Ad T1

একযুগ পর আলোর মুখ দেখছে বে-টার্মিনাল

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২: ১৩

খাতা-কলমে বছরে ২৬ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষম রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের। সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে ছোটখাটো কিছু প্রকল্প নিয়ে বর্তমানে ৩৩ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু চাহিদা রয়েছে আরো বেশি। ঊর্ধ্বমুখী এই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের চাপ সামলাতে কাট্টলির চরে নতুন একটি বন্দর নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু নতুন নামে বন্দর হলে বিশ্ব বাজারে তার পরিচিতি পাওয়াসহ বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা এড়াতে একই এলাকায় বে-টার্মিনাল নামে চট্টগ্রাম বন্দরকে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। বে-টার্মিনাল নাম হলেও এটি মূলত নতুন বন্দর হিসেবেই নির্মাণ করা হবে।

২০১৩ সালে এই বে-টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেই থেকে কাট্টলির চরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিক পাওয়া প্রকল্প’ লেখা বিশালাকৃতির কয়েকটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়। একযুগ ধরে ওই সাইনবোর্ড দেখেই সন্তুষ্টি খুঁজতে হয় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

অথচ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই দাপ্তরিক কাজ শেষ করে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ এ প্রকল্প। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০ এপ্রিল রোববার একনেকে উঠছে বে-টার্মিনাল প্রকল্প। ইতোমধ্যে প্রকল্পটির প্রি-একনেক সম্পন্ন হয়েছে। ১৪ হাজার ৯০৮.৮৩ কোটি টাকার প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩১ সালের জুন মাসের মধ্যে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসাবে দেবে বিশ্বব্যাংক আর বাকি টাকার জোগান দেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। একনেকে অনুমোদনের পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হবে। এরপরই মাঠে গড়াবে ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ।

এদিকে অপার সম্ভাবনাময় এ প্রকল্প একনেকে ওঠার খবরে স্বস্তি এসেছে বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে। তারা জানান, নগরীর হালিশহর উপকূলে আগামী ১০০ বছরের বন্দর হিসেবে বে-টার্মিনাল গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছিল পতিত সরকার। কিন্তু ১২ বছরে শুধু সাইনবোর্ড ছাড়া দৃশ্যমান কিছুই দেখেননি তারা। অথচ এই টার্মিনাল অপারেশনে এলে বন্দরের সক্ষমতায় বিপ্লব ঘটবে। কারণ বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরকে খাতা-কলমে সমুদ্রবন্দর বলা হলেও মূলত এটি নদীবন্দর। কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে এ বন্দরের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে দিনে ছয় ঘণ্টারও কম সময় জাহাজ চলাচল করতে পারে চ্যানেল দিয়ে। সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টিইইউএস কন্টেইনারবাহী জাহাজ আসতে পারে চট্টগ্রাম বন্দরে। বে-টার্মিনাল বাস্তবায়ন হলে আর জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করতে হবে না। এ ছাড়া ১২ মিটার ড্রাফটের চার থেকে পাঁচ হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজ আসা-যাওয়া করতে পারবে অনায়াসে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে বহুগুণ।

বন্দরসংশ্লিষ্টরা জানান, বে-টার্মিনাল প্রকল্পে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে দুটি কন্টেইনার টার্মিনাল এবং একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। এ ছাড়া সমুদ্রের ডুবোচরকে ব্যবহার করে তৈরি করা হবে দেশের সবচেয়ে বড় ব্রেক ওয়াটার ও অ্যাকসেস চ্যানেল, রাস্তা ও রেল সংযোগ সড়ক। ড্রেনেজ সিস্টেমসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য আলাদা আলাদা প্রকল্প করে ব্যয় নির্ধারণ করে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অন্যান্য প্রকল্পের মতো লুটপাটকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই একটি কাজকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলাদা আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বন্দর কর্তৃপক্ষ পুরো বে-টার্মিনালকে একটি প্রকল্পের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সবগুলো কাজকে একটি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে ‘বে-টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ বা বিটিএমআইডিপি নাম দেওয়া হয়েছে। তিনটি টার্মিনালের মধ্যে একটি টার্মিনাল নির্মাণ করবে সিঙ্গাপুরের পিএসএ। অপরটি নির্মাণ করবে দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ড। বাকি মাল্টিপারপাস টার্মিনালটি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হবে।

প্রস্তাবিত ডিপিপিতে বিটিএমআইডিপি প্রকল্পের ব্রেক ওয়াটার নির্মাণে আট হাজার ২৬৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, নেভিগেশন অ্যাকসেস চ্যানেল নির্মাণে এক হাজার ৯৭৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, নেভিগেশনে সহায়ক যন্ত্র স্থাপনে ৫৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং রেল ও সড়ক সংযোগসহ অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৪৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালে জমি বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়, যা চূড়ান্ত হয়ে সিডিএর ছাড়পত্র পেতে সময় লাগে প্রায় দেড় বছর। এরপর ২০১৭ সালে মাত্র ৬৭ একর জমি পাওয়া যায়। যদিও পরবর্তী সময়ে আরো ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এখনো ৩০০ একর জমির অপেক্ষায় রয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। তবে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পাওয়ার পর ভূমির সংকট কেটে যাবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান জানান, ২০৩১ সালের মাঝামাঝি সময়ে শেষ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। আগামী ২০ এপ্রিল একনেকে অনুমোদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি সম্পাদন হবে। এর পরপরই ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল খননের কাজ শুরু হবে। একই সঙ্গে টার্মিনাল নির্মাণের কার্যক্রমও গতি পাবে। ২০২৮ সালের মধ্যে ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণ শেষ হবে। ২০৩১ সালের আগেই জাহাজ ভিড়বে বে-টার্মিনালে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত