Ad T1

খানের আখ্যান

৩১ দফা কি সংস্কারের বাইবেল?

মারুফ কামাল খান
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ১৬

পেছনের কথা বাদ, আমরা ২০০৮ সাল থেকে ধরি। আওয়ামী লীগের ‘দিনবদলের সনদ’, ‘রূপকল্প-২০৪১’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’Ñ এ রকম গালভরা হরেক রকম নামের অঙ্গীকারনামার কথা মনে আছে? কী ছিল না তাতে? ওইসব অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ অনেক আগেই এক মহাউন্নত আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হতো। অভাব-অনটন, বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা থাকত না। সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হতো। মানুষের সামনে অবারিত সুযোগ-সুবিধা ও সৌভাগ্যের দুয়ার হাট করে খুলে যেত। মানুষের সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তার কোনো হানি হতো না। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও বিনোদনের নিশ্চয়তার সঙ্গে নাগরিকদের সব ধরনের স্বাধীনতা এবং অধিকার নিশ্চিত হতো। রাষ্ট্র হতো পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও মানবিক। কিন্তু তা কী হয়েছিল? প্রায় সাড়ে ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ এক নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ইতিহাসে তারা হত্যা, পীড়ন, দুর্নীতি, লুণ্ঠন, দখল, দলীয়করণ, কুশাসনের এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিল। মানুষের পুঞ্জীভূত ঘৃণা পরিণত হয়েছিল ক্ষোভের বারুদে। তারপর এক উত্তাল গণজাগৃতি তাদের ক্ষমতার মসনদকে পেঁজা তুলোর মতো উড়িয়ে দেয়।

আওয়ামী লীগ ওইসব অঙ্গীকার ও কর্মসূচি মূলত দিয়েছে মানুষকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে। দেশ ও জনগণের কল্যাণ তাদের লক্ষ্য ছিল না। তারা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের করায়ত্ত করে রাখতে ওইসব ধাপ্পাবাজির আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে ২০০৮ সাল থেকে এদেশের জনগণ ক্রমাগত রাজনৈতিক প্রতারণার শিকার হয়ে আসছে। ক্ষমতার জন্য রাজনৈতিক দলের এই ধাপ্পাবাজির অভিজ্ঞতা থেকেই মূলত সচেতন মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থার মেরামত বা সংস্কারের চাহিদা তৈরি হতে থাকে। এই লক্ষ্যে সচেতন ছাত্র-তরুণ ও অগ্রসর চিন্তাবিদরা ছোট ছোট গোষ্ঠী ও পাঠচক্র গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি সবার আগে সবচেয়ে বলিষ্ঠভাবে সাড়া দেয়।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ২০১৬ সালের মার্চে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে দেশ পরিচালনার রূপরেখা ঘোষণা করেন। ওই রূপরেখার বিশদ বিবরণ দিয়ে তিনি একই বছরের মে মাসে ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেন। ওই ভিশনের আলোকে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিএনপি ১৯ দফা অঙ্গীকার ঘোষণা করে। রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা হিসেবে বিএনপি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করে। দলটির পক্ষ থেকে সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ওই রূপরেখা উপস্থাপন করেন। এরপর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সহযোদ্ধা বিভিন্ন শক্তি ও ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শক্রমে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা প্রণয়ন করেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সেই ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেন ২০২৩ সালের জুলাই মাসে।

৩১ দফা ঘোষণা উপলক্ষে মির্জা আলমগীর বলেন, বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাদের হাতে নেই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে।

নির্বাচনী ইশতেহার ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিএনপির রেকর্ড আওয়ামী লীগের তুলনায় অনেক বেশি ইতিবাচক হলেও প্রত্যাশিত মানের নয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া অঙ্গীকার বিএনপি শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি বাস্তবায়িত করেছিল। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার এবং এর পাশাপাশি ঘোষিত একটি ভিশন পেপারে যেসব অঙ্গীকার করেছিল এবং নির্বাচিত হওয়ার পর ১০০ দিনের যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল, তার শতকরা ৫০ ভাগও বাস্তবায়িত করতে পারেনি। এসব কারণে বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতির ব্যাপারেও মানুষ খুব দৃঢ়ভাবে আস্থা রাখতে পারে না। তবে বিএনপি এবার তাদের ৩১ দফার ওপর যে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তা প্রমাণের প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এই ৩১ দফা অঙ্গীকারনামার ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষিত করতে নিয়মিত নানামুখী কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে বিএনপি একটি জাতীয় পর্যায়ে অভিযান গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

২০২৩ সালে বিএনপির পক্ষ থেকে এই ৩১ দফা ঘোষণার পরপর আমি একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলাম। আমি লিখেছিলাম :

অনেকটাই নির্বাচনী ইশতেহারের আদলে দেওয়া বিএনপির ৩১ দফা প্রতিশ্রুতি পড়লাম। মন্দ না। তবে এতে রাজনৈতিক উপাদান কিছুটা কম বলে মনে হয়েছে আমার কাছে।

অনেকে দ্বিমত করবেন জেনেও বলি। আরো কিছু ব্যাপারে রাজনৈতিক অঙ্গীকার যুক্ত করলে ভালো হতো বলে আমার ধারণা। যেমন-

১. দেশের রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন।

২. চিরতরে মৃত্যুদণ্ডের বিধান তুলে দেওয়া।

৩. গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংবিধান ভঙ্গ, জাতীয় ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান জালিয়াতি এবং আইনবহির্ভূত পন্থায় রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে জাতিদ্রোহমূলক যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো নিরূপণ ও তদন্তের লক্ষ্যে একটি ট্রুথ কমিশন গঠন।

৪. জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন।

৫. পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত ও বিচার।

৬. মুজিব হত্যা, জেলহত্যা, জিয়া হত্যা ও যুদ্ধাপরাধ মামলা-সংক্রান্ত সব বিতর্ক নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কমিশন গঠন।

৭. রাজনৈতিক প্রভাবে উচ্চ আদালতের দেওয়া ভুল ও অসংগতিপূর্ণ রায়গুলো রদ ও রহিত করতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে ক্ষমতা অর্পণ অথবা কয়েকজন সাবেক চিফ জাস্টিস বা উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র বিচারকদের অন্তর্ভুক্ত করে সর্বোচ্চ আদালতে পৃথক রিভিউ বডি গঠন।

৮. জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় সংসদীয় কমিটি গঠন এবং সেগুলো রদ, রহিত বা সংশোধন-সংক্রান্ত সুপারিশ গ্রহণ।

৯. দ্বিখণ্ডিত ঢাকা সিটি করপোরেশন পুনরেকত্রীকরণ।

১০. আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-সংক্রান্ত জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন গঠন।

১১. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে ব্র‍্যান্ডিং করার লক্ষ্যে ‘রোভিং ন্যাশনাল আইকন অ্যাম্বাসাডর’ পদ সৃষ্টি করে বিশ্ববিশ্রুত উপযুক্ত ব্যক্তিত্বকে সে পদে নিয়োগের কথাও ভাবা যেতে পারে।

১২. শুধুই রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে ঢাকার কাছেই একটি পৃথক পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলা।

ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারকরা আমার এসব প্রস্তাব ভেবে দেখতে পারেন।

আমি এই প্রস্তাবগুলো দিয়েছিলাম হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম চলাকালে। ওই রেজিম উৎখাত হয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতির অনেকটা বদল ঘটেছে এবং ইতোমধ্যে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে আমার কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়নের উদ্যোগ সূচিত হয়েছে। একই কথা বিএনপির ৩১ দফা সম্পর্কেও প্রযোজ্য। পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদী রেজিম-উত্তর বাংলাদেশে ৩১ দফার পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন ছিল বলে আমার মনে হয়। কিন্তু বিএনপি তা না করে ফ্যাসিবাদী বাস্তবতায় প্রণীত ৩১ দফাকেই রাষ্ট্র সংস্কারের বাইবেল বা ম্যাগনাকার্টা বলে মনে করছে।

বিএনপির ৩১ দফা রূপরেখায় রয়েছে : ১. সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, ২. সম্প্রীতিমূলক সমন্বিত রাষ্ট্রসত্তা প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় সমন্বয় কমিশন গঠন, ৩. নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, ৪. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, ৫. প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা নির্ধারণ, ৬. আইন সভায় উচ্চকক্ষের প্রবর্তন, ৭. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, ৮. নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংশোধন, ৯. স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে সব রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন, ১০. জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তন ও সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন, ১১. প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন, ১২. মিডিয়া কমিশন গঠন, ১৩. দুর্নীতি প্রতিরোধে দৃশ্যমান কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও ন্যায়পাল নিয়োগ, ১৪. সর্বস্তরে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, ১৫. অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন, ১৬. ধর্মীয় স্বাধীনতার সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা প্রদান, ১৭. মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা শ্রমের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, ১৮. শিল্প, বিদ্যুৎ, খনিজ ও জ্বালানি খাত আধুনিকায়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ১৯. জাতীয় স্বার্থের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন, ২০. প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা, ২১. বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বশাসিত ও ক্ষমতাবান করা, ২২. শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান, ২৩. আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন, ২৪. নারীর ক্ষমতায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ, ২৫. চাহিদা ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা, ২৬. ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির বাস্তবায়ন, ২৭. কৃষকের উৎপাদন ও বিপণন সুরক্ষা দিয়ে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, ২৮. সড়ক, রেল, নৌপথের আধুনিকায়ন ও বহুমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ২৯. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ এবং নদী শাসন ও খাল খননের উদ্যোগ গ্রহণ করা, ৩০. তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা এবং আণবিক শক্তির উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ৩১. যুগোপযোগী, পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব আবাসন এবং নগরায়ণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

এই ৩১ দফায় রাষ্ট্র মেরামত, সাংবিধানিক সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের অঙ্গীকার অর্ধেকেরও কম। বাকি অঙ্গীকারগুলো অনেকটা নির্বাচনী ইশতেহার ধাঁচের। অধিকাংশ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট পদ্ধতিরও উল্লেখ করা হয়নি। বিএনপির রাষ্ট্র সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোর বেশিরভাগই বাস্তবায়নকল্পে ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কমিশন গঠনের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মনে রাখা দরকার, এখন রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়ণ, ফ্যাসিবাদের পুনরুদ্ধারের পথ রুদ্ধ করা, মুজিববাদ প্রবর্তনকল্পে প্রণীত সংবিধান যুগোপযোগীকরণ এবং রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ইনক্লুসিভনেস প্রতিষ্ঠা সময়ের ও বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের দাবি। একই সঙ্গে রাজনীতি ও দলগুলোর সংস্কার ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার টেকসই হবে না। অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অঙ্গীকার পূরণে খুব বেশি সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে পারেনি বলে রাষ্ট্রীয় অঙ্গন থেকে দুর্নীতি দূর করা, সুশাসন কায়েম, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ, বিকেন্দ্রীকরণ ও ভারসাম্য স্থাপন, শাসকদের জবাবদিহি, সুবিচার, বৈষম্য হ্রাস সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে, মানুষ অধিকার হারিয়েছে, ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে। মানুষকে তার কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় বারবার আন্দোলন করতে হয়েছে, রক্ত ঢালতে হয়েছে। আবার যাতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য সবকিছু কোনো দলের সদিচ্ছার ওপর ছেড়ে না দিয়ে সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য ও অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন এবং জুলাই অভ্যুত্থান সেই সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আনন্দের কথা বিএনপি তার ৩১ দফায় অনড় না থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বসে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সংস্কার প্রশ্নে একটি জাতীয় সমঝোতায় পৌঁছার পথ খুলেছে। এই পথ আমাদের একটি সুখকর গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে বলেই আশা করছি। বিএনপিতে এখন মওদুদ আহমদের মতো কুশলী সংবিধান বিশেষজ্ঞের অভাব প্রকট। তবে অপেক্ষাকৃত নবীন হলেও সালাহউদ্দিন আহমেদের পারফরম্যান্স অনেকটাই মানোত্তীর্ণ। তবে প্রধানমন্ত্রী হতে হলে জাতীয় সংসদে অধিকাংশ সদস্যের আস্থাভাজন সংসদ সদস্য হতে হয়, এই বাস্তবতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী পদকে বিএনপির পক্ষ থেকে মিডিয়ার সামনে ‘অনির্বাচিত’ বলাসহ বেশ কিছু বিচ্যুতি ইতোমধ্যে লক্ষ করা গেছে। ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’-এর মধ্য দিয়ে এসব ত্রুটি কাটিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব আরো পরিশীলিত ও পরিপক্ব হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

ইমেইল : mrfshl@gmail.com

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত