গাজায় যুদ্ধবিরতি : সামনে আলো না অন্ধকার

ইমরান রহমান
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২: ১০

বর্তমানে এমন এক পৃথিবীতে আমাদের বাস যেখানে যুদ্ধ থেকে কোনো নিস্তার নেই। পানি, জ্বালানি, খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অব্যাহত যুদ্ধে একমাত্র বাসযোগ্য এ নীল গ্রহটি আজ বিধ্বস্ত।

শ্বেতকপোতের পরিবর্তে এর আকাশ এখন অত্যাধুনিক ড্রোন, যুদ্ধবিমান আর মিসাইলের দখলে। যখন দেখি পাশ্চাত্যের নদীগুলোয় শ্যাম্পেন আর প্রাচ্যের জর্ডান, ফোরাত, দজলা ও সিন্ধুতে অশ্রু ও রক্ত বয়ে যেতে, তখন ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে’—বিশেষজ্ঞদের এ কথাটি উড়িয়ে দিতে পারি না। মানবতার জন্য যুদ্ধের নামে মানবতা লঙ্ঘনের সর্বাত্মক আয়োজন সর্বত্র।

বিজ্ঞাপন

গণমাধমে ফিলিস্তিন যুদ্ধে যে গুলি ও বোমার আওয়াজ শুনে আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে, সে আওয়াজ এখন প্রৌঢ়ত্বে এসেও শুনতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই অসম ও অন্যায় যুদ্ধের যেন কোনো ক্লান্তি নেই, নেই কোনো সমাপ্তির লক্ষণ, কালক্রমে সে যেন আরও যৌবনপ্রাপ্ত, আরও নির্মম হচ্ছে। আকাশের দিকে নিষ্পলক ধর্ষিতা রমণীর শূন্য চোখের মতো মনে হয় গাজায় বিধ্বস্ত প্রতিটি ঘরের খোলা জানালাকে।

গাজার মাটিতে বিগত ১৫ মাস আগ্রাসনের পর মানবিক ক্ষয়ক্ষতি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। গত ১৫ মাসের সংঘাতে প্রায় ৪৬ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার অর্ধেকই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। প্রায় ১৩ হাজার শিক্ষার্থী নিহত এবং ২১ হাজার ৬৮১ জন আহত হয়েছেন। নিহত শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মীর সংখ্যা ৬৩০ জন এবং আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৮৬৫ জন। গাজার অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে মারাত্মক আকারে। এর ৫৯ শতাংশ ভবনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চরমভাবে।

দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরতায় ৩০টিরও বেশি হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে, যা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বহু স্কুল ধ্বংস হওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থা হয়েছে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু বিধ্বস্ত গাজার পুনর্নির্মাণেই দরকার পড়বে কয়েক মিলিয়ন ডলার। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ, যাদের কাছে ঘর এখন কেবল এক সুদূর স্মৃতি। আর যুদ্ধবিরতির আগের রাতে, এক দিনে চালানো হলো প্রায় ৪৫০টি বোমা হামলা। শান্তির এই ক্ষণস্থায়ী ঘোষণা কতটা টেকসই, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতি অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিশ্ববিবেক উপযুক্ত সময়ে ব্যবস্থা নিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও কম হতে পারত। লাখ লাখ নবজাতককে ক্ষুধার্ত অবস্থায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে জন্মের ঋণ শোধ করতে হতো না পৃথিবীতে আসার অপরাধে? এই বিলম্ব যে তাদের ইচ্ছাকৃত, তা মধ্যপ্রাচ্য নীতির আওতায় সম্প্রতি হুতি ও ইরানকে দমনের প্রচেষ্টায় আবারও স্পষ্ট হয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়গম্বরদের স্মৃতিবিধৌত এ পুণ্যভূমি আর কতকাল পার্থিব স্বার্থের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে? মুসলিমদের দৃষ্টিতে জেরুজালেম আল-আকসা মসজিদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এটি ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। আল-আকসা প্রাঙ্গণ থেকেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজ রজনীতে সপ্তম আকাশে আরোহণ করেছিলেন। ‘ডোম অব দ্য রক’-এর সোনালি গম্বুজ ইতিহাসের সেই পবিত্র স্মৃতি বহন করে চলেছে।

ইহুদি ধর্মে জেরুজালেম সর্বাধিক পবিত্র স্থান। এটি ইহুদিদের ঐতিহাসিক রাজধানী এবং সলোমনের প্রথম উপাসনালয়। ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’ বা ‘কোটেল’ ইহুদিদের প্রার্থনার এক শাশ্বত স্মৃতি। জেরুজালেম ইহুদি জাতির আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, যেখানে তারা ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে।

খ্রিষ্টান ধর্মে জেরুজালেম সেই স্থান, যেখানে যিশুখ্রিষ্ট তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করেছিলেন। এখানেই ঘটেছিল তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ও পুনরুত্থানের আধ্যাত্মিক ঘটনা। ‘চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার’ খ্রিষ্টানদের জন্য এক অমূল্য পবিত্র স্থান। খ্রিষ্টানরা মনে করেন, এটি সেই স্থান যেখানে যিশুর কবর অবস্থিত।

ধর্মের মূল লক্ষ্য মানবতার মুক্তি। কিন্তু এ ধর্ম আজ চরমপন্থার মারণাস্ত্র হয়ে উঠেছে। ধর্ম যখনই যুক্তির পরিবর্তে মূর্খ ও অর্ধশিক্ষিত মানুষের হাতে পড়ে, তখনই মানবতার পরাজয় ঘটে, যুক্তি হেরে যায় আবেগের কাছে।

ফিলিস্তিনের শিশুদের ওপর সাম্প্রতিক ইসরাইলি বর্বরতা প্রমাণ করে, ধর্মীয় চরমপন্থা কতটা গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে। তবে দেশটির নিজ দেশের জনগণ রাস্তায় নেমে এই বর্বরতার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এখানে ইসরাইলের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে। লাখ লাখ মানুষ বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে।

ধর্মীয় চরমপন্থার শিকড় অনেকটাই পুঁজিবাদে নিহিত। পুঁজিবাদ ধর্মের অপব্যবহারের সুযোগ দেয়, যেখানে ক্ষমতার লড়াইয়ে বর্ণ বা ধর্মকে হাতিয়ার বানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের শীর্ষ মহল থেকে ইসলামবিরোধী বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য এই চরমপন্থাকে আরও উসকে দিচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ব নিউজিল্যান্ডের আল নূর মসজিদে সংঘটিত শ্বেত চরমপন্থার উৎকট রূপ দেখেছে।

আজ মুসলমানদের ন্যায্য দাবি চরমপন্থা হিসেবে চিহ্নিত হয়। তাদের আত্মরক্ষার চেষ্টা অন্যদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। মুসলিমের প্রশ্নে খ্রিষ্টান—More than Christian এবং হিন্দু-মুসলিমের ক্ষেত্রে অধিকতর হিন্দু হয়ে উঠছে। মিয়ানমার ও চীনের বৌদ্ধরা টেক্সটবুক-স্টাইলে মুসলিম নিধনের যে নজির গড়ছে, তাতে তাদের ‘জীবহত্যা মহাপাপ’—এই বাণীটি বড় ভণ্ডামি মনে হয়।

ইতিহাস সাক্ষী, কেবল বলপ্রয়োগ করে যুদ্ধ থামানো যায় না। আলোচনার টেবিলেও বহু রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের সফল সমাধান হয়েছে। ইংরেজ কবি জন মিল্টন যথার্থই বলেছেন, ‘Peace hath her victories no less renowned than war.’

ভবিষ্যৎ বিশ্বের ভাগ্য নিরূপণে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বিশ্বনেতৃত্বের দিকনির্দেশনা ঠিক করবে পৃথিবীর সামনের দিনগুলোয় আলো নাকি অন্ধকার বিরাজ করবে।

লেখক: কবি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত