Ad T1

সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত

পাকিস্তানকে কতটা ঘায়েল করতে পারবে ভারত

হামিদ মির
প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৮: ৪৩

অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার পর সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। দেশটির পানি শক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখার্জি গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ আলী মুর্তজাকে লেখা এক আনুষ্ঠানিক চিঠিতে চুক্তিটি স্থগিত করার কথা জানান। চিঠিতে ভারতের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ‘ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরকে লক্ষ্য করে পাকিস্তানের অব্যাহত আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ’ এবং পানি চুক্তি নিয়ে আলোচনায় পাকিস্তানের অস্বীকৃতির কারণেই ভারত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের এই সিদ্ধান্ত ‘অবিলম্বে কার্যকর হবে’ বলে দেবশ্রী মুখার্জির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। চুক্তির ৬৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম স্বাক্ষরকারী একপক্ষ এমন চরম পদক্ষেপ নিল।

সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার ভারতের ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। দেশটির উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বৈঠকের পর দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, সিন্ধু পানি চুক্তি একটি বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং এটি একতরফাভাবে স্থগিত করার কোনো বিধান চুক্তিতে নেই।

এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত সিন্ধু অববাহিকার তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদী (সতলজ, বিয়াস ও রাভি) এবং পাকিস্তান অববাহিকার তিনটি পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী (সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব) নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায়। এখন চুক্তি থেকে ভারত একতরফা সরে যাওয়ার পর পাকিস্তানের সামনে বিকল্প কী কী পথ খোলা রয়েছে?

এনএসসির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তান সিমলা চুক্তিসহ ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিত করার অধিকার প্রয়োগ করবে। বাস্তবতা হলো এটাই যে, পাকিস্তান যদি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিত করা শুরু করে, তাহলে এর বিরুদ্ধে ভারত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে অভিযোগ করতে পারবে না। অন্যদিকে, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের বিরুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের কাছে অভিযোগ করতে পারবে পাকিস্তান।

প্রথমত, এটা অবশ্যই বুঝতে হবে, সিন্ধু পানি চুক্তিকে এড়িয়ে চলার ভারতের চেষ্টা এটাই প্রথম নয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের মধ্যে ১৯৬০ সালে করাচিতে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ও এই চুক্তি টিকে ছিল। ১৯৭০ সালে ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের রিয়াসি জেলায় চেনাব নদীর ওপর সালাল বাঁধ নির্মাণ করে চুক্তি লঙ্ঘন করে। কিন্তু তারপরও ১৯৭১ সালে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের সময়ও টিকে ছিল এই চুক্তিটি।

জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার সরকার সালাল বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকে অভিযোগ জানায়। ফলে ভারত বাঁধটির নকশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে সালাল বাঁধ নিয়ে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের সরকারের সঙ্গে ভারত একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে। এ চুক্তির ফলে ভারত বাঁধের স্পিলওয়ে গেটের উচ্চতা ৪০ ফুট থেকে কমিয়ে ৩০ ফুটে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়। একই সঙ্গে ভারত এই চুক্তিকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের সাফল্য হিসেবে ঘোষণা করে।

কিন্তু ভারতের পানি বিশেষজ্ঞরা সিন্ধু পানি চুক্তিকে ঝিলাম, চেনাব ও সিন্ধু নদীর পানি নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় বড় বাধা বলে মনে করতেন। ২০০১ সালে ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে হামলার পর দেশটি পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের হুমকি দিয়েছিল। পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ থেকে এটি স্পষ্ট, সন্ত্রাসবাদের অজুহাত তুলে বারবার চুক্তিটি স্থগিত করার চেষ্টা করেছে ভারত। বস্তুতপক্ষে, ঝিলাম ও চেনাব নদীর ওপর আরো বেশি বাঁধ নির্মাণ করাই ছিল ভারতের লক্ষ্য।

ভারত ২০০৭ সালে অধিকৃত কাশ্মীর উপত্যকার বান্দিপুরার উত্তরে ঝিলাম নদীর ওপর কিশানগঙ্গা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ভারতের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকে অভিযোগ করলে প্রকল্প স্থগিত করতে বাধ্য হয় ভারত। এরপর বিষয়টি সালিসি আদালতে পাঠানো হয়, যা এখনো বিচারাধীন।

২০১৩ সালে ভারত আবার কাশ্মীরের কিশ্তওয়ার জেলায় চেনাব নদীর ওপর রাতল বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। পাকিস্তানও যথানিয়মে বিশ্বব্যাংকের কাছে অভিযোগ করে। ফলে ভারত বাঁধের নকশায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে অধিকৃত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলার পর সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয় ভারত। ভারতের অনেক বিশেষজ্ঞের দাবি, সিন্ধু পানি চুক্তির মাধ্যমে ভারতের চেয়ে বেশি পানি পায় পাকিস্তান। কিন্তু ভারতের এই দাবি মোটেই সঠিক নয়।

সিন্ধু পানি চুক্তিতে পরিবর্তন আনার জন্য গত বছর পাকিস্তানের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল ভারত। কিন্তু ভারতের এই প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি পাকিস্তান। এরপর সর্বশেষ পেহেলগামে হামলার পর ভারত সরকার চুক্তিটি স্থগিত করার ঘোষণা দেয় এবং এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে, ভারতের ‘পানি হামলা’র পর পাকিস্তান ভয়াবহ পানিসংকটে পড়বে।

তবে বিজেপি সরকারের এই দাবির সঙ্গে মোটেই একমত নন ভারতের অনেক বিশেষজ্ঞ। ইন্ডিয়া টুডেতে লেখা এক নিবন্ধে অভিষেক দে বলেছেন, ‘চুক্তি স্থগিত করা মানেই পাকিস্তানে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া যাবে, বিষয়টি এমন নয়। কেননা, ভারতের এখন এমন কোনো অবকাঠামো নেই, যার মাধ্যমে পাকিস্তানে সিন্ধু নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া যাবে বা নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারবে। ভারত বড়জোর ৫-১০% পানির প্রবাহ কমাতে পারবে।’

এসব নদীর ওপর বড় রিজার্ভার বা জলাধার নির্মাণ করতে ভারতের কয়েক বছর লেগে যাবে। আর এর জন্য ব্যাপক জরিপ এবং বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। এসব প্রকল্প সম্পন্ন করতে ভারতের এক দশক লেগে যাবে। এরপর পাকিস্তান ভারতের এসব প্রকল্পের কারণে কিছুটা সমস্যায় পড়তে পারে।

এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই, ভারত সরকার মিথ্যা দাবি করে তার জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, পাকিস্তান সিমলা চুক্তি স্থগিত করলে দীর্ঘ মেয়াদে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে ভারত। সিমলা চুক্তি স্থগিত করার অনেক যুক্তি পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়েছে ভারত। দেশটি ১৯৮৪ সালে সিয়াচেন উপত্যকা দখল করে এ চুক্তি লঙ্ঘন করেছিল। এরপর ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বাতিল করে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের মর্যাদা পরিবর্তন করে আবারও সিমলা চুক্তি লঙ্ঘন করে।

পাকিস্তান যদি সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসে, তাহলে কী ধরনের দৃশ্যপটের উদ্ভব হতে পারে, তা একটু কল্পনা করা যাক। প্রথমত, পাকিস্তান তখন আর ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আবদ্ধ থাকার ব্যাপারে দায়বদ্ধ থাকবে না এবং অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ বা মধ্যস্থতার করার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকবে না। তখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা অন্য যেকোনো দেশ কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতা করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বা লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুদ্ধবিরতির রেখা (সিএফএল) হিসেবে বিবেচিত হবে, যা কাশ্মীরের স্বাধীনতাসংগ্রামকে জোরদার করবে।

আন্তর্জাতিকভাবে এমন কোনো আইন নেই, যাতে যুদ্ধবিরতির রেখা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সিমলা চুক্তি স্থগিত হলে কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, তা হয়তো কল্পনাও করতে পারছে না ভারত। দেশটির তথাকথিত ‘পানি হামলা’ পাকিস্তানকে কঠিন কোনো সংকটে ফেলবে না, কিন্তু পাকিস্তানের ‘সিমলা হামলা’র পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত।

জিও নিউজ থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী

হামিদ মির : পাকিস্তানের সিনিয়র সাংবাদিক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত