• facebook
  • fb_group
  • twitter
  • tiktok
  • whatsapp
  • pinterest
  • youtube
  • linkedin
  • instagram
  • google
শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ
জাতীয়
রাজনীতি
বাণিজ্য
সারা দেশ
বিশ্ব
খেলা
আইন-আদালত
ধর্ম ও ইসলাম
বিনোদন
ফিচার
আমার দেশ পরিবার
ইপেপার
আমার দেশযোগাযোগশর্তাবলি ও নীতিমালাগোপনীয়তা নীতিডিএমসিএ
facebookfb_grouptwittertiktokwhatsapppinterestyoutubelinkedininstagramgoogle
স্বত্ব: ©️ আমার দেশ | সম্পাদক ও প্রকাশক, মাহমুদুর রহমান 
মাহমুদুর রহমান কর্তৃক ঢাকা ট্রেড সেন্টার (৮ম ফ্লোর), ৯৯, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫ থেকে প্রকাশিত এবং আমার দেশ পাবলিকেশন লিমিটেড প্রেস, ৪৪৬/সি ও ৪৪৬/ডি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্য বিভাগ: ঢাকা ট্রেড সেন্টার, ৯৯, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।ফোন: ০২-৫৫০১২২৫০। ই-মেইল: info@dailyamardesh.comবার্তা: ফোন: ০৯৬৬৬-৭৪৭৪০০। ই-মেইল: news@dailyamardesh.comবিজ্ঞাপন: ফোন: +৮৮০-১৭১৫-০২৫৪৩৪ । ই-মেইল: ad@dailyamardesh.comসার্কুলেশন: ফোন: +৮৮০-০১৮১৯-৮৭৮৬৮৭ । ই-মেইল: circulation@dailyamardesh.com
ওয়েব মেইল
কনভার্টারআর্কাইভবিজ্ঞাপনসাইটম্যাপ
> মতামত

অদূরদর্শী নেতাদের বিজয় : দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা

ড. সিরাজুল আই. ভূঁইয়া
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৭
logo
অদূরদর্শী নেতাদের বিজয় : দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা

ড. সিরাজুল আই. ভূঁইয়া

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৭
ড. সিরাজুল আই ভুইয়া

ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার বৈপরীত্য

মানব ইতিহাসের দীর্ঘ ধারায় এরিস্টটলের এথেন্স থেকে আজকের দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত একটি প্রশ্ন অবিরত তাড়িয়ে বেড়ায়—‘কেন সমাজ প্রায়ই ক্ষমতার আসনে বসায় তাদেরই, যারা প্রজ্ঞাবান নয়, নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ নয়, কিংবা দূরদর্শী নয়?’

এই প্রশ্নই রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে নিহিত। এরিস্টটল সতর্ক করেছিলেন, যখন শাসনব্যবস্থা থেকে নৈতিকতা (arete) ও বাস্তব প্রজ্ঞা (phronesis) হারিয়ে যায়, তখন রাষ্ট্র অনিবার্যভাবে নৈতিক অবক্ষয় ও মধ্যম মানের শাসনে পতিত হয়। আড়াই হাজার বছর পর দক্ষিণ এশিয়া তার সেই ভবিষ্যদ্বাণীর এক জীবন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী কঠোরতা থেকে শুরু করে ভারতে নরেন্দ্র মোদির জনতাবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, পাকিস্তানে ইমরান খানের ব্যক্তিনির্ভর জনপ্রিয়তা, কিংবা শ্রীলঙ্কায় রনিল বিক্রমাসিংহের সংকটনির্ভর ধারাবাহিকতা—সব মিলিয়ে গোটা অঞ্চল যেন এক রাজনৈতিক মোজাইক, যার প্রতিটি খণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে একই থিম—‘দর্শনের প্রজ্ঞার ওপর রাজনৈতিক কৌশলের বিজয়।’

এই সমাজগুলোর ক্ষমতার করিডোর ভরে আছে রাজনৈতিক চালাকদের দ্বারা, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক দ্বারা নয়। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা বা নৈতিক সাহস নয়, বরং আনুগত্য, আবেগ ও জনতাবাদকে পুরস্কৃত করে, এমন ব্যবস্থায় টিকে থাকার কলা আয়ত্ত করেছে।

মূল তত্ত্ব : মধ্যমতার কাঠামোগত যুক্তি

এরিস্টটল রাষ্ট্রকে (polis) একটি নৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে দেখেছিলেন, যার উদ্দেশ্য হলো মানুষের পূর্ণ বিকাশ eudaimonia। কিন্তু যখন রাজনীতি নৈতিক অভিযাত্রা না হয়ে প্রভাব বিস্তারের পেশা হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্র রূপ নেয় ‘বিকৃত সংবিধান”-এ, তার ভাষায় একটি deviant constitution।

দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি এই অবক্ষয়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সমস্যা কেবল ব্যক্তির দুর্নীতি বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, এটি কাঠামোগত। পৃষ্ঠপোষকতা, বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ও ব্যক্তিপূজার ওপর নির্মিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মধ্যম মানের নেতৃত্বকেই পুনরুৎপাদন করে।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দশকব্যাপী ক্ষমতা সংহতকরণ আওয়ামী লীগকে আদর্শিক দল থেকে আনুগত্যভিত্তিক যন্ত্রে পরিণত করেছে। তার কারিগরি নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করলেও সেটির বিনিময়ে দমন করা হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধ্বংস করা হয়েছে বহুত্ববাদ, আর নীরব করে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের নৈতিক বিবেক। এরিস্টটলের দৃষ্টিতে এটি ‘নৈতিকতা ছাড়া শৃঙ্খলার বিজয়’, যেখানে শাসন কেবল যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে সীমিত, নৈতিক দর্শন অনুপস্থিত।

ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব গণতন্ত্রকে জনতাবাদী প্রদর্শনীতে রূপান্তর করেছে। তার ভাষণ যুক্তির চেয়ে বেশি নির্ভর করে পরিচয় ও আবেগের ওপর। এরিস্টটল সতর্ক করেছিলেন, এমন নেতারা demagogue জনগণের আবেগকে অস্ত্র বানিয়ে ক্ষমতা অর্জন করেন এবং গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার নৈতিকতাকেই ক্ষয় করেন।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রে পাকিস্তানে ইমরান খানের বিভাজনমূলক জনতাবাদ, নেপালের গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতি, কিংবা শ্রীলঙ্কার লেনদেনভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় একই ধারা দেখা যায়—আনুগত্য, ক্যারিশমা ও জনতাবাদের পুরস্কার মেলে; প্রজ্ঞা ও নৈতিকতার অধিকারীরা হারিয়ে যায়।

অতএব এই অঞ্চলের রাজনৈতিক বিকলতা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি এক সুসংগঠিত ব্যবস্থার পূর্বনির্ধারিত ফল, যে ব্যবস্থা রাষ্ট্রনায়ক নয়, টিকে থাকার শিল্পে দক্ষদেরই বেছে নেয়।

ক্ষমতা নৈতিক নয়, কৌশলীকে পুরস্কৃত করে

এরিস্টটলের ভাষায়, আদর্শ শাসক শাসন করেন জনগণের মঙ্গলার্থে, অথচ অপ্রাজ্ঞ নেতা শাসন করেন নিজের স্বার্থে বা গোষ্ঠীর সুবিধার জন্য। আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্ব এই গোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রণের কলা আয়ত্ত করেছে।

বাংলাদেশের শেখ হাসিনার শাসন দেখায়, কীভাবে আনুগত্য ও নিয়ন্ত্রণ দূরদর্শিতাকে অতিক্রম করে। তার সরকারের গোয়েন্দা নজরদারি, বিচারব্যবস্থার ওপর প্রভাব এবং মতভিন্নতার প্রতি অসহিষ্ণুতা এমন এক আমলাতান্ত্রিক প্রজন্ম সৃষ্টি করেছে, যারা উদ্ভাবনের চেয়ে আনুগত্যে বেশি পারদর্শী।

ভারতে নরেন্দ্র মোদির শাসনও দেখায়, কীভাবে জনতাবাদ বহুত্ববাদকে গ্রাস করে। তার নির্বাচনি শক্তি নীতিগত আলোচনা নয়, বরং জাতীয়তাবাদী পরিচয় ও ধর্মীয় আবেগের সূক্ষ্ম বিন্যাসের ওপর দাঁড়িয়ে। তিনি ধর্মীয় আবেগ ও জাতীয় গর্বকে কাজে লাগিয়ে কর্তৃত্ব বজায় রাখেন এরিস্টটলের ‘জনতাবাদী নেতা’রই আধুনিক প্রতিরূপ, যিনি ‘জনগণের তোষামোদ করে গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করেন’।

পাকিস্তানে ইমরান খান একসময় সংস্কারক হিসেবে আবির্ভূত হলেও তার রাজনীতি দ্রুত ব্যক্তিপূজা ও সংঘর্ষে রূপ নেয়; প্রাতিষ্ঠানিক নির্মাণ সেখানে অধরা। শ্রীলঙ্কায় রনিল বিক্রমাসিংহে, বুদ্ধিবৃত্তিক হলেও, গণঅংশগ্রহণের পরিবর্তে এলিট ঐকমত্যের ভিত্তিতে শাসন করেন এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে টিকে থাকার কৌশলকেই অগ্রাধিকার দেন। নেপালের সাবেক বিপ্লবী পুষ্পকমল দাহাল ‘প্রচণ্ড’ আজ জোটনির্ভর সমঝোতার রাজনীতিতে সেই নৈতিক আদর্শ হারিয়েছেন, যা একসময় তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

প্রত্যেক উদাহরণই এরিস্টটলের একই শিক্ষা প্রতিফলিত করে—যখন রাজনৈতিক সাফল্য নৈতিকতার চেয়ে কৌশলের ওপর নির্ভর করে, নেতৃত্ব তখন নাট্যরূপ ধারণ করে রূপান্তর নয়, অভিনয়।

ন্যায়ের চেয়ে স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষা

এরিস্টটল লক্ষ করেছিলেন, সমাজ প্রায়ই ন্যায়ের চেয়ে স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ দীর্ঘকাল ধরে সংঘাত, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলায় ক্লান্ত, প্রায়ই শৃঙ্খলার বিনিময়ে স্বৈরতন্ত্র মেনে নেয়।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সমর্থকরা মনে করেন, তার ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বিশৃঙ্খলা ঠেকানোর প্রয়োজনীয় উপায়, যদিও তা গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে। মোদির কর্তৃত্বও একইভাবে জাতীয় ঐক্য রক্ষার অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপিত হয়। উভয় ক্ষেত্রেই জনগণ স্থিতিশীলতার নামে তাদের নৈতিক স্বাধীনতাই ত্যাগ করে।

এরিস্টটলের মতে, এই ‘শৃঙ্খলার আকাঙ্ক্ষা’ গভীরতর নৈতিক ক্লান্তির লক্ষণ। যখন নাগরিকরা নৈতিকতাকে আর জনকল্যাণ হিসেবে বিশ্বাস করে না, তখন তারা পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে; ফল হয় শান্তি নয়, নিয়ন্ত্রিত স্থবিরতা।

প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতা ও আনুগত্যের চক্র

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শাসকদের নৈতিক চরিত্রই প্রতিফলিত করে। আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক দল ও বিচারব্যবস্থা প্রশ্ন তুলতে নয়, মানিয়ে নিতে শেখে। এরিস্টটলের ভাষায়, এর দীর্ঘমেয়াদি ফল ‘ব্যবস্থাগত নৈতিক অবক্ষয়’।

বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র নাগরিকদের নয়, শাসকদলের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত। ভারতে প্রশাসন ক্রমেই আদর্শগত মেরূকরণের শিকার। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার সামরিক প্রভাব ও জনতাবাদী দখলের মধ্যে দোদুল্যমান। শ্রীলঙ্কার প্রশাসনিক কাঠামো দশকের পর দশক পৃষ্ঠপোষকতার ফলে শূন্য হয়ে পড়েছে।

এই স্থবিরতা নিশ্চিত করে যে সংস্কারকরা কখনো ওপরে উঠতে পারেন না; যারা প্রশ্ন তোলে তারা সরিয়ে দেওয়া হয়, যারা মানিয়ে নেয় তারা পুরস্কৃত হয়। অদূরদর্শী নেতৃত্ব তাই কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি সচেতনভাবে তৈরি এক প্রক্রিয়া।

নাগরিক বিচ্ছিন্নতা ও নৈতিকতার অবক্ষয়

এরিস্টটলের শেষ সতর্কবার্তা ছিল, নাগরিক নৈতিকতা হারালে গণতন্ত্র ভেঙে পড়ে। যখন নাগরিকরা নিরাশ, অজ্ঞ বা ভীত হয়ে পড়ে, তখন তারা আর প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের দাবি তোলে না। দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষিত সমাজ রাজনীতিকে প্রায়ই নোংরা ও অনার্জনীয় মনে করে, ফলে শাসন চলে যায় সুযোগসন্ধানীদের হাতে।

বাংলাদেশে নাগরিক আন্দোলন দমন করা হয়েছে আইনগত ভয় দেখিয়ে; ভারতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ রাষ্ট্র ও করপোরেট চাপে আক্রান্ত; পাকিস্তানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিপ্লবী উচ্ছ্বাস ও পরিত্যাগের মধ্যে দোলাচলে; শ্রীলঙ্কা ও নেপালে অর্থনৈতিক হতাশা জন্ম দিয়েছে নৈতিক উদাসীনতার।

এরিস্টটলের মতে, নাগরিক নৈতিকতা ছাড়া গণতন্ত্র অবশ্যম্ভাবীভাবে আবেগনির্ভর জনতাবাদে পরিণত হয়। নাগরিকরা যখন সরে যায়, তখন মধ্যমতা শূন্যতা পূরণ করে।

মধ্যমতার স্থায়ী আধিপত্য

দক্ষিণ এশিয়ার শাসন আজ প্রশাসনিক, দূরদর্শী নয়। নেতারা বর্তমান পরিচালনা করেন, ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে ব্যর্থ হন। নীতি প্রতিক্রিয়াশীল, সংস্কারমূলক নয়; সাফল্যের মানদণ্ড নৈতিক অগ্রগতি নয়, রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখায়, কিন্তু কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণে শ্বাসরুদ্ধ; ভারতে মোদির ডিজিটাল অগ্রগতি গণতন্ত্রকে বিপন্ন করছে; পাকিস্তান দোদুল্যমান বেসামরিক জনতাবাদ ও সামরিক অভিভাবকত্বের মধ্যে; শ্রীলঙ্কা ঋণে নিমজ্জিত লেনদেনমূলক রাজনীতির প্রতীক; আর নেপাল জোটভিত্তিক অচলাবস্থার ঘূর্ণিতে বন্দি।

এরিস্টটল হয়তো বলতেন, এ সমাজগুলো ভুগছে ‘রাজনৈতিক স্বল্পদৃষ্টির রোগে’, যেখানে অগ্রগতির মুখোশে নৈতিক অবক্ষয় লুকিয়ে থাকে।

জনকল্যাণের ক্ষয়

যখন নেতৃত্বের কাছে বাস্তব প্রজ্ঞা অনুপস্থিত থাকে, তখন শাসন পরিণত হয় প্রদর্শনীতে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক স্লোগান; উন্নয়ন পরিণত হয় প্রচারণায়। রাজনীতির telos, অর্থাৎ জনকল্যাণের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য প্রতিস্থাপিত হয় বৈধতা ও উত্তরাধিকারের অনুসন্ধানে।

এই নৈতিক উদ্দেশ্যের ক্ষয় সৃষ্টি করে এক ‘মায়াবী শাসনব্যবস্থা’, যা বাইরে স্থিতিশীল, কিন্তু ভেতরে শূন্য। জনকল্যাণ হয়ে পড়ে গৌণ; ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাই একমাত্র লক্ষ্য।

রাজনীতির আত্মা পুনর্গঠন : এরিস্টটলের প্রস্তাবনা

এরিস্টটলের সমাধান—চিরন্তন অহংকার নয়, নৈতিকতা লালন করা। যে সমাজ নৈতিক নাগরিক তৈরি করতে পারে, সে-ই শেষ পর্যন্ত নৈতিক নেতা সৃষ্টি করবে। দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র পুনর্গঠন শুরু করতে হবে নাগরিক শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক বিশ্লেষণ, যুক্তিবাদ ও কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করার সাহস থেকে।

বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মকে শেখাতে হবে শুধু আনুগত্য নয়, চিন্তাশক্তি; ভারতে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেক; পাকিস্তানকে মুক্ত হতে হবে ‘উদ্ধারকর্তা’ সংস্কৃতি থেকে; শ্রীলঙ্কাকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে নাগরিক আস্থা; নেপালকে পুনরাবিষ্কার করতে হবে সেই নৈতিক আদর্শ, যা একদিন তার বিপ্লবকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

যে সমাজ বুদ্ধি, সহমর্মিতা ও সততার মর্যাদা দেয়, সে আর অপ্রাজ্ঞ নেতৃত্ব সৃষ্টি করবে না, সে ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্ব গড়বে।

দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এরিস্টটলের শিক্ষা

এরিস্টটলের শাসন ত্রয়ী রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্র নৈতিকতা হারালে রূপ নেয় স্বৈরতন্ত্র, অলিগার্কি ও জনতাবাদে। দক্ষিণ এশিয়া এই চক্র বহুবার অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা নেপালের বিপ্লব সবই একসময় মুক্তির প্রতিশ্রুতি ছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই পরিণত হয়েছে বংশানুক্রমিক বা জনতাবাদী রাজনীতিতে।

এরিস্টটলের শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক—শুধু তত্ত্বগত নয়, নৈতিকভাবেও জরুরি। যতদিন না নৈতিকতা নেতৃত্ব নির্বাচনের ভিত্তি হয়, দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র ততদিন থাকবে ভঙ্গুর, প্রতিক্রিয়াশীল ও নৈতিকভাবে নিঃশেষ।

এরিস্টটলের শিক্ষা আজও ঢাকা ও দিল্লির মতোই প্রযোজ্য, যেমনটি ছিল এথেন্সে—রাজনীতি নাগরিকের আত্মার প্রতিফলন। যখন সমাজ নৈতিকতার দাবি ত্যাগ করে, তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে তারা অদূরদর্শী নেতৃত্বের অধীনে পড়ে।

শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদ, মোদির জনতাবাদ, খানের অস্থিরতা, বিক্রমাসিংহের অভিজাত একচেটিয়াত্ব এবং প্রচণ্ডের আপসকামী রাজনীতি—এগুলো কোনো ব্যতিক্রম নয়, এগুলো সমাজের নৈতিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

আমাদের যুগের ট্র্যাজেডি এই নয় যে, অপ্রাজ্ঞরা ক্ষমতায় ওঠে; বরং এই যে, প্রাজ্ঞরা রাজনীতি থেকে সরে যায়। এই পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে দক্ষিণ এশিয়াকে নতুন এক রাজনৈতিক নৈতিকতা গড়ে তুলতে হবে, যা সত্য, বিনয় ও নৈতিক কল্পনাশক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

শিক্ষা যখন যুক্তিবোধ ফিরিয়ে আনবে, প্রতিষ্ঠান যখন সততাকে পুরস্কৃত করবে, আর নাগরিকরা যখন আবার সাহস খুঁজে পাবে, তখনই এই অঞ্চল মুক্তি পাবে এরিস্টটলের বৈপরীত্য থেকে। তখন হয়তো ক্ষমতা আর অপ্রাজ্ঞদের আশ্রয়স্থল নয়, বরং ন্যায়বানদের দায়িত্ব হয়ে উঠবে।

লেখক : সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগের অধ্যাপক, সাভানাহ স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

সম্পাদক ও প্রকাশক : মাহমুদুর রহমান কর্তৃক প্রকাশিত এবং আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস, ৪২৩, এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭ থেকে এবং অস্থায়ীভাবে মিডিয়া প্রিন্টার্স লি. ৪৪৬/এইচ, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্য বিভাগ : ঢাকা ট্রেড সেন্টার, ৯৯, কাজী নজরুল ইসলাম এভিণিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫। পিএবিএক্স : ০২-৫৫০১২২৫০। ই-মেইল : info@dailyamardesh.com
ড. সিরাজুল আই ভুইয়া

ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার বৈপরীত্য

মানব ইতিহাসের দীর্ঘ ধারায় এরিস্টটলের এথেন্স থেকে আজকের দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত একটি প্রশ্ন অবিরত তাড়িয়ে বেড়ায়—‘কেন সমাজ প্রায়ই ক্ষমতার আসনে বসায় তাদেরই, যারা প্রজ্ঞাবান নয়, নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ নয়, কিংবা দূরদর্শী নয়?’

বিজ্ঞাপন

এই প্রশ্নই রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে নিহিত। এরিস্টটল সতর্ক করেছিলেন, যখন শাসনব্যবস্থা থেকে নৈতিকতা (arete) ও বাস্তব প্রজ্ঞা (phronesis) হারিয়ে যায়, তখন রাষ্ট্র অনিবার্যভাবে নৈতিক অবক্ষয় ও মধ্যম মানের শাসনে পতিত হয়। আড়াই হাজার বছর পর দক্ষিণ এশিয়া তার সেই ভবিষ্যদ্বাণীর এক জীবন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী কঠোরতা থেকে শুরু করে ভারতে নরেন্দ্র মোদির জনতাবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, পাকিস্তানে ইমরান খানের ব্যক্তিনির্ভর জনপ্রিয়তা, কিংবা শ্রীলঙ্কায় রনিল বিক্রমাসিংহের সংকটনির্ভর ধারাবাহিকতা—সব মিলিয়ে গোটা অঞ্চল যেন এক রাজনৈতিক মোজাইক, যার প্রতিটি খণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে একই থিম—‘দর্শনের প্রজ্ঞার ওপর রাজনৈতিক কৌশলের বিজয়।’

এই সমাজগুলোর ক্ষমতার করিডোর ভরে আছে রাজনৈতিক চালাকদের দ্বারা, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক দ্বারা নয়। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা বা নৈতিক সাহস নয়, বরং আনুগত্য, আবেগ ও জনতাবাদকে পুরস্কৃত করে, এমন ব্যবস্থায় টিকে থাকার কলা আয়ত্ত করেছে।

মূল তত্ত্ব : মধ্যমতার কাঠামোগত যুক্তি

এরিস্টটল রাষ্ট্রকে (polis) একটি নৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে দেখেছিলেন, যার উদ্দেশ্য হলো মানুষের পূর্ণ বিকাশ eudaimonia। কিন্তু যখন রাজনীতি নৈতিক অভিযাত্রা না হয়ে প্রভাব বিস্তারের পেশা হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্র রূপ নেয় ‘বিকৃত সংবিধান”-এ, তার ভাষায় একটি deviant constitution।

দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি এই অবক্ষয়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সমস্যা কেবল ব্যক্তির দুর্নীতি বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, এটি কাঠামোগত। পৃষ্ঠপোষকতা, বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ও ব্যক্তিপূজার ওপর নির্মিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মধ্যম মানের নেতৃত্বকেই পুনরুৎপাদন করে।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দশকব্যাপী ক্ষমতা সংহতকরণ আওয়ামী লীগকে আদর্শিক দল থেকে আনুগত্যভিত্তিক যন্ত্রে পরিণত করেছে। তার কারিগরি নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করলেও সেটির বিনিময়ে দমন করা হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধ্বংস করা হয়েছে বহুত্ববাদ, আর নীরব করে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের নৈতিক বিবেক। এরিস্টটলের দৃষ্টিতে এটি ‘নৈতিকতা ছাড়া শৃঙ্খলার বিজয়’, যেখানে শাসন কেবল যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে সীমিত, নৈতিক দর্শন অনুপস্থিত।

ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব গণতন্ত্রকে জনতাবাদী প্রদর্শনীতে রূপান্তর করেছে। তার ভাষণ যুক্তির চেয়ে বেশি নির্ভর করে পরিচয় ও আবেগের ওপর। এরিস্টটল সতর্ক করেছিলেন, এমন নেতারা demagogue জনগণের আবেগকে অস্ত্র বানিয়ে ক্ষমতা অর্জন করেন এবং গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার নৈতিকতাকেই ক্ষয় করেন।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রে পাকিস্তানে ইমরান খানের বিভাজনমূলক জনতাবাদ, নেপালের গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতি, কিংবা শ্রীলঙ্কার লেনদেনভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় একই ধারা দেখা যায়—আনুগত্য, ক্যারিশমা ও জনতাবাদের পুরস্কার মেলে; প্রজ্ঞা ও নৈতিকতার অধিকারীরা হারিয়ে যায়।

অতএব এই অঞ্চলের রাজনৈতিক বিকলতা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি এক সুসংগঠিত ব্যবস্থার পূর্বনির্ধারিত ফল, যে ব্যবস্থা রাষ্ট্রনায়ক নয়, টিকে থাকার শিল্পে দক্ষদেরই বেছে নেয়।

ক্ষমতা নৈতিক নয়, কৌশলীকে পুরস্কৃত করে

এরিস্টটলের ভাষায়, আদর্শ শাসক শাসন করেন জনগণের মঙ্গলার্থে, অথচ অপ্রাজ্ঞ নেতা শাসন করেন নিজের স্বার্থে বা গোষ্ঠীর সুবিধার জন্য। আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্ব এই গোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রণের কলা আয়ত্ত করেছে।

বাংলাদেশের শেখ হাসিনার শাসন দেখায়, কীভাবে আনুগত্য ও নিয়ন্ত্রণ দূরদর্শিতাকে অতিক্রম করে। তার সরকারের গোয়েন্দা নজরদারি, বিচারব্যবস্থার ওপর প্রভাব এবং মতভিন্নতার প্রতি অসহিষ্ণুতা এমন এক আমলাতান্ত্রিক প্রজন্ম সৃষ্টি করেছে, যারা উদ্ভাবনের চেয়ে আনুগত্যে বেশি পারদর্শী।

ভারতে নরেন্দ্র মোদির শাসনও দেখায়, কীভাবে জনতাবাদ বহুত্ববাদকে গ্রাস করে। তার নির্বাচনি শক্তি নীতিগত আলোচনা নয়, বরং জাতীয়তাবাদী পরিচয় ও ধর্মীয় আবেগের সূক্ষ্ম বিন্যাসের ওপর দাঁড়িয়ে। তিনি ধর্মীয় আবেগ ও জাতীয় গর্বকে কাজে লাগিয়ে কর্তৃত্ব বজায় রাখেন এরিস্টটলের ‘জনতাবাদী নেতা’রই আধুনিক প্রতিরূপ, যিনি ‘জনগণের তোষামোদ করে গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করেন’।

পাকিস্তানে ইমরান খান একসময় সংস্কারক হিসেবে আবির্ভূত হলেও তার রাজনীতি দ্রুত ব্যক্তিপূজা ও সংঘর্ষে রূপ নেয়; প্রাতিষ্ঠানিক নির্মাণ সেখানে অধরা। শ্রীলঙ্কায় রনিল বিক্রমাসিংহে, বুদ্ধিবৃত্তিক হলেও, গণঅংশগ্রহণের পরিবর্তে এলিট ঐকমত্যের ভিত্তিতে শাসন করেন এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে টিকে থাকার কৌশলকেই অগ্রাধিকার দেন। নেপালের সাবেক বিপ্লবী পুষ্পকমল দাহাল ‘প্রচণ্ড’ আজ জোটনির্ভর সমঝোতার রাজনীতিতে সেই নৈতিক আদর্শ হারিয়েছেন, যা একসময় তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

প্রত্যেক উদাহরণই এরিস্টটলের একই শিক্ষা প্রতিফলিত করে—যখন রাজনৈতিক সাফল্য নৈতিকতার চেয়ে কৌশলের ওপর নির্ভর করে, নেতৃত্ব তখন নাট্যরূপ ধারণ করে রূপান্তর নয়, অভিনয়।

ন্যায়ের চেয়ে স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষা

এরিস্টটল লক্ষ করেছিলেন, সমাজ প্রায়ই ন্যায়ের চেয়ে স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ দীর্ঘকাল ধরে সংঘাত, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলায় ক্লান্ত, প্রায়ই শৃঙ্খলার বিনিময়ে স্বৈরতন্ত্র মেনে নেয়।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সমর্থকরা মনে করেন, তার ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বিশৃঙ্খলা ঠেকানোর প্রয়োজনীয় উপায়, যদিও তা গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে। মোদির কর্তৃত্বও একইভাবে জাতীয় ঐক্য রক্ষার অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপিত হয়। উভয় ক্ষেত্রেই জনগণ স্থিতিশীলতার নামে তাদের নৈতিক স্বাধীনতাই ত্যাগ করে।

এরিস্টটলের মতে, এই ‘শৃঙ্খলার আকাঙ্ক্ষা’ গভীরতর নৈতিক ক্লান্তির লক্ষণ। যখন নাগরিকরা নৈতিকতাকে আর জনকল্যাণ হিসেবে বিশ্বাস করে না, তখন তারা পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে; ফল হয় শান্তি নয়, নিয়ন্ত্রিত স্থবিরতা।

প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতা ও আনুগত্যের চক্র

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শাসকদের নৈতিক চরিত্রই প্রতিফলিত করে। আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক দল ও বিচারব্যবস্থা প্রশ্ন তুলতে নয়, মানিয়ে নিতে শেখে। এরিস্টটলের ভাষায়, এর দীর্ঘমেয়াদি ফল ‘ব্যবস্থাগত নৈতিক অবক্ষয়’।

বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র নাগরিকদের নয়, শাসকদলের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত। ভারতে প্রশাসন ক্রমেই আদর্শগত মেরূকরণের শিকার। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার সামরিক প্রভাব ও জনতাবাদী দখলের মধ্যে দোদুল্যমান। শ্রীলঙ্কার প্রশাসনিক কাঠামো দশকের পর দশক পৃষ্ঠপোষকতার ফলে শূন্য হয়ে পড়েছে।

এই স্থবিরতা নিশ্চিত করে যে সংস্কারকরা কখনো ওপরে উঠতে পারেন না; যারা প্রশ্ন তোলে তারা সরিয়ে দেওয়া হয়, যারা মানিয়ে নেয় তারা পুরস্কৃত হয়। অদূরদর্শী নেতৃত্ব তাই কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি সচেতনভাবে তৈরি এক প্রক্রিয়া।

নাগরিক বিচ্ছিন্নতা ও নৈতিকতার অবক্ষয়

এরিস্টটলের শেষ সতর্কবার্তা ছিল, নাগরিক নৈতিকতা হারালে গণতন্ত্র ভেঙে পড়ে। যখন নাগরিকরা নিরাশ, অজ্ঞ বা ভীত হয়ে পড়ে, তখন তারা আর প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের দাবি তোলে না। দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষিত সমাজ রাজনীতিকে প্রায়ই নোংরা ও অনার্জনীয় মনে করে, ফলে শাসন চলে যায় সুযোগসন্ধানীদের হাতে।

বাংলাদেশে নাগরিক আন্দোলন দমন করা হয়েছে আইনগত ভয় দেখিয়ে; ভারতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ রাষ্ট্র ও করপোরেট চাপে আক্রান্ত; পাকিস্তানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিপ্লবী উচ্ছ্বাস ও পরিত্যাগের মধ্যে দোলাচলে; শ্রীলঙ্কা ও নেপালে অর্থনৈতিক হতাশা জন্ম দিয়েছে নৈতিক উদাসীনতার।

এরিস্টটলের মতে, নাগরিক নৈতিকতা ছাড়া গণতন্ত্র অবশ্যম্ভাবীভাবে আবেগনির্ভর জনতাবাদে পরিণত হয়। নাগরিকরা যখন সরে যায়, তখন মধ্যমতা শূন্যতা পূরণ করে।

মধ্যমতার স্থায়ী আধিপত্য

দক্ষিণ এশিয়ার শাসন আজ প্রশাসনিক, দূরদর্শী নয়। নেতারা বর্তমান পরিচালনা করেন, ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে ব্যর্থ হন। নীতি প্রতিক্রিয়াশীল, সংস্কারমূলক নয়; সাফল্যের মানদণ্ড নৈতিক অগ্রগতি নয়, রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখায়, কিন্তু কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণে শ্বাসরুদ্ধ; ভারতে মোদির ডিজিটাল অগ্রগতি গণতন্ত্রকে বিপন্ন করছে; পাকিস্তান দোদুল্যমান বেসামরিক জনতাবাদ ও সামরিক অভিভাবকত্বের মধ্যে; শ্রীলঙ্কা ঋণে নিমজ্জিত লেনদেনমূলক রাজনীতির প্রতীক; আর নেপাল জোটভিত্তিক অচলাবস্থার ঘূর্ণিতে বন্দি।

এরিস্টটল হয়তো বলতেন, এ সমাজগুলো ভুগছে ‘রাজনৈতিক স্বল্পদৃষ্টির রোগে’, যেখানে অগ্রগতির মুখোশে নৈতিক অবক্ষয় লুকিয়ে থাকে।

জনকল্যাণের ক্ষয়

যখন নেতৃত্বের কাছে বাস্তব প্রজ্ঞা অনুপস্থিত থাকে, তখন শাসন পরিণত হয় প্রদর্শনীতে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক স্লোগান; উন্নয়ন পরিণত হয় প্রচারণায়। রাজনীতির telos, অর্থাৎ জনকল্যাণের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য প্রতিস্থাপিত হয় বৈধতা ও উত্তরাধিকারের অনুসন্ধানে।

এই নৈতিক উদ্দেশ্যের ক্ষয় সৃষ্টি করে এক ‘মায়াবী শাসনব্যবস্থা’, যা বাইরে স্থিতিশীল, কিন্তু ভেতরে শূন্য। জনকল্যাণ হয়ে পড়ে গৌণ; ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাই একমাত্র লক্ষ্য।

রাজনীতির আত্মা পুনর্গঠন : এরিস্টটলের প্রস্তাবনা

এরিস্টটলের সমাধান—চিরন্তন অহংকার নয়, নৈতিকতা লালন করা। যে সমাজ নৈতিক নাগরিক তৈরি করতে পারে, সে-ই শেষ পর্যন্ত নৈতিক নেতা সৃষ্টি করবে। দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র পুনর্গঠন শুরু করতে হবে নাগরিক শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক বিশ্লেষণ, যুক্তিবাদ ও কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করার সাহস থেকে।

বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মকে শেখাতে হবে শুধু আনুগত্য নয়, চিন্তাশক্তি; ভারতে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেক; পাকিস্তানকে মুক্ত হতে হবে ‘উদ্ধারকর্তা’ সংস্কৃতি থেকে; শ্রীলঙ্কাকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে নাগরিক আস্থা; নেপালকে পুনরাবিষ্কার করতে হবে সেই নৈতিক আদর্শ, যা একদিন তার বিপ্লবকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

যে সমাজ বুদ্ধি, সহমর্মিতা ও সততার মর্যাদা দেয়, সে আর অপ্রাজ্ঞ নেতৃত্ব সৃষ্টি করবে না, সে ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্ব গড়বে।

দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এরিস্টটলের শিক্ষা

এরিস্টটলের শাসন ত্রয়ী রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্র নৈতিকতা হারালে রূপ নেয় স্বৈরতন্ত্র, অলিগার্কি ও জনতাবাদে। দক্ষিণ এশিয়া এই চক্র বহুবার অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা নেপালের বিপ্লব সবই একসময় মুক্তির প্রতিশ্রুতি ছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই পরিণত হয়েছে বংশানুক্রমিক বা জনতাবাদী রাজনীতিতে।

এরিস্টটলের শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক—শুধু তত্ত্বগত নয়, নৈতিকভাবেও জরুরি। যতদিন না নৈতিকতা নেতৃত্ব নির্বাচনের ভিত্তি হয়, দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র ততদিন থাকবে ভঙ্গুর, প্রতিক্রিয়াশীল ও নৈতিকভাবে নিঃশেষ।

এরিস্টটলের শিক্ষা আজও ঢাকা ও দিল্লির মতোই প্রযোজ্য, যেমনটি ছিল এথেন্সে—রাজনীতি নাগরিকের আত্মার প্রতিফলন। যখন সমাজ নৈতিকতার দাবি ত্যাগ করে, তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে তারা অদূরদর্শী নেতৃত্বের অধীনে পড়ে।

শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদ, মোদির জনতাবাদ, খানের অস্থিরতা, বিক্রমাসিংহের অভিজাত একচেটিয়াত্ব এবং প্রচণ্ডের আপসকামী রাজনীতি—এগুলো কোনো ব্যতিক্রম নয়, এগুলো সমাজের নৈতিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।

আমাদের যুগের ট্র্যাজেডি এই নয় যে, অপ্রাজ্ঞরা ক্ষমতায় ওঠে; বরং এই যে, প্রাজ্ঞরা রাজনীতি থেকে সরে যায়। এই পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে দক্ষিণ এশিয়াকে নতুন এক রাজনৈতিক নৈতিকতা গড়ে তুলতে হবে, যা সত্য, বিনয় ও নৈতিক কল্পনাশক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

শিক্ষা যখন যুক্তিবোধ ফিরিয়ে আনবে, প্রতিষ্ঠান যখন সততাকে পুরস্কৃত করবে, আর নাগরিকরা যখন আবার সাহস খুঁজে পাবে, তখনই এই অঞ্চল মুক্তি পাবে এরিস্টটলের বৈপরীত্য থেকে। তখন হয়তো ক্ষমতা আর অপ্রাজ্ঞদের আশ্রয়স্থল নয়, বরং ন্যায়বানদের দায়িত্ব হয়ে উঠবে।

লেখক : সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগের অধ্যাপক, সাভানাহ স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

আমার দেশসাংবাদিকতা
সর্বশেষ
১

হারিয়ে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জের খেজুর গুড়

২

‘আ.লীগ এখন ভাড়াটে টোকাইদের ওপর নির্ভরশীল’

৩

নিয়মিত হয়েও ‘বহিরাগত’ তকমা আড়াই হাজার শিক্ষার্থীর

৪

পদ্মার চরে খড় ব্যবসাকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী বিরোধ

৫

টানা চার জয়ে বিশ্বকাপের আরও কাছে জার্মানি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত

গ্রাম আদালত : ন্যায়বিচারের নতুন যাত্রা

গ্রাম আদালত শক্তিশালীকরণের তৃতীয় পর্যায় বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থার নতুন দর্শন। যদি এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর চাপ অনেক কমে যাবে। উচ্চ আদালতে মামলা কমে আসবে, ফলে বিচারকরা জটিল মামলা নিষ্পত্তিতে অধিকতর সময় দিতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কথা, গ্রামীণ জনগণ আর ন্যায়বিচারকে দূরের

২ ঘণ্টা আগে

ইরান ও ইসরাইল কি আবার যুদ্ধে জড়াবে?

১২ দিনের তীব্র লড়াইয়ের পর ২০২৫ সালের ২৪ জুন ইসরাইল আর ইরান অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়। কিন্তু এই অঞ্চলের যে গভীর উত্তেজনা, এই চুক্তি সেটা দূর করতে পারেনি। সপ্তাহ কয়েক পরে দুপক্ষই তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা আরো চাঙা করেছে এবং নতুন লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখেছে।

৩ ঘণ্টা আগে

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় ঐক্যের পথ

আমরা যেন একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করছি; দিগন্তে ফুটে উঠেছে একটি আলোর রেখা। অতিকথন নয়, বাস্তবায়নেরই অঙ্গীকার যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সেটাই মনে হলো ড. প্রফেসর ইউনূসের ভাষণ শুনতে শুনতে। মনে হচ্ছিল অতীতের কায়েমি স্বার্থের নিগড়ে বাঁধা পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার ধ্বংসস্তূপে

৩ ঘণ্টা আগে

ডায়াবেটিস : শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক দায়ের রোগ

আজকের দিনে ডায়াবেটিস নিয়ে কথা বললে আমরা প্রায়ই শুনি—‘অতিরিক্ত খাওয়া’, ‘কম ব্যায়াম’, ‘অতিরিক্ত ওজন’ বা ‘জীবনযাত্রার অনিয়ম’। গণমাধ্যমে নিয়মিত এভাবেই ব্যক্তিগত অভ্যাসকেই বেশি দায়ী করা হয়।

১ দিন আগে
গ্রাম আদালত : ন্যায়বিচারের নতুন যাত্রা

গ্রাম আদালত : ন্যায়বিচারের নতুন যাত্রা

অদূরদর্শী নেতাদের বিজয় : দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা

অদূরদর্শী নেতাদের বিজয় : দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা

ইরান ও ইসরাইল কি আবার যুদ্ধে জড়াবে?

ইরান ও ইসরাইল কি আবার যুদ্ধে জড়াবে?

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় ঐক্যের পথ

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় ঐক্যের পথ