স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে সহিংসতার মামলার আসামি

রকীবুল হক
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ৫৯

কওমি মাদরাসা থেকে হাফেজি এবং দাওরা পাসের পাশাপাশি আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন মাওলানা মাজহারুল ইসলাম। আর এই পড়ালেখা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার-নির্যাতনের পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন তিনি। বানোয়াট মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। জামিনে মুক্তির সময়ও দুই দফা আটক করা হয় জেলগেট থেকে। দীর্ঘ প্রায় তিন মাস কারাভোগের প্রভাব পড়ে কর্মজীবনেও। নানা আতঙ্ক নিয়ে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান, ওয়াজ মাহফিলের দাওয়াত বন্ধ, মাদরাসায় চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন হয়রানির শিকার হন তরুণ এই আলেম। বানোয়াট মামলায় হাজিরার নামে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে দীর্ঘদিন। পুলিশি আতঙ্কে থাকতে হয়েছে তার পরিবারকেও।

বিজ্ঞাপন

পতিত আওয়ামী সরকারের সময়ে ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করতেন হাফেজ মাওলানা মাজহারুল ইসলাম। এর মধ্যে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির আবাসিক হলে ছিলেন তিনি। তারপর সেখানে ছাত্রলীগের হামলা হয়। শিবির সন্দেহে অনেক শিক্ষার্থীকে মারধর করে তারা। এমনই পরিস্থিতিতে ট্রাউজার-গেঞ্জি পরা অবস্থায় এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয় মাজহারুল ইসলামকে। সে সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও মাদরাসাটি থেকে কাগজপত্র নিতে না পারায় সে সুযোগ হাতছাড়া হয় তার। পরে পারিবারিক সিদ্ধান্তে বেসরকারি চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি।

২০১৩ সালে রাজনৈতিক হরতাল-অবরোধের কারণে সবকিছু অচল হয়ে পড়ে। এতে আশপাশের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন। দূরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাজহারুল ইসলামও দুই-আড়াই মাস হলেই ছিলেন। তবে একপর্যায়ে নিরাপত্তাহীনতার কারণে হল কর্তৃপক্ষ তাদের চলে যেতে বলে। এ অবস্থায় ট্রেনে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ রাতের ট্রেন ধরতে আরো অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে তিনিও যান স্টেশনে। কিন্তু চট্টগ্রামের সেই স্টেশনে ট্রেনে ওঠার আগ মুহূর্তে তাকে পেছন দিক থেকে আটক করে পুলিশ। বিনা কারণে ধরে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায় তাকে। একই সময় দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। এর মধ্যে তার বিশ্ববিদ্যালয়েরও কয়েকজন ছিল।

আটক করেই তাকে কোতোয়ালি থানার কাস্টডিতে আটকে রাখে দুদিন। সেখানে অজু-নামাজ, গোসল ও খাওয়া-দাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কনকনে শীতে নোংরা পরিবেশ, মশার উপদ্রব আর নেশাখোরদের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয় তাকে। বাইরে থেকে খাবারও দিতে দেয়নি। থানায় পৌঁছানোর পরপরই তার সঙ্গে থাকা কয়েক হাজার টাকা এবং অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল নিয়ে নেয় পুলিশ। সেগুলো পরে আর ফেরত দেয়নি তারা। সেখান থেকে দুদিন পর জামায়াত-শিবিরসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সংঘাতের একটি মামলা দিয়ে আদালতে ওঠানো হয় তাদের। তাদের চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়।

এদিকে থানায় আটকের পরপরই বিষয়টি পুলিশে কর্মরত মামাকে জানান মাজহারুল ইসলাম। তিনি ওসির সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সবাইকে ধরা হয়েছে। সংখ্যা কম হয়েছেÑআরো ধরতে হবে।

মাওলানা মাজহারুল ইসলাম বলেন, কারাগারের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। প্রথমে যেখানে রাখা হয়, তাকে আমদানি সেল বলে। ওই সেলে কেউ থাকলে এমনিতেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। একজন হাফেজ-আলেম হিসেবে নামাজ পড়তে চাইলেও সেখানে সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেই। সেখানে যে খাবার দেওয়া হতোÑমোটা রুটি আর চিনি, সেগুলো খেতে পারতেন না। এতে শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। এর মধ্যে কোর্টে হাজিরার সময় এক দিন তার মাকে ফোন দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সে অনুযায়ী এক মাস কারাবন্দিত্বের পর গাজীপুর থেকে তার ভাই এসেছিলেন দেখা করতে।

কারাগারে থাকার একপর্যায়ে দেড় মাসের মাথায় হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি। কাগজপত্র ও ব্যাগ নিয়ে জেল থেকে বের হলেই গেটে অপেক্ষমাণ পুলিশ চারদিকে অস্ত্র উঁচিয়ে তাকে আটক করে। গ্রেপ্তারের এই স্টাইল দেখে মন হয়, তিনি একজন বড় সন্ত্রাসী, অপরাধী। এ সময় কিছু দূরে তার ভাই এবং জামিনে সহযোগিতাকারী কয়েকজন তার গ্রেপ্তারের সেই দৃশ্য দেখলেও ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি। একপর্যায়ে তাকে কোতোয়ালি থানার একটি গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আগেই মুক্তি পাওয়া আরো অনেকে ছিলেন। তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সম্পূর্ণ বিনা কারণে এবং বেআইনিভাবে তাকে দুদিন সেই থানায় রাখা হয়।

তিনি বলেন, গ্রেপ্তার-নির্যাতনে নেতৃত্ব দেওয়া কোতোয়ালি থানার ওসি ছিলেন নিজামউদ্দিন। সম্প্রতি তিনি গণধোলাইয়ের শিকার হন। তিনি থানায় সবাইকে ধরে ধরে শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে কি না জিজ্ঞাসা করেন। রাজনৈতিক আরেকটি মামলা দিয়ে আবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয় মাওলানা মাজহারুল ইসলামকে। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বিস্ফোরক ব্যবহার-সংক্রান্ত অভিযোগ দেওয়া হয় তার মামলায়। মিথ্যা অভিযোগের এসব তাকে সহজে জামিন দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তাদের আটক রাখা হয়েছিল বলে পুলিশ কর্মকর্তা সে সময় জানিয়েছিলেন। কারাগারে বসেই একটি সেমিস্টার পরীক্ষা দেন তিনি। তবে কারাগারের পরিবেশে থাকতে খুব কষ্ট করতে হয় তাকে। সেখানে যে কম্বল দেওয়া হয়েছিল, তা গায়ে দিলেই চুলকাতো। ঠিকমতো গোসলের সুযোগ ছিল না। প্রথমে পাঁচ-ছয় দিন পর গোসল করায় জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। চুল-নখ কাটতে না পারায় চেহারা বদলে গিয়েছিল। সেখানে বাথরুম ছিল অনেকটা আলগা। তবে একজন হাফেজ হিসেবে কারাগারে থাকার সময় বন্দিদের কোরআন পড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।

এভাবে দীর্ঘ ৮০ দিন কারাভোগের পর তার জামিন হয়। সব প্রস্তুতি শেষ করে কারাগার থেকে বের হলেই গেট থেকে আবার আটক করে পুলিশ। তাকে নেওয়া হয় থানায়। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে সেই থানা থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনা হয়। তবে এই মুক্তির সময় মোবাইল, টাকা ইত্যাদি কিছুই ফেরত দেওয়া হয়নি।

তিনটি মামলা হয়েছিল মাওলানা মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে। পরে একটি মামলা থেকে খালাস পান তিনি। বাকি মামলাগুলোয় দীর্ঘদিন তাকে হাজিরা দিতে হয়েছে। তবে একপর্যায়ে পুলিশ সাক্ষী আনতে ব্যর্থ হওয়ায় সেগুলোর গতি কমে গেছে। সেগুলো খারিজ হওয়ার পর্যায়ে আছে।

এদিকে গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে গাজীপুর পুলিশের একটি গ্রুপ মাজহারুলের বাড়ি গিয়ে টাকা দাবি করেছিল। তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় মুক্তির পরও আতঙ্কিত থাকতেন তিনি। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে তাকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি, নাম কেটে দেওয়া হতো। বাড়িতে গেলে অনেকটা লুকিয়ে থাকতেন তিনি।

২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের ঘটনার রাতেও পুলিশের বীভৎস অভিযান দেখেছেন তিনি।

দিনভর ওই কর্মসূচিতে থাকার পর রাতে পুলিশি অ্যাকশনের শিকার হন তিনিও। পুলিশের ব্যারিকেডের কারণে অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকার পর নিজে ও অন্যদের জন্য শুকনো খাবার কিনতে যান কমলাপুর স্টেশন রোডে। নটর ডেম কলেজের সামনে পৌঁছাতেই লাইট অফ করে আলেম-ওলামাদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন শুরু হয়। শুরু হয় মানুষের দৌড়াদৌড়ি ও চিৎকার। সে সময় তিনি পাশে একটি বাড়ির গেটের ভেতরে অবস্থান নেন। সাউন্ড গ্রেডেন, গুলি আর লাঠি পেটানোর শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে ভোরে ওই স্থান ত্যাগ করেন মাজহারুল ইসলাম।

এদিকে উত্তরায় নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় ছাত্রলীগের চাঁদাবাজির শিকার হন এই আলেম। অফিসে এসে জোরপূর্বক টাকা নেওয়ার চেষ্টা করে তারা। একপর্যায়ে তাদের বেশ পরিমাণ টাকা দিতে বাধ্য হন তিনি। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন মাওলানা মাজহারুল ইসলাম। বর্তমানে মাদরাসা পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন মিডিয়ায় ইসলামিক বিষয়ে আলোচনা ও অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন তিনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত