বাংলাদেশ বর্তমানে একটি বড় মাত্রার সংকটকাল অতিক্রম করছে, যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য একে অন্যের সঙ্গে মিশে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্বাভাবিক ধারাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়ত এ সমস্যাগুলোর শিকার অথচ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার লড়াইয়ে বিভক্ত। নির্বাচনের সময় নেতারা জনগণের উন্নয়নসহ নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিলেও, ক্ষমতায় আসার পর সেসব প্রতিশ্রুতি অকার্যকর হয়ে পড়ে, এটাই জাতি দেখেছে বারবার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি, অশান্তি এবং দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সমাজে অব্যবস্থাপনা এবং অস্থিরতা বাড়ছে।
বাংলাদেশের অনেক সংকটের মূল কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। দেশের শাসনব্যবস্থা যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি যেমন দেশের জনগণের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি দেশের অর্থনীতির জন্যও বিপজ্জনক। আর যখন দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার একটি নিয়মিত চর্চা হয়ে ওঠে, তখন প্রশাসনিক কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে, জনগণ বারবার প্রতিশ্রুতি থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের মৌলিক সেবাপ্রাপ্তি অবরুদ্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দুর্নীতির চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। যে কারণে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো প্রায়ই বাস্তবে রূপ নেয় না। ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতি দেশের উন্নয়নকে অনেকটাই স্থবির করে তোলে। দুর্নীতির কারণে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সামাজিক সেবার ক্ষেত্রগুলো অনিয়মের শিকার হয়। এতে সমাজের দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রা আরো কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের বর্তমান সংকট ও অব্যবস্থাপনার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো অযোগ্য এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন। দুর্বল প্রশাসন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী রূপ নিতে পারেনি এবং সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলেছে। গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ চেহারা তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যদি প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয় এবং এটি সঠিকভাবে জনগণের সেবা দিতে সক্ষম হয়। বর্তমানে প্রশাসনের শৃঙ্খলা এবং দায়িত্বশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে, যার ফলে দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা বেড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অশান্তি এবং ক্ষমতার জন্য অনৈতিক লড়াই প্রশাসনকে কার্যকরভাবে কাজ করতে বাধাগ্রস্ত করছে।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রশাসনকে শক্তিশালী করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শক্তিশালী প্রশাসন না থাকলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এটি রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে এবং জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে অপরিহার্য। যখন প্রশাসন দক্ষ এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হয়, তখন সরকারের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা সহজ হয়।
এমন প্রশাসন, যা স্বচ্ছ, দক্ষ এবং জনগণের জন্য দায়বদ্ধ, তা সমাজের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে। এ জন্য এখন সবার আগে দরকার প্রশাসনের সর্বস্তর থেকে ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপসারণ করা। কারণ ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে অযোগ্য দলীয় লোকদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে। এদিকে তারা যেমন অযোগ্য, আরেকদিকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত। তাদের বহাল রেখে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না। পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে, যেমনটা এখন দেখছি আমরা।
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ, যেমন সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়া, তাদের প্রশাসনকে শক্তিশালী করে নিজেদের দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশও যদি এই পথ অনুসরণ করে, তবে দেশের উন্নয়ন নতুন এক দিগন্তে পৌঁছাতে পারে।
বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রও বর্তমানে অযোগ্য, দলীয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের কবলে। যেখানে একটি শক্তিশালী এবং আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা দেশে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারত, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থের কারণে এই খাতটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষার মান বাড়ানো, গুণগত শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি এবং প্রশিক্ষিত জনশক্তি তৈরি করা বাংলাদেশে অত্যন্ত জরুরি। কারিগরি শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন তরুণ প্রজন্মের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বৈষম্য বিরাজ করছে। একটি সমন্বিত প্রশাসনিক কাঠামো দেশের অর্থনীতিকে সুসংহত করতে সাহায্য করতে পারে। দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উৎপাদনশীল ক্ষেত্রগুলোয় বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। এসব সমস্যার সমাধানে প্রশাসনকে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে এবং অর্থনৈতিক নীতি সংস্কারে উদ্যোগী হতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে অপরাধ এবং নিরাপত্তাহীনতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি, আইনের শাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক সহিংসতা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়া, আইনের শাসনের অভাব এবং রাজনৈতিক সহিংসতার ফলে দেশের সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রশাসনিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। তবে সংস্কার থেকে প্রকৃত সুফল পেতে হলে প্রশাসনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে উপযুক্ত জবাবদিহি। জবাবদিহি ছাড়া দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করা সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা গেলে প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হবে। বিশ্বের যেসব দেশকে আমরা দুর্নীতিমুক্ত জনবান্ধব প্রশাসন দেখি তার মূলে রয়েছে তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো একটি শক্তিশালী প্রশাসন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। যদি প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ এবং জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হয়, তবে দেশের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। এর পাশাপাশি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষিত করা গেলে, বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত দেশের কাতারে শামিল হতে পারবে।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

