প্রতিভার অবমূল্যায়নে পিছিয়ে পড়ে দেশ

কমডোর জসীম উদ্দীন ভূঁইয়া (অব.)
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ১৩
কমডোর জসীম উদ্দীন ভূঁইয়া (অব.)

একটি জাতির উন্নয়ন নির্ভর করে তার নেতৃত্বের গুণমান ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। আর নেতৃত্ব তখনই সফল হয়, যখন রাষ্ট্র তার সৎ, উদ্যমী এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সঠিকভাবে খুঁজে নিয়ে যথাযথ জায়গায় ব্যবহার করে। কিন্তু যখন এসব মানুষকে অবহেলা করা হয়, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, দুর্নীতির মোড়লদের স্বার্থে অথবা প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে তখন সেটি শুধু একটি নৈতিক ব্যর্থতাই নয়, বরং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একধরনের নীরব অপরাধ। এই অপরাধের শিকার হয় পুরো জাতি, যার খেসারত দিতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।

বিজ্ঞাপন

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এসব মানুষ বারবার উপেক্ষিত হন। অথচ এরা যদি এখন কাজে না আসেন, তাহলে নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের ব্যবহারের সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হবে। কাজেই, বর্তমান সরকার চাইলেই এখন একটি সুবর্ণ সুযোগের জানালা কাজে লাগাতে পারে।

বাংলাদেশে অনেক দেশপ্রেমিক লোক রয়েছেন, যারা অত্যন্ত সক্রিয়, অভিজ্ঞ, প্রশাসনিকভাবে দক্ষ এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে উপযুক্ত বলে প্রমাণিত। কিন্তু তারা রাজনৈতিক দলের দালালি করেন না, তোষামোদ জানেন না, ঘুস দিয়ে পদে উঠতে চান না। তাই সিস্টেম থেকে ক্রমাগত ছিটকে পড়ে যান। অনেকেই বাধ্য হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান, অবসর গ্রহণ করেন অথবা বিদেশে চলে যান, এটাই হলো ব্রেইন অপচয়ের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক।

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই লোকদের শনাক্ত করে রাষ্ট্রের উপকারে ব্যবহার করার এখনই সময়। কারণ এ সরকার কোনো দলীয় দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ নয়। সৎ ও কর্মঠ মানুষদের দিয়ে চাকরি নয়, রাষ্ট্রগঠনের কাজই এখন সময়ের দাবি।

রাষ্ট্র অনেক সময় তাদের ব্যবহার করে না, যারা সত্যিকারের সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক, কারণ এসব গুণাবলি বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূল বিবেচনায় নেই। দলীয় আনুগত্যকে কর্মদক্ষতার চেয়ে বেশি মূল্য দেওয়া হয়, ফলে যারা শুধু দলের প্রতি অনুগত নন, কিন্তু খুবই সক্রিয় ও দক্ষ, তারা জায়গা পান না। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ঘুস এবং তোষামোদের সংস্কৃতি আরো ভয়াবহভাবে মেধাবী ও নীতিবান মানুষদের রাজনীতি এবং প্রশাসন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এর পাশাপাশি, যারা সাহস করে সিস্টেমকে প্রশ্ন তোলে, পরিবর্তনের কথা বলে, দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠী তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে ধরে বা অবজ্ঞার সঙ্গে দূরে সরিয়ে রাখে। এই যে ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন, তার ফলে রাষ্ট্র শুধু একটি ব্যক্তিকে নয়, একটি সম্ভাবনাকে হত্যা করে।

বর্তমান নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে তারা কোনো ভোট রাজনীতি বা জনপ্রিয়তা অর্জনের চাপমুক্ত। কাজেই তারা চাইলে নীতিবান, নির্ভীক এবং অত্যন্ত দক্ষ মানুষের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী বোর্ড, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সেল, দুর্নীতি দমন টাস্কফোর্স, প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি ইত্যাদিতে যুক্ত করতে পারে। এই অন্তর্বর্তী সময়টায় যদি সরকার কিছু সৎ, মেধাবী নাগরিককে দুর্নীতি দমন, নির্বাচন-প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা,

আমলাতান্ত্রিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত করে, তবে সেটি পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য একটি শক্ত ভিত তৈরি করবে। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারের কাজ তখন সহজ হবে।

সৎ, দক্ষ ও উদ্যমী মানুষকে ব্যবহার না করার ফলে যেসব জাতীয় ক্ষতি হয়, তা সরাসরি জাতির উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। যখন তাদের সিস্টেম থেকে দূরে রাখা হয়, তখন তা তরুণ সমাজের কাছে এই বিপজ্জনক বার্তাটি পাঠায়, সততা কোনো কাজে আসে না, ফলে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে। এসব মেধাবী মানুষ হন বিদেশে চলে যান, নয়তো নিরুৎসাহ হয়ে অবসরে গিয়ে চুপ করে থাকেন, ফলে জাতি হারায় মূল্যবান মেধা ও দূরদর্শী নেতৃত্ব। এই শূন্যতায় দুর্নীতিবাজদের বিচরণক্ষেত্র হয় প্রশস্ত, যাদের হাতে পড়ে দেশীয় সম্পদ ও প্রশাসন ব্যবস্থার অপব্যবহার বেড়ে যায়। এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও নেতৃত্বের অনুপ্রেরণা পায় না আর রাজনৈতিকভাবে অস্থির সময়ে রিস্ক ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তির অভাবে রাষ্ট্র গভীর সংকটে পড়ে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, যেখানে সৎ এবং কর্মক্ষম লোকদের সঠিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেখানেই আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটেছে। লি কুয়ান ইউয়ের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর সৎ, মেধাবী মানুষদের দিয়ে প্রশাসন সাজানো হয়েছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা আর স্বচ্ছতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্র পরিচালনা কাঠামো। আজ সিঙ্গাপুর বিশ্বের সেরা প্রশাসন পরিচালিত দেশগুলোর অন্যতম।

গণহত্যার ধ্বংসাবশেষ থেকে রুয়ান্ডাকে গড়ে তুলেছেন পল কাগামে। তিনি সততা, কর্মক্ষমতা এবং সুশাসনের ভিত্তিতে দেশ চালান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন, যার ফলে আফ্রিকায় রুয়ান্ডা আজ উন্নয়নের প্রতীক।

বাংলাদেশ চাইলে এই উদাহরণগুলো অনুসরণ করে এ ধরনের সংস্কারমূলক কাজ শুরু করতে পারে। সৎ, দক্ষ ও যোগ্য অবসরপ্রাপ্ত সচিব, সামরিক কর্মকর্তা, কূটনীতিক, গবেষক ও প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি ‘নাগরিক টাস্কফোর্স’ গঠন বর্তমান সময়ে একটি বাস্তব ও কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা দীর্ঘসময় শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্য থেকে কাজ করেছেন, যা তাদের নেতৃত্ব ও দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা তৈরি করেছে। যদিও কিছু ব্যতিক্রম আছে, তবে সামগ্রিকভাবে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। একইভাবে, সিভিল সার্ভিস, শিক্ষক, প্রকৌশলীসহ অন্য পেশাজীবীদের মধ্যেও অনেক উদ্যমী ও সৎ মানুষ আছেন, যাদের কর্মক্ষমতা অতীতে প্রমাণিত। এদের নিয়ে একটি ‘ট্যালেন্ট পুল’ গঠন করে সংরক্ষণ করলে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশাসনিক বা নীতিনির্ধারণী কাজে যুক্ত করা যাবে।

বাংলাদেশে এখনো অনেক অভিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক ও দক্ষ ব্যক্তি আছেন, যারা অবসরপ্রাপ্ত বা প্রবাসে অবস্থান করছেন। তাদের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে তিন-ছয় মাসমেয়াদি স্বল্পমেয়াদি মিশনে যুক্ত করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোয় লাগানো সম্ভব। যেমন—নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ, দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক রিফর্ম পরিকল্পনা ইত্যাদি। এই উদ্যোগ শুধু বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য নয়, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারগুলোর জন্যও একটি কার্যকর মডেল হতে পারে।

সাধারণ জনগণকেই সুযোগ দিতে হবে যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার মাধ্যমে অংশীদারত্বমূলক রাষ্ট্র নির্মাণে। অনেক সৎ, উদ্ভাবনী এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক আছেন, যারা প্রচারবিমুখ, আত্মপ্রকাশে অনিচ্ছুক বা সিস্টেমের প্রতি আস্থাহীন হয়ে আড়ালে থাকেন। অথচ জাতির সংকটকালে তাদের দক্ষতা ও নেতৃত্ব অত্যন্ত প্রয়োজন। এই বাস্তবতা মোকাবিলায় সরকার একটি ‘জাতীয় নাগরিক মূল্যায়ন ফোরাম’ চালু করতে পারে, যেখানে জনগণ নিজে প্রস্তাব দিতে পারবে—কে সৎ, দেশপ্রেমিক এবং নেতৃত্বের যোগ্য।

সৎ ও মেধাবী লোকের জায়গায় তোষামোদকারী নিযুক্ত হলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়। নিয়োগ ব্যবস্থায় ঘুস, সুপারিশ ও দলীয় বিবেচনা বন্ধ না হলে উন্নয়ন হবে একেবারে অসম্ভব। প্রকৃত উন্নয়ন চাইলে রাষ্ট্রকে ‘যোগ্যতার বিপ্লব’ ঘটাতে হবে, যেখানে পেছনে পড়ে থাকা সৎ, উদ্যমী ও দেশপ্রেমিক নাগরিকরা উঠে আসতে পারবেন রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দিতে।

‘যে জাতি তার সৎ ও যোগ্য নাগরিকদের অবহেলা করে, সে নিজের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে।’ উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন নেতৃত্বে থাকবে স্বপ্নবান, সৎ ও কাজপাগল মানুষ। বর্তমান সরকারের সুযোগ আছে, রাজনীতির বাইরে থেকেও দেশপ্রেমিক ও মেধাবীদের নিয়ে শাসনের নতুন মানদণ্ড গড়ার। মেধা ও সততার প্রতি অবহেলা শুধু ব্যক্তির অপমান নয়, এটি জাতীয় অগ্রগতির পথে বিষফোড়া। রাষ্ট্রের এই নীরব অপরাধের শাস্তি শেষ পর্যন্ত পুরো জাতিকেই ভোগ করতে হয়।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত