১
‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম’ শব্দগুলা আমরা অনেক সময়ই ব্যবহার করি নিরর্থক বা অনর্থক অর্থে। কোনো আলাপচারিতায় কারো কোনো বক্তব্যকে বাতিল করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় বলি—‘কী সব আগডুম বাগডুম প্যাঁচাল পারছে!’
এই ‘আগডুম বাগডুম’ শব্দগুলা আমাদের মাঝে ছরায়া আছে রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় বই ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’ থেকে। ছাড়াটা এই রকম—
‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।।
বাজতে বাজতে চলল ডুলি,
ডুলি গেল কমলাপুলি।।
কমলাপুলির টিয়েটা
সূয্যিমামার বিয়েটা।।’
—এখানে রবীন্দ্রনাথ কোনো ধরনের অর্থ দেখতে না পেয়ে একে বলেছেন অর্থহীন ছড়া, যা লোকের মুখে মুখে প্রচলিত।
কিন্তু ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ (প্রথম খণ্ড) বইয়ে জানাচ্ছেন যে, এই ছড়া অর্থহীন নয়।
ছড়াটি একটি ডোম চতুরঙ্গের বর্ণনা।
আগডুম অর্থ অগ্রবর্তী, ডোম সৈন্যদল, বাগডুম অর্থ পার্শ্বরক্ষী, ডোম সৈন্যদল ও ঘোড়াডুম অর্থ অশ্বারোহী, ডোম সৈন্যদল।
এই ছড়ায় সুদূর অতীতের একটা ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান তথ্য আছে।
বাংলা ব-দ্বীপের পশ্চিম পার্শ্ববর্তী সীমান্তের বীরভূম আর বিষ্ণুপুর এলাকার ডোমরাজাদের সৈন্যসামন্তের যুদ্ধ প্রস্তুতি বা যুদ্ধযাত্রা নিয়ে এই ছড়াটি রচিত।
রবীন্দ্রনাথের বইয়ে একটা ছড়াকে অর্থহীন বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা ঘটেছে এমন একটা সামাজিক প্রেক্ষিতে, যখন ডোম জনগোষ্ঠীকে নিম্নবর্গের হিসেবে দেখতে পাই, যখন বাংলার সমাজে ইতোমধ্যেই আর্য সমাজব্যবস্থার জাতপাত প্রথা জেঁকে বসেছে এবং ডোমসহ আর সব অহিন্দু+স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে (যথা চণ্ডাল, কৈবর্ত, রাজবংশী, পাড় ও চামার) শূদ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় কে-ই বা চিন্তা করবে যে ডোম বা সেইসব জনগোষ্ঠী কখনো নিজেদের স্বাধীন রাজ্য-রাজত্ব প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে পারে?
কাজেই, আগডুম, বাগডুম, ঘোড়াডুম শব্দগুলার অর্থও নাই হয়ে গেছে।
এমনকি, রবীন্দ্রনাথের মতো পড়ালেখা জানা লোকের পক্ষেও বাংলায় হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান বা আর কোনো বড় জনগোষ্ঠীর বাইরে রাজক্ষমতা থাকার সম্ভাবনা চিন্তা করা সম্ভব হয়নি।
২
আমাদের জাতীয় পরিচয়ে ইসলাম অবিচ্ছেদ্য।
বাংলাদেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমান আর সমগ্র বাংলা ব-দ্বীপের জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫৫ শতাংশ মুসলমান।
এই মুসলমানরা কোথা থেকে এসেছে?—এই প্রশ্ন আমাদের জাতীয় পরিচয়ের আলাপে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের বোঝাপড়া।
বর্তমানে প্রচলিত মূলধারা ইতিহাসের বয়ানে বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠী এসেছে মূলত নিম্নবর্গের হিন্দু বাঙালিরা ধর্মান্তরিত হয়ে। সেই ধর্মান্তর ঘটেছে রাজশক্তি হিসেবে মুসলমানরা বাংলায় প্রবেশ করার পর ১২০৪ সালে বখতিয়ারের বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে।
হিন্দু জনগোষ্ঠী কখনো মুসলমানদের তলোয়ারের কোপের ভয়ে, আবার কখনো ইসলামের সাম্যের বাণীতে মুগ্ধ হয়ে হিন্দু জাতিভেদের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির আশায় ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে দাবি করা হয়।
বাঙালি মুসলমান সমাজের উৎপত্তির এই বয়ানের মধ্য দিয়ে জাস্টিফাই করা হয় যে, বাঙালি মানেই হিন্দু, বাঙালি মুসলমানের শেকড় হিন্দুত্বেই। কাজেই, বাঙালি সংস্কৃতিও মূলত হিন্দু সংস্কৃতিই। অতএব, ইসলাম এখানে বহিরাগত এবং সে জন্য, দরকার পড়লে ইসলামকে পরিত্যাগ করাই যথার্থ।
—এই বয়ানের প্রধান দুর্বলতাটা শুধু সাধারণ যুক্তি দিয়েই বোঝা যায়। যেমন : মুসলমান শাসকদের তলোয়ারের ভয়ে বা ইসলামের সাম্যের বাণীতে মুগ্ধ হয়ে নিম্নবর্গের হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে থাকলে সেটি হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি ছিল দিল্লির আশপাশে, উত্তর ভারত আর বিহারে। কারণ, সেই অঞ্চলে সবার আগে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং টিকেছিল দীর্ঘদিন। আর আর্যাবর্ত তথা হিন্দু সমাজও ছিল সেসব এলাকাতেই, যেখানে জাতিভেদ প্রথা প্রবলভাবে জেঁকে বসেছিল।
কিন্তু বাস্তবে জাতিভেদ প্রথায় প্রবলভাবে আক্রান্ত এবং শক্তিশালী মুসলমান শাসনের অধীনে সুদীর্ঘকাল থাকার পরও সেখানকার নিম্নবর্গের হিন্দুদের ১৫ শতাংশও ইসলাম গ্রহণ করেনি।
অন্যদিকে, বাংলায় মুসলমান শাসন এসেছে দিল্লির অনেক পরে, শক্তিতেও ছিল দুর্বল; একইভাবে বাংলায় আর্যসংস্কৃতিও এসেছে অনেক পরে এবং প্রভাবে-শক্তিতে দুর্বল। কিন্তু এই বাংলাতেই দেখা গেল জনগোষ্ঠীর ৬০-৭০ শতাংশ মুসলমান।
এর মানে একটাই—বাংলায় ইসলামের আগমন এবং জনসমাজে এর বিস্তার নিয়ে যে ঐতিহাসিক বয়ান, এর মধ্যে গলদ আছে। মুসলমান শাসকের তলোয়ারের ভয়ে, কিংবা হিন্দু জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তির আশায় নিম্নবর্গের হিন্দু বাঙালির ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
তাহলে কীভাবে এই বিশালসংখ্যক বাঙালি মুসলমান হয়ে গেল?
এমনকি ঐতিহাসিক তথ্য আছে, যা দিয়ে আমরা গ্রহণযোগ্য একটা উত্তর পেতে পারি বাঙালি মুসলমান সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ প্রশ্নের?
পেশাদার ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেন, জাতীয় ইতিহাসের বয়ান তৈরি করতে গিয়ে প্রায়ই জাতীয়ভাবে প্রধান বা প্রভাবশালী মতাদর্শের পাটাতনে অতীতের ঘটনাবলির ব্যাখ্যা করা হয়। আমাদের দেশে বাঙালি মুসলমানের উদ্ভব ও বিকাশবিষয়ক প্রচলিত বয়ানটি—তথা ইসলাম বাইরে থেকে রাজশক্তির জোরে আর্যসংস্কৃতির বাংলায় প্রবেশ করেছে এবং নিম্নবর্গের হিন্দুরা ইসলাম ধর্মান্তরিত হয়েছে—কলকাতায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষকালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের পাটাতনে তৈরি হয়েছে। সুনির্দিষ্ট করে এই বয়ানের গোড়াটা পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের ১৮৮২ সালে প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধে। সেখান থেকে এই বয়ান আজ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে চলছে। [‘বাঙালি মুসলমান প্রশ্ন’ বইতে এই নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করছি]।
মতাদর্শভিত্তিক ঐতিহাসিক বয়ান নির্মাণের প্রক্রিয়ায় একটা সাধারণ বিষয় হলো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্যকে গোপন করা বা এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ‘চুপ (silent)’ করিয়ে রাখা, নানা সিস্টেম্যাটিক উপায়ে জনমানস থেকে মুছে দেওয়া। দুটি উদাহরণ দিয়ে এই ব্যাপারটা হালকা ব্যাখ্যা করছি।
৩
‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম...’ ছড়াটা মূলধারা বাংলা সাহিত্যে অর্থহীন একটা লোকসাহিত্য বা ছড়া আকারে প্রচলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আদি বাঙালির ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাকে ‘চুপ বা silent’ করা হয়েছে। একে অর্থহীন সাব্যস্ত করার মাধ্যমে আর্যসমাজের আগেও যে বাংলা ব-দ্বীপে স্বাধীন রাজত্ব নিয়ে নিজ সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর বাস ছিল, সেই সত্যকে আড়াল করা হয়েছে। ফলে, আদি বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা সুনির্দিষ্ট পর্বকে মুছে দেওয়া হয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে এই দাবি প্রতিষ্ঠা করা যায় যে, সংস্কৃতিতে-রাজনীতিতে অগ্রসর বাঙালি সমাজের যাত্রা শুরুই হয়েছে আর্য তথা হিন্দু গোষ্ঠীর হাতে।
এই ছড়াটাকে অর্থপূর্ণ ধরে নিলে প্রচলিত বয়ান—তথা, হিন্দু বাঙালিই আদি বাঙালি, হিন্দুত্বেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর শেকড়—তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।
প্রচলিত মূলধারা বয়ানের আরেকটা বিশ্বাসের দিকে তাকানো যাক। বলা হয়, বাংলায় ইসলামের প্রবেশ ঘটেছে ১২০৪ সালে বখতিয়ারের বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে। এরপর সুলতানদের তলোয়ারের ভয়ে বা ইসলামের সাম্যের বাণীতে মুগ্ধ নিম্নবর্গের হিন্দু জনগোষ্ঠী দলে দলে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে। এই বয়ান যে অযৌক্তিক, তা আগেই বলেছি। কিন্তু একসঙ্গে এই বয়ানের ভিত্তিহীনটা প্রমাণের জন্য কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও পাওয়া গেছে, যেগুলো আমাদের মূলধারা ইতিহাস নির্মাণ ও প্রচারের ক্ষমতায় আসীন ইতিহাসবিদরা নিজ নিজ মতাদর্শের স্বার্থে এড়িয়ে যান, গোপন করেন এবং দরকার পড়লে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ‘চুপ বা সাইলেন্ট’ করে দেন।
এ বিষয়ের একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো দিনাজপুরে প্রাপ্ত একটা মসজিদের ভিত্তিভূমি, যা অষ্টম শতকে তৈরি করা, বখতিয়ারের বঙ্গবিজয়ের চারশ বছর আগের ঘটনা! সেই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দিনাজপুরে ইসলামের আগমন এবং সাধারণ জনসমাজে গৃহীত হওয়ার একটা অকাট্য দলীল।
দিনাজপুরের এই মসজিদের উপস্থিতিকে যথার্থ হিসেবে গ্রহণ করলে বর্তমানে বাংলায় ইসলামের আগমন ও বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর উদ্ভব এবং বিকাশের প্রচলিত বয়ান—তথা, ইসলাম রাজশক্তির জোরে বাংলায় প্রবেশ করেছে এবং বিস্তৃত হয়েছে—তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।
এ জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার অডিটোরিয়ামে আমন্ত্রিত বক্তা সদ্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা অধ্যাপক মিজানুর রহমান দিনাজপুরের সেই মসজিদের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে কথা বলা শুরু করলে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এবং অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সেই বক্তৃতা জোর প্রয়োগ করে থামিয়ে দিয়েছিল।
একইভাবে, কলকাতা থেকে আসা হি-ন্দু-ত্ব-বাদী মতাদর্শিক অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার পদে আসীন অধ্যাপক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে সুপরিচিত লোকরা প্রচলিত মূলধারা বয়ানকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঐতিহাসিক তথ্য মুছে দেওয়া, এড়িয়ে যাওয়া, অপব্যাখ্যা করা—সবই করছে।
৪
জুলাই ২৪ আমাদের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতার দরজা খুলে দিয়েছে।
এখান থেকে আমাদের সাংস্কৃতিক মুক্তির পথ খুঁজে নিতে হবে।
অযৌক্তিক, আংশিক, ভিন্ন মতাদর্শের ধারক মূলধারা ঐতিহাসিক বয়ানকে যথাযথ তথ্য ও যুক্তির ওপর ভিত্তি করে পুনর্নির্মাণ করাটা এখন একটা জাতীয় দায়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় (কাতার)


সালাম মুর্শেদীর বাড়ি দখলে নিতে সরকারকে হাইকোর্টের নির্দেশ
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বাড়ছে ৪০০ কোটি টাকা
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও টিকটকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমার