হাজার টন কোরবানির মাংস ও আদাহি প্রজেক্ট

এইচ এম নাজমুল হুদা
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ১৬: ৩৬

প্রতি বছর বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশ থেকে ২৫ লাখের ওপর মানুষ মক্কায় হজ ও ওমরা পালন করতে আসেন। হজের অন্যতম প্রধান আনুষঙ্গিক ইবাদত হচ্ছে কোরবানি। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহার দিনে মক্কা নগরী ও মিনায় শুরু হয় আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করার কাজ। এ সময় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এখানে ১০ লক্ষাধিক পশু কোরবানি করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে এত পশুর মাংস কোথায় যায়? আর এত রক্ত ও বর্জ্য কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়?

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, মক্কায় হজের মৌসুমে পশু উৎসর্গ করার ইতিহাস অতি প্রাচীন। এমনকি মক্কার ইসলামপূর্ব যুগেও মানুষের জীবন ও ধর্মাচারের সঙ্গে পশু উৎসর্গের ব্যাপারটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। তবে বর্তমানের তুলনায় এর পরিমাণ ও পরিসর ছিল নিতান্ত নগণ্য। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যতগুলো পশু কোরবানি হতো তার মাংস হজ পালনকারী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণ করেই শেষ করা যেত। এরপর উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনামলে হজ ব্যবস্থাপনায় প্রভূত উন্নতি হলেও পদব্রজে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে আজকের মতো এত মানুষের একসঙ্গে হজ ও কোরবানিতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব ছিল না।

১৮৫০-এর দশকে হাজিরা প্রথম বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে চড়ে হজে যাওয়া শুরু করেন। এই ব্যবস্থা জনপ্রিয় হলে ১৮৮০-এর দশক থেকে প্রতি বছর হজযাত্রীর সংখ্যা কয়েকগুণ করে বাড়তে থাকে। এমনকি উসমানী শাসনামলের শেষদিকে খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ হজযাত্রীদের জন্য ইস্তানবুল থেকে মক্কা পর্যন্ত ট্রেন লাইন স্থাপনের চেষ্টা করেন। ১৯৩৭ সালে প্রথম আকাশপথে হজযাত্রা শুরু হয়। এতে হজযাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যায় আরো একধাপ। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এই সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, জবাই করা পশুর মাংস খাওয়া ও আশপাশের এলাকায় বিতরণের পরেও শেষ হতো না। দেখা যেত পশু জবাইয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার বেশ কয়েকদিন পরও বিপুল পরিমাণ মাংস অবশিষ্ট রয়ে গেছে। এক পর্যায়ে হাজিরা এগুলো এভাবেই ফেলে চলে যেতেন। কয়েকদিন পর স্থানীয় প্রশাসন এগুলো মাটিচাপা দিত। দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাপকভাবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। ফলে সৌদি সরকারকে একটি বিশেষায়িত ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে হয়। এই ব্যবস্থার নাম আদাহি প্রজেক্ট। বর্তমানে হজের সময় এবং বছরজুড়ে সংঘটিত কোরবানির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা এই প্রজেক্টের মাধ্যমেই সম্পাদিত হয়ে থাকে।

১৯৮৩ সালে (১৪০৩ হিজরি) প্রতিষ্ঠিত এই প্রজেক্টের পূর্ণনাম The Kingdom of Saudi Arabia Project for the Utiliæation of Hadi & Adahi। আদাহি প্রজেক্ট বাস্তবায়নের দায়িত্বভার ন্যস্ত রয়েছে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (IsDB) এর ওপর। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি এই দায়িত্বের আঞ্জাম দিয়ে আসছে । প্রজেক্টের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কি না তার দেখভাল করে The Royal Commission for Makka Al Mukarramah and the Holy Sites বা RCMC নামের আরেকটি পর্ষদ। তবে প্রজেক্ট ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি পাবলিক, প্রাইভেট এমনকি দরকার পড়লে তৃতীয় পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানকেও অন্তর্ভুক্ত করে হলেও সেবা নিশ্চিত করে।

আদাহি প্রজেক্টের তরফ থেকে হাজি, ওমরা পালনকারী এবং সাধারণ দর্শনার্থীর সবাইকে সারা বছর ধরে সেবা দেওয়া হয়। ধর্মীয় উদ্দেশ্য পশু উৎসর্গ করার ব্যাপারটিকে সাধারণত পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেন তারা। এগুলো হলো- হাদি, উদিয়া, ফিদইয়া, সাদাকা এবং আকিকা। হাদি হজের সঙ্গে আবশ্যকীয়ভাবে সম্পর্কিত। উদিয়া বা কোরবানি করা হয় হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর স্মরণে। যারা রমজানে যথাযথ কারণবশত রোজা রাখতে পারেননি তারা নির্দিষ্ট হারে পশু উৎসর্গ করে ফিদইয়া আদায় করেন। কেউ কেউ স্রেফ আল্লাহকে খুশি করার জন্য পশু উৎসর্গ করেন। এটি সাদাকার অন্তর্ভুক্ত। আর নবজাতকের জন্মের সঙ্গে আকিকা সম্পৃক্ত।

আদাহি তার এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করে একদম প্রাথমিক পর্যায় তথা পশু কেনার মধ্য দিয়ে। হজের মৌসুমে উৎসর্গ করা পশুর সিংহভাগই (প্রায় ৮৫ ভাগ) হচ্ছে ভেড়া। হজ শুরু হওয়ার আগেই ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক সৌদি আরবের শীর্ষস্থানীয় ভেড়া সরবরাহকারীদের সঙ্গে চুক্তি করে। এই চুক্তির আওতায় তারা প্রায় ১২ লাখ ভেড়া সংগ্রহ করে। একসঙ্গে এত বেশি পশু কেনার কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বেশ ভালো অবস্থান নিশ্চিত করে সবচেয়ে কম দামে পশু কিনতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। যেহেতু এটি কোনো লাভজনক প্রকল্প নয় তাই কম দামে পশু কেনার এই সুবিধাটি সরাসরি হাজিরাই ভোগ করেন। অন্যথায় একই পশু স্থানীয় বাজারে এককভাবে কিনতে গেলে হাজিদের অনেক বেশি টাকা গুনতে হতো। পাশাপাশি, ওজন ও গুণগত মানের দিক থেকেও অতিরিক্ত সুবিধা অর্জন করা সম্ভব হয়। তবে দামে কম হলেও, সব পশু শরিয়া ও স্বাস্থ্যগত মানদণ্ডের শর্তাবলি মেনেই নির্বাচন করা হয়। পশু কেনার সময় ভেটেরিনারি ডাক্তার ও শরিয়া বিশেষজ্ঞ আলেমরা উপস্থিত থাকেন। শুধু তাই নয়, পশু কেনা হয় সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় সংখ্যার চেয়ে কিছু বেশি। যাতে পরবর্তী সময়ে কোনো পশু স্বাস্থ্যগত বা অন্য কোনো কারণে কোরবানির অযোগ্য হয়ে গেলেও হাজিদের সেবা নিশ্চিত করা যায়।

তাই আদাহির সেবা নিলে হাজিরা আশ্বস্ত থাকতে পারেন যে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ সর্বোত্তম উপায়ে ব্যয়িত হচ্ছে। আদাহির স্লোগান- আমাদের হাতে ছেড়ে দিন এবং নিশ্চিন্ত থাকুন (Leave it to us and rest assured)। উল্লেখ্য, ভেড়ার পাশাপাশি আদাহি উটসহ অন্যান্য পশুও কিনে থাকে।

যথাযথ পশু কেনা নিশ্চিত করার পর মক্কা আল-মুকাররামায় অবস্থিত আটটি সমন্বিত কমপ্লেক্সের বিশাল এক স্থাপনায় এগুলোকে নিয়ে আসা হয়। ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে এগুলোকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আটটি কমপ্লেক্সের পাঁচটি সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে হাজিরা নিজে কোরবানি সম্পন্ন করতে পারেন অথবা তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে অন্য কাউকে দিয়েও করাতে পারেন। উন্মুক্ত কমপ্লেক্সগুলোর চারটিতে শুধু ভেড়া জবাই করা যায়। অপরটি গরু, উট ও অন্যান্য পশুর জন্য বরাদ্দ।

অন্যদিকে, বিশেষ তিনটি কমপ্লেক্সে হাজিদের পক্ষে কোরবানির সব ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে থাকে আদাহি। এক্ষেত্রে হাজিরা প্রথমে নির্ধারিত বিক্রয়কেন্দ্র থেকে কুপন কেনেন। বেশ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান থেকে এই কুপন সংগ্রহ করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে আদাহি ওয়েবসাইট আদাহি ডটকম, আদাহি স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন, হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের দ্য ই-ট্র্যাক সিস্টেম, আল-রাজহি ব্যাংক, সৌদি ন্যাশনাল ব্যাংক, আল-বিলাদ ব্যাংক, এহসান প্ল্যাটফরম, সৌদি পোস্ট, জাতীয় অনুদান সংস্থা ইত্যাদি। আদাহির অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের দেওয়া তথ্য মতে তিনটি ধাপে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। প্রথমে পাঁচটি সেবার মধ্য থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবাটি বেছে নিতে হবে। এরপর কুপনের দাম পরিশোধ করতে হবে। এরপর হাজিদের আর কোনো করণীয় নেই। পশু কোরবানি হয়ে গেলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে তার কোরবানি আদায় হয়ে গেছে।

কুপনের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পশুর চিকিৎসা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, শরিয়াহ অনুযায়ী যাচাই, কোরবানির কার্য সম্পাদন, প্রক্রিয়াকরণ, হিমায়িতকরণ, প্যাকেজিং এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবহন ও বিতরণের খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে। চলতি বছরে প্রতিটি আদাহি কুপনের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৭২০ সৌদি রিয়াল।

প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পর ৪০ বছরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় প্রযুক্তিগত দিক থেকেও ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে মেশিনের মাধ্যমে কনভেয়ার পদ্ধতিতে পশু জবাই করা হয়। এর ফলে পশুর কষ্ট যেমন কম হয় তেমনি মানুষসুলভ ভুলের পরিমাণও কমে আসে। আরব নিউজের দেওয়া তথ্য মতে, হজের মূল দিনগুলোতে ৩০ হাজারেরও বেশি কর্মী, টেকনিশিয়ান ও আলেম এখানে নিয়োজিত থাকেন। বাংলাদেশের বহু শ্রমিক এই প্রকল্পের অধীনে কাজ করেন।

পশু জবাই শেষ হয়ে গেলে আসে মাংস প্রক্রিয়াকরণের পালা। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জবাই করা পশুর মাংস কেটে ও পরিষ্কার করে প্যাকেজিং করা হয়। প্যাকেটভর্তি এসব মাংস পরে একটি সুবিশাল হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়। আদাহির দাবি, বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ কয়েকটি হিমাগার সুবিধার মধ্যে এটি একটি। ১০ লাখেরও বেশি পশুর মাংস সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে ১০ লাখ বর্গমিটার জমি জুড়ে বিস্তৃত এই জায়গাটিতে।

আদাহি অপর যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে তা হচ্ছে মাংসের বণ্টন। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ৪০ বছরে ১ কোটির বেশি মানুষের কাছে মাংস পৌঁছে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এশিয়া ও আফ্রিকার ৩৫টির বেশি দেশে নিজ উদ্যোগ এবং অর্থায়নে মাংস বণ্টন করা হয় এই প্রজেক্টের আওতায়। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আজারবাইজান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, জর্ডান, জিবুতি, সুদান, চাদ, নাইজার, মালি, বুর্কিনা ফাসো, মৌরিতানিয়া, ঘানা, লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন, গিনি, গিনি-বিসাউ, গাম্বিয়া, সেনেগাল, তানজানিয়া, কোমোরোস দ্বীপপুঞ্জ, মোজাম্বিক ইত্যাদি। প্রধানত বাস্তুচ্যুত, শরণার্থী এবং দুর্যোগ-পীড়িত জনগোষ্ঠীর মাঝে এই মাংস বিতরণ করা হয়। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই হাজার পরিবার ও ১২ হাজার ব্যক্তির কাছে এই প্রকল্প মাংস পৌঁছে দিয়েছে। স্থানীয়ভাবে বণ্টনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উভয় ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তা নিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।

একই সঙ্গে বড় ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মানবসেবার ক্ষেত্রে আদাহি একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছে। প্রজেক্টটির অবদান শুধু কোরবানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে কোরবানির মাংস পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সুদান, সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, জিবুতিসহ দক্ষিণপূর্ব আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ থেকে পশু আমদানির মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে এই প্রকল্প। প্রকল্পের সফলতা ও বৃহদায়তন নজর কেড়েছে অনেকের। এর বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখা হয়েছে বেশ কতকগুলো থিসিস।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত