চোখ যে মনের কথা বলে
চোখে চোখ রাখা শুধু নয়
চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে
চোখের মত চোখ থাকা চাই;
এই পঙ্ক্তিগুলো আমি যখন প্রথম শুনি, এক ধরনের কাঁপুনি উঠেছিল হৃদয়ে। গানটির কথা, সুর আর কণ্ঠ যেন একত্রে মনের এমন এক দরজা খুলে দিল, যেটা আমরা অনেকেই একা একা খুলতে ভয় পাই। গানটি ছিল ‘যে আগুনে পুড়ি’ চলচ্চিত্রের। ঠিক যতটা মনে পড়ে সে সময় এমন কেউ ছিল না, যার অন্তরে এই গানটা হালকা আঁচড় দিয়ে যায়নি।
এটি শুধু একটি গান ছিল না—এটি ছিল একেকটি মনোসংলাপ। গানটির রচয়িতা, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক খন্দকার নুরুল আলম। হ্যাঁ, একজন মানুষ, যার ভেতরে যেন সংগীতের এক বিশাল সমুদ্র লুকিয়ে ছিল। মূলত সংগীত পরিচালনায় তার পথচলা হলেও, বেশ কয়েকটি গানে তিনি নিজেই কণ্ঠ দিয়েছেন এবং আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সেই কণ্ঠ আমাদের শিল্পসংগীতের পরম শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলোর একটি। অনেক সময় পেশাদার শিল্পীদের মধ্যেও এমন আত্মিক গভীরতা দেখা যায় না, যা নুরুল আলম ভাইয়ের কণ্ঠে ছিল।
আমি যখন বিটিভিতে কাজ করতাম, তখন তার মতো মানুষ ছিলেন আমাদের আত্মার বাতিঘর। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সোজা সংগীতের জগতে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। অন্য কোনো লাভজনক পেশার দিকে না তাকিয়ে, তিনি সুরকেই জীবনের উদ্দেশ্য করে তুলেছিলেন।
চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশন—তিন মাধ্যমেই তিনি অসাধারণ দ্যুতি ছড়িয়েছেন। আমার সৌভাগ্য, আমি এমন একজন মানুষকে কাছ থেকে দেখেছি, যার মধ্যে সৃষ্টির পিপাসা ছিল বিশুদ্ধ এবং যার যাত্রাপথটা ছিল ত্যাগ, প্রেম আর নীরব সংগ্রামের অনবদ্য উপাখ্যান।
আমি শুধু একজন শিল্পীর গল্প বলছি না—আমি সেই মাটিরও কথা বলি, যেখানে আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়গুলো গাঁথা। সেই মানুষটির কথা বলছি, যিনি নিঃশব্দে আমাদের হৃদয়ে সুরের বাতাস বইয়ে দিয়েছেন।
‘চোখ যে মনের কথা বলে’—এই গানটির ছায়াছবির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি জড়িয়ে গিয়েছিল। ‘যে আগুনে পুড়ি’ ছায়াছবির এই গানটির সুরকার, কণ্ঠশিল্পী—দুই ভূমিকাতেই ছিলেন অসাধারণ মানুষ—খন্দকার নুরুল আলম সাহেব। এই ছায়াছবির সূত্রেই আমার তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
বাংলা গানের তালিকায় কালজয়ী এক সংযোজন ‘চোখ যে মনের কথা বলে’। ১৯৬৮ সালে রচনা হয়েছিল গানটি। খন্দকার নুরুল আলমের সুর ও কণ্ঠের গানটি রাজ্জাকের অভিনয়ে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এটি ১৯৭০ সালে ‘যে আগুনে পুড়ি’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়।
যতদূর মনে পড়ে, ছবির সহ-পরিচালক ছিলেন আজহারুল ইসলাম খান—সম্পর্কে আমার ভাই। এক রাতে তিনি আমাদের বাসায় এসে আমার মাকে বললেন, ‘মেনকাকে একটা কাজে নিতে চাই।’ তখন আমি বেতারে অনুষ্ঠান ঘোষণার কাজ করি। একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ‘কী ব্যাপার?’ তিনি হেসে বললেন, ‘একটা ছবির কাজ করছি, নায়িকা সুচন্দার কণ্ঠে একটা জায়গায় নতুন কণ্ঠ বসাতে হবে—মানে তার সংলাপে কণ্ঠ মিলবে।’
মা আজহার ভাইকে খুব স্নেহ করতেন, তাই না করতে পারলেন না। তিনি আমাকে এফডিসিতে নিয়ে গেলেন। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম এফডিসি-যাত্রা। এডিটিং রুমে গিয়ে দেখি, একজন ভদ্রলোক বসে মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছেন, চারপাশে রিল, ফিল্ম, সেলুলয়েডের গন্ধে ভরপুর এক পরিবেশ। পরে জানলাম, তিনিই খন্দকার নুরুল আলম। কয়েকবার রিহার্সালের পর আমার কণ্ঠ মিলে গেল। সবার মুখে হাসি। জীবনের এক ক্ষণিক অভিজ্ঞতা, কিন্তু আজও মনে গেঁথে আছে।
সেই মানুষটির সঙ্গে পরে আবার দেখা হলো স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশ বেতারে। তিনি তখন সংগীত পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার পথচলায় তিনি নিয়মিত সঙ্গী হয়ে উঠলেন। ‘বর্ণালি’র মতো বিষয়ভিত্তিক গানের অনুষ্ঠানগুলোয় তার সংগীত পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত, শিল্পমানসম্পন্ন ও আবেগঘন। উপস্থাপক সানজিদা আখতার, গবেষক লুৎফর রহমান রিটনসহ আমরা সবাই তার সংগীতনির্মাণে মুগ্ধ থাকতাম।
খন্দকার নুরুল আলম নিজে খুব বেশি গানে কণ্ঠ দেননি, কিন্তু যেটুকু দিয়েছেন, তা ছিল স্বর্ণের মতো খাঁটি। যেমনÑ
‘আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে জোছনা লুকাতে’
‘দুই নয়ন ভরে যত দেখি তারে’
‘এই দেশ এই মানুষ’
‘আয়রে আমার বাংলা ভাষা’
‘ওরে আমার দেশের মাটি সোনা’
তার জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৭ আগস্ট ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে। শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি ছিল দুর্মর আকর্ষণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি সংগীতকেই জীবনব্রত হিসেবে বেছে নেন। শারীরিকভাবে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও সংগীতের দুনিয়ায় তার পথচলা ছিল সাহসী ও সম্মানজনক। সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় ৩০টি চলচ্চিত্রে, অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে বাংলাদেশি সংগীতের এক নবমাত্রা সৃষ্টি করেছেন।
স্বাধীনতার পর যে কজন মানুষ বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের সংগীতাঙ্গনকে আক্ষরিক অর্থে হৃদয় দিয়ে গড়েছেন, খন্দকার নুরুল আলম তাদের অন্যতম।
আমার সৌভাগ্য, আমি তাকে শুধু কাছ থেকে দেখিনি, বরং তার সৃষ্টিশীলতার অংশীদার হতে পেরেছি।
খন্দকার নুরুল আলম ভাই জীবনে যত গান গেয়েছেন কিংবা সুর করেছেন, তার প্রায় ৯০ ভাগই ছিল গীতিকার মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা। আমাদের দেশের গানের ভাণ্ডারে রফিকুজ্জামানের মতো মেধাবী ও হৃদয়ছোঁয়া গীতিকারের তুলনা সত্যিই বিরল। তিনি শুধু গানের কথা লেখেননি, আমাদের সামষ্টিক অনুভূতিগুলোকে ছুঁয়ে গেছেন গভীরতম স্তরে।
খুব মনে পড়ে, একবার তিনি সুর করেছিলেন সেই গভীর ও বেদনাময় গানে—
‘যদি মরণের পরে কেউ প্রশ্ন করে...’
এই গানটি শুনে যে কারও অন্তর কেঁপে উঠবে।
তেমনি আরও কিছু গান আজও কালের গায়ে শিহরন তোলে :
অসংখ্য চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শুভদা’ ছবিরÑএত সুখ সইবে কেমনেÑঅসাধারণ এই গানটি গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন মায়াবী কণ্ঠের শিল্পী নীলুফার ইয়াসমিন।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ওনাকে একুশের পদক প্রদান করেন।
একবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানের পরিকল্পনা করি। আমি খন্দকার ভাইকে বললাম, ‘শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’—এই কবিতা যদি গানে রূপ পায়, কেমন হয়?’
কণ্ঠ দিলেন বিশিষ্ট শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন।
তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে কাজটি হাতে নিলেন। অসাধারণভাবে সুরারোপ করলেন। এরপর আমি সেই গানের চিত্রধারণ করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে, শহীদ মিনারে, জাতীয় স্মৃতিসৌধে—প্রতিটি লোকেশন একেকটা প্রতীক হয়ে উঠল।
পরে কবি শামসুর রহমানের লেখা কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান সুর করেন খন্দকার ভাই এবং কণ্ঠ দিলেন কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন।
Ñএই যে আমার খুকির ঠোঁটে ফুটছে হাসি
সে তো তোমার জন্য স্বাধীনতা। অথবা
Ñস্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথায় আর কতকাল তুমি করবে শোক।
কথাÑসুরÑকণ্ঠ সব মিলিয়ে এক অনবদ্য পরিবেশনা।
বিশেষভাবে বলতেই হয়, একুশে ফেব্রুয়ারির পটভূমিতে লেখা সেরা কবিতাগুলোর ওপর সুরারোপ করে আমরা তৈরি করেছিলাম এক অনন্য অনুষ্ঠান।
যেমনÑ
‘স্মৃতিমিনার ভেঙেছ তোমরা, ভয় কী?’—আলাউদ্দিন আল আজাদ
‘কুমড়ো ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা’—আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’—মাহবুবুল আলম
‘ফেব্রুয়ারি ২১ তারিখ, দুপুর বেলা অক্ত’—আল মাহমুদ
এই গানগুলো যেন ইতিহাসকে ছুঁয়ে থাকা সুরে রূপান্তরিত হয়েছিল। শব্দ ও সুর মিলিয়ে এক অন্তরঙ্গ দলিল হয়ে উঠেছিল সেই অনুষ্ঠানটি। সব মিলিয়ে, খন্দকার ভাইয়ের সংগীত পরিচালনায় যে হৃদয়ের কথা, চেতনার স্পর্শ এবং ঐতিহাসিক আবেগ—তা শ্রোতা-দর্শকের মনে আজও রয়ে গেছে এক স্থায়ী স্বরলিপি হয়ে।
আসলে খন্দকার ভাইয়ের সৃষ্টিশীল প্রতিভার কথা বলে শেষ করা যাবে না। তার সুর যেন হৃদয়ের গভীর কোনো অনুরণন, এক ধরনের মায়াবী টান, যা শ্রোতাকে এক অন্যরকম অনুভবের জগতে নিয়ে যায়। তার সুরে এক ধরনের বিষণ্ণ কোমলতা, আবার এক ধরনের সাহসিক আহ্বানও থাকত, যা একজন শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি থেকেই সম্ভব।
খন্দকার নুরুল আলম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালে ঢাকায়। সেখানেই তার শৈশব ও কৈশোর কাটে সংগীতের পরিমণ্ডলে। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল প্রবল। পরিবারের পরিবেশও ছিল সাংস্কৃতিক, তবে খুব বেশি প্রচারবিমুখ। সংগীতই ছিল তার আত্মার ভাষা।
জীবনের শেষ প্রান্তে অনেক শারীরিক জটিলতায় ভুগেছেন তিনি। ভাবি—তার স্ত্রী, এক কথায় দেবীতুল্য মানবী—সারাজীবন অক্লান্ত সেবা করেছেন তাকে। একজন শিল্পীর যেভাবে মানসিক ও শারীরিক সহায়তা দরকার হয়, ভাবি সেই শক্তি হয়ে পাশে ছিলেন তার। তাদের দুজন সুযোগ্য সন্তান রয়েছে, যারা বাবার মতোই শিল্পচর্চার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল।
একদিন হঠাৎ ভাবি ফোন করলেন—
‘মেনকা আপা, আপনার ভাই একটু কথা বলতে চান আপনার সঙ্গে।’
ফোন ধরতেই তিনি বললেন,
‘আমি মারা গেলে তুমি আমার কবরের ব্যবস্থা করবা, মেনকা।’
আমি তো হতবাক! বললাম, ‘কী বলেন এসব আপনি!’
তিনি হালকা হাসিতে বললেন, ‘হ্যাঁ, আর তো বেশি দিন বাঁচব না। তাই তোমাকে একটা অনুরোধ করলাম।’
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কী এমন মানুষ আমি—এত বড় মাপের শিল্পী হয়েও এমন ব্যক্তিগত অনুরোধ করলেন আমাকে। সেদিন সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি।
খন্দকার নুরুল আলম ২২ জানুয়ারি ২০১৬ সালে আমাদের ছেড়ে চলে যান।
ফোন পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। তার সেই অনুরোধটা বারবার মনে হচ্ছিল।
তৎকালীন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর সাহেবকে ফোন করে সব জানাই।
তার তড়িৎ উদ্যোগে খন্দকার ভাইকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয় যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
আমি কিছুটা হলেও শান্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু বুকের ভেতরে যে শূন্যতা, তা পূরণ হওয়ার নয়।
খন্দকার নুরুল আলম বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের এক অনন্য প্রতিভা।
তিনি বিটিভির অত্যন্ত সম্মানিত সুরকার ছিলেন, পাশাপাশি বাংলাদেশ বেতারে কাজ করেছেন দীর্ঘকাল।
দেশাত্মবোধক গান, কবিতা-নির্ভর গান, নাট্যগীত—প্রতিটি ঘরানায় ছিল তার সাবলীল যাতায়াত।
আজ যখন দেখি এতগুলো চ্যানেল, পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—কোথাও তার নাম নেই, তার সম্পর্কে কোনো লেখা নেই, মনটা ভার হয়ে আসে।
আগামী প্রজন্ম জানবে না এক মিষ্টি, মধুর, মায়াবী সুরকার ছিলেন এই বাংলায়,
যার নাম ছিল খন্দকার নুরুল আলম।
তাকে নিয়ে চর্চা হয় না—এই দায়ভার কাকে দেব?
নাকি এটিই আমাদের সংস্কৃতির নিষ্ঠুর বাস্তবতা?
স্মৃতির থেকে লেখা ডায়েরিতে আর পাতা নেই অথচ খন্দকার ভাইকে নিয়ে বলার অনেক কিছুই বাকি। কত স্মৃতি, কত মুহূর্ত, কত গান—যেগুলোর একটাও ঠিকমতো লেখা হলো না। হয়তো হবে না কখনো।
তার সুরে আমার কিশোরীবেলা, আমার কাজ, আমার আত্মীয়তা আর এক অব্যক্ত মায়া জড়িয়ে আছে।
তিনি ছিলেন নিঃশব্দ এক দীপ্তি—কখনো দাবিদার হননি অথচ যে আলো তিনি রেখে গেছেন, তা নিভে যাওয়ার নয়।
আমার এই লেখা কোনো শ্রদ্ধাঞ্জলি নয়,
এ এক অন্তরের কথা—

