানিক শাকসবজি ও ফলের স্বাদ নিতে পারার সুযোগ রয়েছে। এগুলো ছাড়াও কৃষি বনায়ন পরিদর্শন, শীত মৌসুমে সরষেক্ষেত, মৌচাষ, মধু আহরণ, হাওর এলাকায় মাছ ধরা ও মৎস্য খামার পরিদর্শনও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
বেসরকারি উদ্যোগ
বাংলাদেশে কৃষি পর্যটন খাতটি এখনো পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। বেসরকারি কিছু উদ্যোগ উদাহরণ সৃষ্টি করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কৃষিভিত্তিক কিছু ইকোট্যুরিজম ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ফলবাগানকেন্দ্রিক এ বাগানগুলো অবকাশ কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে আলভিনা গার্ডেন নামের এক কৃষি পর্যটন কেন্দ্র। উঁচুনিচু টিলার ভাঁজে ভাঁজে সারি সারি আনারস, কমলা, মাল্টা ও লেবু গাছ। এর সঙ্গে রয়েছে কফিগাছ ও কাজুবাদাম। পর্যটকরা সেখানে টাটকা ফল ও ফলের জুস উপভোগ করতে পারেন। পরিকল্পিতভাবে ১৭ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ খামার কৃষি ও পর্যটনকে সফলভাবে সমন্বিত রূপ দিতে পেরেছে।
কৃষি পর্যটনের পণ্য ও পরিষেবা
খামারে রাতযাপন : শহুরে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য কৃষি খামারে নিরাপদ ও আরামদায়ক রাতযাপনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কৃষি পর্যটন পরিষেবা প্রদানকারীরা বিভিন্ন ধরনের অবকাশ যাপনের সুবিধা প্রদান করতে পারে; যেমন কৃষি খামারে থাকা, কটেজে থাকা, কৃষিভিত্তিক ক্যাম্পিং প্রভৃতি।
ইউ পিক কার্যক্রম : কৃষকরা তাদের খামারে উৎপাদিত কৃষিপণ্য (যেমন : ফল, সবজি ইত্যাদি) নিজ হাতে আহরণের জন্য পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানাতে পারে।
অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম মডেল : অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে পর্যটকরা সরাসরি কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। এ মডেলের মাধ্যমে পর্যটকরা প্রকৃত কৃষিকাজের অনুভূতি লাভ করতে পারবে। পর্যটকদের যেভাবে আকর্ষণ করা যেতে পারে—১. ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ (যেমন জমিতে ধানের বীজ বা চারা রোপণ)। ২. গবাদি পশুপালন পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ—হাঁস-মুরগি পালন, ভেড়া পালন, গবাদি পশুর মজুদ নিলাম করা প্রভৃতি। উৎপাদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে মহিষের দুধ থেকে দই তৈরি, গরুর দুধ দোহনে সাহায্য করা প্রভৃতি অংশগ্রহণমূলক কৃষি পর্যটনের উদাহরণ।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় : কৃষি পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা হলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য দেখা এবং কেনার সুযোগ তৈরি হওয়া। এটি গ্রামীণ কৃষিজ পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে কৃষি পর্যটন খাতের বিপুল সম্ভাবনা আছে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, যে সেক্টরে সম্ভাবনা আছে, সেখানে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকবে। কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা সামনে চলে আসবে। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা কৃষি পর্যটনের বিকাশের পথে অন্তরায়।
অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা : বাংলাদেশের কৃষি পর্যটন এলাকাগুলো সাধারণত গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। গ্রামীণ এসব এলাকায় ভ্রমণের জন্য আরামদায়ক এবং নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার দুর্বলতা রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও মানসম্মত পানীয় জলের অপ্রতুলতা রয়েছে। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে গ্রামীণ এসব এলাকায় ইন্টারনেট ব্যবস্থা দুর্বল, যা পর্যটকদের আগমনকে ব্যাহত করে। এছাড়া পর্যটকরা একটি গন্তব্যে এসে শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে চান না, সেইসঙ্গে তারা চান একটি নিরাপদ ও আরামদায়ক আবাসন ব্যবস্থা। এটি গ্রামীণ এলাকায় অভাব রয়েছে। আবাসন ব্যবস্থা থাকলেও তা মানহীন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব হোটেলে নিরিবিলি ও মানসম্মত থাকার কোনো সুযোগ নেই।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত : কৃষি পর্যটন ও ফসল—একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের কৃষির উৎপাদন চক্র আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল বলে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের (যেমন বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি) কারণে ফসলের ক্ষতি হলে পর্যটন আকর্ষণ স্বাভাবিকভাবেই ব্যাহত হবে। অপরদিকে কৃষকের উৎপাদন ব্যবস্থা যদি টেকসই না হয়, তাহলে তা পর্যটক আকর্ষণে ব্যর্থ হবে। ফলে কৃষি পর্যটনকে টেকসই করতে হলে কৃষককে পরিবেশবান্ধব কৃষির চর্চা করতে হবে।
জনসচেতনতার অভাব, দক্ষতা ও উৎসাহের ঘাটতি : কৃষি পর্যটন বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন। কৃষক ফসল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সার্বিক বিষয়টিকে যে পর্যটনে রূপান্তর করা যেতে পারে—এ বিষয়টি বেশিরভাগ কৃষকের কাছে অজানা। উৎপাদিত ফসলে ভ্যালু অ্যাড করা অথবা প্রক্রিয়াজাত করার ব্যাপারে কৃষকের উৎসাহ কম। সেইসঙ্গে এ ব্যাপারে কৃষকের দক্ষতাও নেই। বিষয়টি কৃষি পর্যটনের বিকাশের পথে অন্তরায়। প্রচারণা বা মার্কেটিং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের ফলবাগান কিংবা ফুলের আবাদ কিংবা হাওড় কৃষিব্যবস্থা—এগুলো প্রচার-প্রচারণার অভাবে পর্যটন হাবে পরিণত হতে পারছে না।
ব্যবস্থাপনা কৌশল
বাংলাদেশের কৃষি পর্যটন খাতকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিণত করতে হলে একক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হবে না। এর জন্য প্রয়োজন হবে একটি বহুমুখী ও সমন্বিত রোডম্যাপ, যেটি অনুসরণের মাধ্যমে আমাদের কৃষি পর্যটন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।
অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন : সম্ভাব্য কৃষি পর্যটন কেন্দ্রগুলো সবার আগে নির্ধারণ করে নিতে হবে। সেগুলোর সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। রাস্তাঘাট নির্মাণসহ আরামদায়ক ও নিরাপদ পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। দ্রুত গতির ইন্টারনেট সুবিধার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শুধু যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালে চলবে না, নিরাপদ ও আরামদায়ক আবাসনব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। পরিবেশবান্ধব ইকো রিসোর্ট অথবা কৃষকের বাড়িতে থাকার জন্য ‘ফার্ম স্টে’ মডেল—এসব নতুনত্ব সৃষ্টি করতে পারলে কৃষি পর্যটন আরো বেগবান হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রচারণা কৌশল : বাংলাদেশের কৃষি একেক অঞ্চলে একেক রকম। কৃষির এই আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে চিহ্নিত করে ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে প্রচারণা চালাতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো কৃষি পর্যটনের গুরুত্ব এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মিডিয়া কাভারেজ দিতে পারে। নতুন প্রজন্মের কাছে কৃষি, কৃষক, গ্রামীণ সমাজ—এগুলো সম্বন্ধে শিক্ষামূলক তথ্য তুলে ধরতে পারে।
সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা : কৃষি পর্যটনকে টেকসই করতে হলে শুধু সরকারের কাজ করলে হবে না, বেসরকারি উদ্যোগও প্রয়োজন। ইকো রিসোর্ট, ফার্ম স্টে, এক দিনের প্যাকেজ ট্যুর—এসবের মাধ্যমে পর্যটকদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যে ভ্যালু অ্যাড করতে পারলে তা পর্যটকদের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করবে। গ্রামীণ ঐতিহ্যকে (যেমন নবান্ন উৎসব, পিঠা উৎসব, লোকজ মেলা প্রভৃতি) সংরক্ষণ করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলো দেশীয় পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের মাঝে অতিরিক্ত আকর্ষণ সৃষ্টি করবে।
কৃষি পর্যটন বাংলাদেশের জন্য একটি উদীয়মান খাত। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে আমাদের অপার সম্ভাবনা রয়েছে এই খাতকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরার। ‘আউট অব বক্স কনসেপ্ট’ এই কৃষি পর্যটন, কৃষি ও পর্যটন—এ দুইয়ের মাঝে সমন্বয়সাধন করে কৃষকদের আয়ে বৈচিত্র্য এনে গ্রামীণ অর্থনীতিকে বেগবান করতে পারে। এতে করে কৃষি পর্যটনের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিতে পরিণত হবে।
লেখক : উপজেলা কৃষি অফিসার, লক্ষ্মীপুর সদর, লক্ষ্মীপুর

