পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংঘাত একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত তার সর্বশেষ ‘সাহসিকতা প্রদর্শন’ করে গত মে মাসে ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর মাধ্যমে। অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে গত এপ্রিল মাসে কথিত একটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর ভারত-পাকিস্তানে অপারেশন সিন্দুর অভিযান পরিচালনার নামে এই হামলা চালায়। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এই অভিযানে তারা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখাজুড়ে সন্ত্রাসী অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর তারা দেশটির দীর্ঘদিনের অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষ নীতি পরিত্যাগ করে ভারতকে একটি উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক হিসেবে তুলে ধরেছে। মোদি সরকারের এই নীতির প্রভাব পড়েছে দেশটির সেনাবাহিনীর ওপরও। ফলে ভারতের একসময়কার ধর্মনিরপেক্ষ, সুশৃঙ্খল ও পেশাদার সেনাবাহিনীকে বিজেপি ও মোদি সরকার ‘গেরয়াকরণ’ করে ফেলছে। একটি দেশের সেনাবাহিনী যখন কোনো কট্টরপন্থি দলের আদর্শের প্রভাবে প্রভাবিত হয়, তখন তার পরিণতি হতে পারে বিপজ্জনক। একটি আদর্শিক সামরিক সেনাবাহিনী শুধু ভারতের জন্যই অভ্যন্তরীণ উদ্বেগ নয়, এটি একটি আঞ্চলিক বিপদও হয়ে ওঠে।
ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা কয়েক দশক ধরেই নিজেদের পেশাদারিত্বকে রাজনীতির আবেগ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছিলেন। রাজনীতিবিদরা তাদের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ বা আখ্যান সশস্ত্র বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা করতেন না। কিন্তু দীর্ঘদিনের সেই ভারসাম্য বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে এসে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। এখন তারা নিজেদের দলীয় স্বার্থে দেশটির সেনাবাহিনীকেও ধর্মীয় আবেগের আচ্ছাদনে আবৃত করছে। এই বাহিনীকে একটি গেরুয়া বাহিনীতে পরিণত করার অপপ্রয়াস চলছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে, সেখানে মোদি সরকার ভারতের সেনাবাহিনীকে ধর্মীয় আবেগে উদ্বুদ্ধ করে আসছে।
হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে গেরুয়া রঙ। এটি হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ রঙগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রাচীনকালে ঋষি-তপস্বীরা এই রঙের পোশাক পরতেন। হিন্দু ধর্মের প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী মনে করা হয়, এই রঙ মানুষের জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। অনেক মন্দিরে গেরুয়া রঙের পতাকা ব্যবহার করা হয়। হিন্দু ধর্মের অনেক অনুষ্ঠানেও গেরুয়া রঙের ব্যবহার করা হয়। মারাঠা সেনাপতি শিবাজির সেনাবাহিনী গেরুয়া রঙের পতাকা ব্যবহার করত। গেরুয়া রঙের সঙ্গে হিন্দুদের দেবতা শিবেরও যোগ রয়েছে এবং এই রঙ হনুমানেরও অত্যন্ত প্রিয় ছিল বলে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয়। নানা কারণেই হিন্দু ধর্মে গেরুয়া বঙের প্রাধান্য বেশি। ক্ষমতাসীন বিজেপি নিজেদের দলীয় স্বার্থে হিন্দুদের ধর্মীয় এই আবেগকে কাজে লাগাচ্ছে। এমনকি তারা দেশটির সেনাবাহিনীকেও গেরুয়া বাহিনীতে পরিণত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভারতের সামরিক বাহিনীতে এই পরিবর্তনটি নীরবেই শুরু হয়েছিল। ২০২৫ সালের শুরুর দিকে সেনাপ্রধান তার বসার ঘর থেকে ১৯৭১ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের একটি চিত্রকর্ম সরিয়ে সেখানে এমন একটি বিষয় স্থাপন করেন, যেটাতে কৃষ্ণ, চাণক্য এবং আধুনিক অস্ত্রের মিশ্রণের চিত্রকর্ম ছিল। এটি শুধু সাজসজ্জার পরিবর্তন ছিল না, বরং ভারতের সামরিক নেতৃত্বকে কী ধরনের চিত্রকর্ম এবং পরোক্ষভাবে কোন ধরনের আদর্শের দ্বারা চিত্রিত করা উচিত, এটি ছিল তার একটি ঘোষণা। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ দায়িত্বে থাকার সময় তার অফিসে বিখ্যাত ব্রিটিশ জেনারেলদের প্রতিকৃতি রাখতেন। কিন্তু দেশটির বর্তমান সামরিক নেতৃত্ব সেই ঐতিহ্যকে উল্টে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলে চীনা, পাকিস্তানি এবং ভারতীয় সৈন্যরা নিজ নিজ সীমানার মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। সেখানে ভারতীয় সীমান্তে একটি কৌশলগত করিডোরের উপরে এখন শিবাজির একটি সুউচ্চ মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, যার গায়ে গেরুয়া পতাকা লাগানো। শিবাজির মূর্তির এই উপস্থিতি আকস্মিক নয়, বরং পরিকল্পিতভাবেই এটি স্থাপন করা হয়েছে। গেরুয়া পতাকা লাগানো শিবাজির এই মূর্তির মাধ্যমে সীমান্তের ভারতীয় সেনাদের মনোজগতেও গেরুয়া রঙের প্রতি দুর্বলতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।
এই পরিবর্তন শুধু পাথর এবং ইস্পাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আচার-অনুষ্ঠান এবং আচরণের মধ্যেও প্রবেশ করছে। উর্দি পরিহিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হিন্দু অনুষ্ঠান পরিচালনা করার কথা একসময় কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু এখন তা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং এই বিষয়গুলো খুব কমই খবরে আসে। যখন সেনাপ্রধান একজন হিন্দু গুরুর কাছ থেকে প্রকাশ্যে দীক্ষা (আধ্যাত্মিক প্রবর্তন) গ্রহণ করেছিলেন, তখন এটিকে ব্যক্তিগত ভক্তিমূলক কাজ বলে উড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু ধর্মগুরু যখন ঘোষণা দেন, সেনাপ্রধানের ‘আজাদ কাশ্মীরকে ধর্মীয় উৎসর্গ হিসেবে পুনরুদ্ধার করা উচিত’ তখন তা স্পষ্ট করে দেয় যে, সেনাবাহিনীতে এ ধরনের বাগাড়ম্বর কতটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
এমনকি সিন্দুর, মহাদেব এবং ত্রিশূল নামে সেনা অভিযানের নামকরণের রীতিনীতিও আদর্শিক প্রতীকের সঙ্গে কৌশলগত সিদ্ধান্তের ক্রমবর্ধমান মিশ্রণকেই প্রতিফলিত করে। ভৈরব ব্যাটালিয়ন নামে ব্যাটালিয়নের সৃষ্টি, যা শিবের ভয়ংকর প্রকাশকে তুলে ধরে। এসব ঘটনা স্পষ্ট করে দেয়, ধর্মীয় রূপকগুলো এখন সামরিক বাহিনীর মধ্যেও কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে।
এই নামগুলো অলংকারিক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু যেখানে সংস্কৃতি সেনা কমান্ডের গঠনকে প্রভাবিত করে, সেখানে নামগুলো গুরুত্বপূর্ণ। গেরুয়াকরণের আদর্শিক এই পাইপলাইনটিও প্রসারিত হচ্ছে। অগ্নিপথ নিয়োগ প্রকল্প যেটি স্বল্পমেয়াদি এবং আর্থসামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে, তা ইতোমধ্যেই কট্টর দক্ষিণপন্থি, হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গে সম্পর্কিত তরুণদের আকর্ষণের একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
আরএসএস দীর্ঘদিন ধরেই সামরিক বাহিনী ও বিস্তৃত নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে হিন্দু সভ্যতার মূল্যবোধ প্রতিফলিত করার পক্ষে কথা বলে আসছে। ভবিষ্যতের অফিসার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যেমন সৈনিক স্কুলগুলোয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রভাব বাড়ছে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তন, যা আগামী দিনের সংকটের নেতৃত্বদানকারী অফিসারদের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করছে।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা ও গেরুয়াকরণের চাপ সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভব করেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অফিসাররা। শিখ, মুসলিম এবং খ্রিষ্টান সেনাসদস্যদের ‘ইউনিট বন্ডিং’ নামে পরিচিত হিন্দু অনুষ্ঠানগুলোয় যোগ দেওয়ার কীভাবে প্রবল চাপের সম্মুখীন হন, তার বর্ণনা বিভিন্ন সময় তারা দেন। হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য গত বছর লেফটেন্যান্ট স্যামুয়েল কমলেসান নামে একজন খ্রিষ্টান অফিসারকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। এ ঘটনা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে গেরুয়াকরণের একটি স্পষ্ট সত্য প্রকাশ করেছিল। আর সেই সত্যটি হচ্ছে—বাহিনীর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ ভিন্নমত আক্রমণের শিকার হচ্ছে।
যে সামরিক বাহিনী তার ভিন্ন ধর্মের সংখ্যালঘু সদস্যদের হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক সংগতি বজায় রাখতে বাধ্য করছে, তারা শুধু সাংবিধানিক আদর্শই ত্যাগ করছে না, বরং তারা সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ পরিবেশকেও এমনভাবে পুনর্গঠন করছে, যা অনিবার্যভাবে তার বাহ্যিক আচরণেও ছড়িয়ে পড়ছে এবং তারা ইতোমধ্যেই তা করছে।
ভারতের এসব কর্মকাণ্ডের ওপর বিশ্ব এখন নজর রাখছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তার উচ্চমাত্রার শুল্ক আরোপের হুমকি ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু নয়াদিল্লি দ্রুতই তার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ নিয়ে এই ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী এই বিতর্কটি ছিল বেশ উপভোগ্য। বিশ্লেষকরা এখন আর এটা ধরে নিচ্ছেন না যে, ভারতের সামরিক সিদ্ধান্তগুলো শুধু কৌশলগত, সেগুলো তারা আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন। এসব কারণে একসময় ভারতের সামরিক বাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সীমান্ত এখন পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এখানে একটি ভুল বোঝাবুঝির যেকোনো সময় শান্তির অবসান ঘটাতে পারে। সংঘর্ষের ঘটনাগুলো পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ প্রবেশ করানোর মাধ্যমে বাহিনীকে হিন্দু-মুসলিম লাইনে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। আর এই বিভাজন একটি অঞ্চলে আগুন নিয়ে খেলছে।
ভারতের নিজেকে সুরক্ষিত করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কিন্তু কৌশলের চেয়ে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে নিরাপত্তা বজায় রাখার চেষ্টা অনিবার্যভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না। সেনাবাহিনী ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, কিন্তু যদি এটি গেরুয়া পরিচয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে এটি সাংবিধানিক কর্তব্যের পরিবর্তে রাজনৈতিক ইচ্ছার হাতিয়ার হয়ে ওঠার ঝুঁকিতে রয়েছে।
সামরিক বিষয়ে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের জন্য মোদি সরকার দেশে বাহবা পেলে তা হয়তো জোরেশোরে শোনা যাবে। তবে বিদেশে এর পরিণতি হবে বিপজ্জনক। ধর্ম ও দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো সামরিক বাহিনী শুধু গণতান্ত্রিক ক্ষয়ের প্রতীক নয়, একই সঙ্গে এটি একটি কৌশলগত ত্রুটিও। পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাত থেকে এখন এটি স্পষ্ট যে, ত্রুটির রেখাটি অনেকের ধারণার চেয়ে বেশি দ্রুত এবং অনেক বেশি বিপজ্জনকভাবে প্রসারিত হচ্ছে, যা এই অঞ্চলের পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না।
এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর
মোতালেব জামালী


হাদির ওপর হামলাকারীরা ভারতের আসামে আশ্রয় নিয়েছেন
১২ বছর ধরে হাত-পা বাঁধা প্রতিবন্ধী অভিজিৎ
গ্রেপ্তার মোটরসাইকেল মালিক সম্পর্কে যা জানা গেল