কিছু জীবন নীরবে শেষ হয়ে যায়। এমন জীবনের স্মৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা ছড়ালেও ধীরে ধীরে কোমল হয়ে ওঠে। আবার কিছু জীবন আছে, যা কোনো রকম সমাপ্তির সুযোগ না দিয়েই হারিয়ে যায়। তারা রেখে যায় নানা রূপের অসংখ্য প্রশ্ন—যেগুলো ইতিহাসের নীরবতা চাপিয়ে দেওয়া শক্তির কাছে সহজে নত হয় না। ওসমান হাদির মৃত্যু ছিল ঠিক তেমনই এক ঘটনা।
ওসমান হাদির মৃত্যু কেবল একটি রাজনৈতিক কণ্ঠ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ছিল না; তা বাংলাদেশের জনপরিসরের নৈতিক ভূগোলকে গভীরভাবে আলোড়িত করে তুলেছিল।
হাদি এমন এক সময়ে কথা বলেছিলেন, যখন ভাষাকেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হচ্ছিল, যখন ভিন্নমত প্রকাশ ক্রমে বিচ্যুতি হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছিল এবং যখন সংস্কৃতি—যা একসময় ছিল বহুবিধ আনুগত্য ও পরিচয়ের কেন্দ্র—ধীরে ধীরে কেবল নিয়ন্ত্রণের এক যন্ত্রে রূপান্তরিত হচ্ছিল। তার প্রধান অবদান ছিল এই বাস্তবতাকে অসাধারণ স্বচ্ছতায় চিহ্নিত করা—শুধু কর্তৃত্ববাদের উপস্থিতিই নয়, বরং সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ নামক গভীরতর বিপদের অস্তিত্বকে।
তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন কোনো সাধারণ স্লোগান নয়, বরং আমাদের সময়ের ক্ষমতাকে বোঝার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।
এই প্রবন্ধটি ওসমান হাদির প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে কেবল একজন কর্মী বা সংগঠক হিসেবে নয়, বরং একজন নৈতিক দর্শনের অনুশীলনকারী হিসেবে—যিনি স্মৃতি, প্রতীক, নীরবতা ও ভয়ের মধ্য দিয়ে আধিপত্য কীভাবে কার্যকর হয়, তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।
সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ
ফ্যাসিবাদের প্রচলিত সংজ্ঞা খুব সহজেই আমাদের সামনে সহিংস শক্তির চিত্র তুলে ধরে—সংবিধান স্থগিত, সংবাদমাধ্যম দমন এবং রাস্তাঘাটকে সামরিকীকরণ করা। কিন্তু সহিংস শক্তির ধারণা বা বাস্তবতা কোনোভাবেই একটি কার্যকর কিংবা পর্যাপ্ত শাসনপদ্ধতি হতে পারে না, কারণ ক্ষমতা কখনোই কেবল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নির্মিত হয় না; ক্ষমতা গঠিত হয় সম্মতির নির্মাণের মধ্য দিয়ে—সংস্কৃতির মাধ্যমে, শিক্ষার মাধ্যমে এবং ক্ষমতার নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ বা ব্যুরোক্রেটিকীকরণের মাধ্যমে।
ঠিক এই সংযোগস্থলেই সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে। সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ হলো কর্তৃত্ববাদের এমন এক রূপ, যা অর্থের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শাসন করে। সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি নির্ধারণ করে—কোন ইতিহাস পবিত্র এবং কোন ইতিহাস সন্দেহজনক; কোন পরিচয় খাঁটি এবং কোন পরিচয় বিপজ্জনক; কোন অনুভূতি জাতীয় এবং কোন অনুভূতি দেশদ্রোহী। এই পর্যায়ে এসে সংস্কৃতি আর যৌথ উত্তরাধিকার হিসেবে থাকে না; বরং তা একপ্রকার অস্ত্রে পরিণত হয়।
এই বাস্তবতাটি ওসমান হাদি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যখন কোনো জনগোষ্ঠী বা কোনো বিশেষ শ্রেণি একটি জাতির স্মৃতির একচ্ছত্র মালিক হয়ে ওঠে, তখন ‘সংস্কৃতি আর অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্র থাকে না; বরং তা একপ্রকার প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।’
বাংলাদেশ এবং সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদ
সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশে কোনো উচ্চকণ্ঠ বা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রবেশ করেনি। এটি ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করেছে—কখনো স্বাভাবিকতার মুখোশে, কখনো জাতীয়তাবাদের নামে, আবার কখনো ইতিহাসের রক্ষাকর্তৃত্বের অজুহাতে। একসময় যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি যৌথ নৈতিক ভিত্তি, তা ক্রমেই একটি বিভাজিত প্রতীকে পরিণত হচ্ছে, যার স্মরণ ও উদ্যাপন গণতন্ত্রের ভাষায় নয়, বরং ক্ষমতার ভাষায় পরিচালিত হচ্ছে।
এগুলো ইতিহাস সংকোচনেরই ফল। যারা বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখিয়েছেন বা সৎ কিংবা সমালোচনামূলক উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, তারা সন্দেহের মুখে পড়েছেন। এর ফলে সাংবাদিক, গবেষক কিংবা কর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক সময় সরাসরি বলপ্রয়োগ না করেই তাদের ‘অকৃতজ্ঞ’ বা ‘নৈতিকভাবে অধঃপতিত’ প্রভৃতি সামাজিক অপবাদ আরোপের মাধ্যমে জবাবদিহির মুখে ফেলা হয়েছে।
তার আবির্ভাব ছিল অস্বস্তিকর, কারণ তিনি এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছিলেন। তার বার্তা ছিল স্পষ্ট—জাতীয়তাবাদ কখনোই আত্মসমর্পণের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না এবং ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা বর্তমানকে উপেক্ষা করার বৈধ কারণ হতে পারে না। তার মতে, সংস্কৃতির কাজ নাগরিকত্ব নির্ধারণ করা নয়; বরং নাগরিকত্বকে আরো মানবিক করে তোলা।
ভারতীয় আধিপত্য ও নীরবতার রাজনীতি
হাদির বিশ্লেষণ এমন এক পরিসরে প্রবেশ করেছিল, যা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জনপরিসরের আলোচনায় অত্যন্ত অস্বস্তিকর বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। হাদি স্পষ্ট করে দেখিয়েছিলেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদকে ভারতীয় আধিপত্য দ্বারা প্রয়োগকৃত চাপের প্রসঙ্গ ছাড়া বিশ্লেষণ ও বোঝা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর অর্থ ইতিহাস ভাগাভাগির প্রয়োজন বা ভবিষ্যতে একসঙ্গে কাজ করার আবশ্যকতাকে অস্বীকার করা নয়।
হাদির মতে, ভারতীয় আধিপত্য বলপ্রয়োগের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রেষ্ঠ বর্ণনাশৈলীর মাধ্যমে। সৈয়দ নূরুল আইন আহমেদের মতে, ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এমন পরিভাষায় কল্পনা করা হয়, যা ভারতীয় কৌশলগত উদ্বেগকে অন্যান্য সব প্রতিদ্বন্দ্বী দাবির ঊর্ধ্বে স্থান দেয়,’ আর একই সঙ্গে ‘সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, অভিন্ন জলসম্পদের ওপর অধিকার এবং দেশের গণতান্ত্রিক আদর্শ সংরক্ষণের মতো উদ্বেগগুলো আঞ্চলিক বয়ানের ভেতরে প্রান্তিক হয়ে পড়ে, অদৃশ্য হয়ে যায়’—এ কথা তিনি তার ভূমিকায় “The Indian Hegemonic Project and Its ‘Invisibility’ within Bangladesh” শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, যা ‘The Indian Hegemonic Project’ গ্রন্থের ভূমিকা হিসেবে সংকলিত।
এই প্রেক্ষাপটে ‘সাংস্কৃতিক সম্মতি’ বলতে যা বোঝানো হয়, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এল তায়েব লিখেছেন—‘হাদি যে দাবি উত্থাপন করেছিলেন,’ তিনি বলেন, ‘তা ছিল অত্যন্ত সরল, অথচ গভীরভাবে র্যাডিক্যাল: হয় বন্ধুত্বের অর্থ নীরব থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, অথবা যেখানে সাংস্কৃতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় সেখানে সার্বভৌমত্ব অসম্ভব।’ এই বক্তব্য সেই ধারণাকেই প্রতিফলিত করে যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র যদি কোনো কর্তৃত্বের অধীন হয়ে পড়ে, তবে স্বাধীনতার কোনো অর্থ থাকে না। এটাই ছিল সেই ধারণা, যার প্রতি ওসমান হাদি গভীরভাবে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন।
ওসমান হাদি : ক্ষতি ও চিন্তার মাঝখানে
ওসমান হাদিকে কেবল একজন ভুক্তভোগীর মর্যাদায় সীমাবদ্ধ করা মানে ওসমান হাদির প্রকৃত তাৎপর্যকেই উপেক্ষা করা। তার আসল সত্তা নিহিত ছিল অন্যদের অস্বস্তিতে ফেলার ক্ষমতার মধ্যে—অর্থাৎ, শব্দের মাধ্যমে একটি আত্মতুষ্ট বিশ্বদৃষ্টিকে নাড়িয়ে দেওয়ার শক্তিতেই ওসমান হাদির মূল অবদান। ওসমান হাদি কোনো শহীদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্পষ্টতার অনুসন্ধানী এক মানুষ। আর স্পষ্টতা প্রায়ই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, বিশেষত সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদের সময়ে।
হাদি এমন এক পরিসরের প্রতিনিধিত্ব করতেন, যা অত্যন্ত বিরল—তত্ত্ব ও রাজনীতির সংযোগস্থলে অবস্থিত। তিনি রাস্তাঘাটের ভাষায় কথা বলতেন, কিন্তু তার ধারণাগুলো প্রতিধ্বনিত হতো সমালোচনামূলক চিন্তার সবচেয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ ঐতিহ্যে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, কর্তৃত্ববাদ কেবল দেহের দমনেই টিকে থাকে না, তা কল্পনাকেও উপনিবেশে পরিণত করে। সুতরাং তার মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; বরং তা সেই মূল্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যা ক্ষমতার ভেতরে কোনো অর্থ খুঁজে নিতে অস্বীকৃত মানুষদের দিতে হয়।
কেন তার সতর্কবাণী আজও প্রাসঙ্গিক
দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে লক্ষ করা যায়, গণতন্ত্রের কাঠামোগত বিন্যাস এখনো রূপগতভাবে অক্ষুণ্ণ রয়েছে, যদিও যে নৈতিক পরিসরের মধ্যে ভিন্নমত বা গণতন্ত্রপ্রসূত ধারণার বিরোধিতা সহ্য করা যায়, সেই পরিসর দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। গণতন্ত্রের কোনো আকস্মিক বা বিপর্যয়কর পতন আমরা প্রত্যক্ষ করছি না; বরং আমরা দেখছি গণতন্ত্রকেই পদ্ধতিগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সমাজে বর্তমানে যেসব স্মৃতি, ভাষা ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি অনুমোদিত, সেগুলোর প্রতিটি রূপ ও মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রশ্ন উপেক্ষা করা যায় না। ক্রমবর্ধমান বিতর্ক ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক রাষ্ট্র তার নিজস্ব আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রভাববিস্তারের চেষ্টা করছে। এ ধরনের ব্যাপক বিদেশি হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রের ধারণার জন্য গভীরভাবে উদ্বেগজনক। যদি নির্বাচনের ফল জনগণের পছন্দের প্রতিফলন না হয়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক কৌশলের বহিঃপ্রকাশে পরিণত হয়, তবে গণতন্ত্র কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক—বা আরো নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, ভারতের প্রয়োগ করা প্রভাব—রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং এমনকি বর্ণনাগত স্তরেরও অনেক বাইরে বিস্তৃত। এটি আরো স্পষ্ট করে যে, স্থিতিশীলতাকে প্রায়ই জবাবদিহিতার আগে ধারাবাহিকতাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভিন্নমতাবলম্বী কণ্ঠগুলো কেবল পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে না; বরং তাদের রাষ্ট্রের জন্য বিঘ্নসৃষ্টিকারী বা বাধাদানকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এই গণতন্ত্রবোধের পরিপ্রেক্ষিতেই ওসমান হাদির কণ্ঠ আজকের বাস্তবতায় গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। হাদি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, গণতন্ত্রকে কেবল নির্বাচনি সাফল্য বা আইনের শাসনের কঠোর অনুসরণের মাধ্যমে পরিমাপ করা যায় না। গণতন্ত্র প্রাণ পায় শ্রেণিকক্ষে—যেখানে ভয়হীনভাবে মতবিনিময় হয়; এমন মঞ্চে—যেখানে ধারণা অবাধে আদান-প্রদান করা যায়; এমন সংবাদমাধ্যমে—যা নির্দেশ দেয় না, বরং প্রশ্ন তোলে; গান, সাহিত্য ও সেই স্মৃতিতে—যা পুনর্বিবেচনা ও নতুন ব্যাখ্যার জন্য উন্মুক্ত থাকে; এবং সর্বোপরি সেই মৌলিক অধিকারে—যার মাধ্যমে আরোপিত বা আমদানিকৃত সত্যকে প্রশ্ন করা যায়।
তবে হাদির সবচেয়ে ভীতিকর এবং একই সঙ্গে সবচেয়ে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক সতর্কতা ছিল এই কথাটি: ‘আমাদের সমাজের ওপর নেমে আসতে পারে এমন সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো দমন; কিন্তু প্রকাশ্য দমন নয়, বরং সেই দমন, যখন নিরাপত্তাকে নজরদারির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়, নীরবতাকে স্থিতিশীলতার সঙ্গে একাকার করা হয় এবং আনুগত্যকে দেশপ্রেম বলে ধরে নেওয়া হয়।’
বাস্তবিক অর্থেই দমনমূলক শাসনব্যবস্থা হিসেবে কর্তৃত্ববাদকে সবসময় নিজেকে প্রকাশ করতে হয় না, কারণ তার উপস্থিতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি স্তরে ইতোমধ্যেই অনুভূত হয়।
ওসমান হাদির স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে আমরা এটিও মনে করি যে, গণতন্ত্র রক্ষার রাজনীতি—তা বাংলাদেশ হোক কিংবা উপমহাদেশের বৃহত্তর পরিসর—শুধু ভোট, মামলা-মোকদ্দমা বা সাংবিধানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। হাদির অন্তর্দৃষ্টির স্থায়ী প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে তিনি এমন এক অনুভূতিকে উচ্চারণ করেছিলেন, যা অনেক নাগরিক গভীরভাবে অনুভব করলেও খুব কমই উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করেন—তা হলো, ক্ষমতা আর জনগণের কাছ থেকে বৈধতা অর্জনের চেষ্টা করছে না; বরং তা বৈধতা খুঁজছে সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাপনা, আদর্শিক বয়ান এবং আচরণগত মানদণ্ডের মধ্য দিয়ে।
এই কথাটিই ওসমান হাদি অত্যন্ত আবেগ ও দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং তা যথার্থই ছিল, কারণ জনগণ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আবদ্ধ বোধ করে আসছিল। মূল বিষয়টি হলো, উপমহাদেশে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে হাদির নিঃশর্ত ও স্পষ্ট অবস্থান ছিল সেই অনুভূতিরই প্রতিফলন, যা বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গভীরভাবে লালন করে—এই বিশ্বাসে যে সার্বভৌমত্ব কেবল নামমাত্র হতে পারে না; তার থাকতে হবে বাস্তব ও কার্যকর তাৎপর্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ভারত সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বের নামে সেই সার্বভৌমত্ব প্রায়ই অর্থহীন অতিরিক্ততায় পরিণত হচ্ছে।
অতএব, হাদির জনপ্রিয়তা কোনো কৃত্রিম নির্মাণ ছিল না, কিংবা তা সৃষ্টিও করা হয়নি। বরং তা ছিল তার বক্তব্যের স্বাভাবিক ফলাফল—যা জন্ম নিয়েছিল একটি জাতির যৌথ অভিজ্ঞতা থেকে, যে জাতি দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেহ করে আসছিল যে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে তাদের নিজস্ব পছন্দগুলোকে পদ্ধতিগতভাবে এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে একটি বহিরাগত এজেন্ডা পূরণ হয়।
এই কথাগুলোই ওসমান হাদি উচ্চারণ করেছিলেন সেই বিরল নৈতিক পরিসরে দাঁড়িয়ে—যেখানে ভয়হীন ভাষা, নিঃশর্ত কণ্ঠ এবং এমন এক সময়ের দাবি ছিল, যেখানে সতর্কতার চেয়ে সত্যনিষ্ঠা বেশি জরুরি ছিল, আর সুবিধা বা স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে আন্তরিকতা ছিল মুখ্য। এই অনুভূতিকেই তিনি জাতির সামষ্টিক হৃদয়ে স্থাপন করেছিলেন।
ওসমান হাদির জীবন্ত উপস্থিতি
শরিফ ওসমান হাদি কেবল রাজনীতির পাণ্ডুলিপিতে একটি এন্ট্রি হিসেবে নিজের স্থান খুঁজে পাবেন না; বরং তিনি জাতির অন্তঃকেন্দ্রে বিবেকের প্রতীক হয়ে থাকবেন। হাদির মৃত্যু ইতিহাসের ঘণ্টাধ্বনির মতোই জরুরি কর্মের আহ্বান জানিয়ে বেজে ওঠা এক সতর্ক সংকেত; একই সঙ্গে এটিকে এমন এক ঘটনারূপে দেখাও জরুরি, যা জাতির সেই সমষ্টিগত নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পুনরুদ্ধার করে, যা ভয়, ক্লান্তি ও দ্বিধার চাপে ক্রমেই ভেঙে পড়ছিল। হাদির মৃত্যুর পরবর্তী অভিঘাত বাংলাদেশে এমন এক ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি করেছিল, যা এই প্রেক্ষাপটে আগে কখনো ঘটেনি জুলাই ৩৬-এর এই ঐতিহ্য ব্যতীত। রাস্তার মোড়ে, ক্যাম্পাসের আন্দোলনে, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতায় যে কণ্ঠগুলো শোনা গিয়েছিল, সেগুলো ন্যায়সংগত ক্রোধে পরিপূর্ণ ছিল না; বরং সেগুলোর ভেতরে ছিল এক ফিসফিসে স্বীকৃতি, যা বলছিল, এই সংগ্রাম শুধু তাদের নয়; প্রকৃতপক্ষে এই সংগ্রাম নিজেই জাতির এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রেক্ষিতেই। এই প্রেক্ষিতে, সারবত্তায়, হাদির নিজের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে সংগ্রামটি প্রতিফলিত হয়েছিল, তা ছিল প্রতিরোধের সংগ্রাম। আর হাদির মৃত্যুর প্রেক্ষিতে যে সংগ্রামটি উদ্ভূত হলো, তা নিছক প্রতিরোধের সীমা ছাড়িয়ে আরো গভীর, আরো প্রগাঢ় কিছুর দিকে অগ্রসর হওয়া।
কিন্তু এই ঈর্ষণীয় ঐতিহ্যের প্রতীক হলো ঢাকার ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার শরিফ ওসমান হাদির আবেগে সূচিত, যেখানে প্রতিষ্ঠাতার মনে ছিল বাস্তব কাঠামোর চেয়েও অসীম, অপরিমেয় বৃহৎ এক কল্পনা: এমন এক পরিসর, যা মানুষের জন্য আশ্রয় হতে পারে, যেখানে সংস্কৃতি, প্রতিরোধ, কবিতা, সংগীত, আলাপচারিতা ও কল্পনা বিকশিত হতে পারে। ইনকিলাব মঞ্চের চেতনায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠাতা যে স্বাধীন রাজনীতিকে এত গভীরভাবে অনুসরণ ও প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এই কালচারাল সেন্টার শিল্প ও সক্রিয়তার মিলনের আত্মাকে প্রতীকী করে তুলেছিল। ২০২৫ সালের শেষভাগে গুলিবিদ্ধ হওয়া ও পরবর্তী সময়ে সেই মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাটি বাস্তব ঘটনার চেয়েও অসীম ও অপরিমেয় বৃহত্তর কিছুর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সত্যিই, এখানেই নীরবতা উচ্চ স্বরে কথা বলেছিল কালচারাল সেন্টারের হয়ে। প্রজ্বালিত মোমবাতি, ফুলের পাপড়ি, হৃদয়স্পর্শী শোকবার্তা, অন্ধকারে ফিসফিসিয়ে করা প্রতিশ্রুতি—সব মিলিয়ে কালচারাল সেন্টারের বন্ধ দরজাটিকে জাতীয় স্মরণবেদিতে রূপান্তরিত করেছে। এই সামষ্টিক শোকই বাংলাদেশকে নিজেকে পুনরাবিষ্কারের সুযোগ দিয়েছে এবার ওপর থেকে কোনো নির্দেশনা ছাড়াই, নিচ থেকে যেমনটি ঘটেছিল জুলাই ৩৬-এ। ওসমান হাদি হয়তো মারা গেছেন, কিন্তু মানুষটি বরাবরই মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন।
প্রতিরোধের স্মৃতি
একটি ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতিতে স্মৃতিই নিজেই হয়ে ওঠে বিদ্রোহী। এখানে আনুষ্ঠানিক বা স্মারকধর্মী স্মৃতি নয়, বরং সমালোচনামূলক স্মৃতি—অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের সেই অধিকার প্রত্যাখ্যান করা, যার মাধ্যমে তারা নির্ধারণ করতে চায় আমরা কী স্মরণ করব এবং কীভাবে স্মরণ করব। ওসমান হাদিকে স্মরণ করা মানে সেই বিস্মৃতির বিরুদ্ধে অবাধ্য হওয়া, যার বিষয়ে তিনি আমাদের সতর্ক করেছিলেন।
তার অনুপস্থিতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিবেকের ভেতরে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। তবে তার চিন্তা আমাদের এমন এক ভবিষ্যতের দিশা দেখায়, যেখানে সংস্কৃতি মানুষকে শর্তাধীন করে না—বরং মুক্ত করে; আর জাতীয়তাবাদ মর্যাদা রক্ষা করে—চূর্ণ করে না।
ওসমান হাদির সংগ্রাম এখনো অসমাপ্ত। আর এ কারণেই তার সংগ্রাম এত তাৎপর্যপূর্ণ। তার স্মৃতিতে, তার নামের সম্মানে, এটি কেবল শোক পালনের কাজ নয়—এটি হলো এগিয়ে চলার এক কর্ম: নীরবতা চাপিয়ে দেওয়া হলে কথা বলা, পুরস্কৃত আনুগত্যের মুখে চিন্তা করা, সংস্কৃতিকে ভয়ের ক্ষেত্র নয়—স্বাধীনতার ক্ষেত্র হিসেবে রক্ষা করা।
তবে একদিকে এটাও সত্য, ওসমান হাদি মোটেও নীরব হয়ে যাননি। তিনি ইতিহাসে তার উপস্থিতি রেখে গেছেন এমন একটি প্রশ্নের মাধ্যমে, যেটিকে আমরা আর উপেক্ষা করতে পারি না।
ইতালীয় দার্শনিক উমবের্তো একো যেমন সতর্ক করেছিলেন এবং এখানে তিনি নিঃসন্দেহে যথার্থই বলেছিলেন, ‘উর-ফ্যাসিবাদ পার্থক্যের স্বাভাবিক ভয়কে কাজে লাগিয়ে এবং তা আরো উসকে দিয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি করে।’
ওসমান হাদি এই সত্যটি অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন, যখন তা এখনো সর্বজনস্বীকৃত বাস্তবতা হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতপক্ষে, তিনি কেবল একজন সমালোচকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন সত্যের এক অক্লান্ত রক্ষক—এমন এক জগতে, যেখানে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত আত্মাহীন এক খোলসে পরিণত হতে চলেছে। নিজের অবস্থানে অবিচল থেকে তিনি জাতির চেতনায় স্থান করে নিয়েছেন কেবল একজন প্রতিরোধের কণ্ঠ হিসেবে নয়, বরং অবাধ্যতার এক প্রতীক, বুদ্ধিবৃত্তিক সততার এক আলোকবর্তিকা এবং নিরন্তর সাহসের এক আইকন হিসেবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সাভান্না স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিষয়ে অধ্যাপক
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

