রাজধানীর বসুন্ধরা, মোহাম্মদপুর ও কলাবাগান এলাকার আট তরুণকে হঠাৎ রাতের আঁধারে তুলে নিয়েছিল র্যাব। ঘটনার শিকার পাঠাওয়ের তখনকার সফটওয়্যার প্রকৌশলী আরাফাত জানান, বাসা থেকে তুলে নেওয়ার সময় যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্তত একজনকে তিনি চিনতে পেরেছেন।
তিনি হলেন লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম, যিনি বর্তমানে সাবজেলে বন্দি। সম্প্রতি গুমের অভিযোগে শীর্ষ যে ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে, তাদের মধ্যে লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম অন্যতম ।
তুলে নেওয়া সেসব তরুণের কেউ ছিলেন প্রকৌশলী ও ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের শিক্ষক; কেউবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে, হাতকড়া ও কালো জমটুপি পরিয়ে গোপন স্থানে রাখা হয়। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, র্যাব গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে ফজরের নামাজের সময় মসজিদে মসজিদে তাদের ওপর বিশেষ নজরদারি রেখেছিলেন। ফজরের সময় মসজিদে যাওয়া তরুণদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো, আর সেই নজরদারি থেকে শুরু হয়েছিল তরুণদের তুলে নেওয়ার গল্প।
আরাফাত আজম জানিয়েছেন, প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর মসজিদ থেকে বের হওয়া মাত্রই একজন অচেনা দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তি দ্রুত চলে যেতেন। সেই ব্যক্তিও তাকে তুলে নেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন।
বসুন্ধরা এলাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল আরাফাত আজম, আসিফুর রহমান ও জারির তাইসিরকে। আরাফাত ছিলেন পাঠাওয়ের সফটওয়্যার প্রকৌশলী, আসিফ ফ্রিল্যান্স ওয়েব ডেভেলপার এবং জারির তাইসির মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র। কলাবাগান থেকে আটক করা হয় রাদিউজ্জামান হাওলাদার ও রাশেদ আলমকে। এর মধ্যে রাশেদ ছিলেন একটি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের তরুণ শিক্ষক। মোহাম্মদপুর থেকে আটক করা হয়েছিল মীর আফজাল আলী, মাহদি হাসান ও জালাল উদ্দিন শোভনকে। আফজাল একটি ব্যাংকের আইটি বিভাগে চাকরি করতেন। মাহদি ও শোভন ছিলেন শিক্ষার্থী।
জারির তাইসিরের ভীতিকর রাত
জারির তাইসির আমার দেশকে বলেন, ‘২৪ নভেম্বর রাতে হঠাৎ তার বড় ভাই এসে ডাক দেন এই বলেÑ‘ওঠ, তোকে র্যাব খুঁজতেছে।’ ঘরে ঢুকে তিনি দেখেন ১০-১২ জন লোক। একজন তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি জারির তাইসির?’ বাবা-মা এলে তারা নিজেদের র্যাব হিসেবে পরিচয় দেন এবং বাবাকে সোফায় বসে থাকতে বাধ্য করা হয়।
তাকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে ল্যাপটপ, ফোন ও পাঁচটি বই নেওয়া হয়। তারপর দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে কালো হায়েস মাইক্রোবাসে তুলে দেওয়া হয়। বাবা পেছনে অনুসরণ করলে জানানো হয়, তাকে র্যাব-১-এ নেওয়া হচ্ছে। র্যাব-১-এ নিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় জেরার বিষয় ছিল আইসিস, বিশেষ করে ‘আইসিসের লোগো’। ২৫ নভেম্বর ভোরে আরো একজন পরিচিত তরুণকে আনা হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য তরুণদেরও ওই ঘরে আনা হয়।
এরপর ঠাণ্ডা একটি ঘরে তাকে জেরা করা হয়। ফেসবুক পোস্ট, ল্যাপটপের গান-মুভি, ব্যক্তিগত জীবন, মদ ও গাঁজা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। হাতের ছাপ, চোখের স্ক্যান ও ছবি তোলা হয়।
একই এলাকা থেকে আটক হওয়া তরুণ প্রকৌশলী আরাফাত আজম বলেন, ‘২৪ নভেম্বর রাত ১২টা। হঠাৎ ১৫-২০ জন তাদের বাসায় প্রবেশ করেন। পরিবারের সদস্যদের ড্রইং রুমে বসানো হয়। লাইব্রেরি থেকে বই, ল্যাপটপ, হার্ডডিস্ক, মানিব্যাগ বাজেয়াপ্ত করা হয়। তারপর হায়েস মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। র্যাব-১-এ নিয়ে সারা রাত ধরে ফেসবুক ও অন্যান্য ডিভাইস পরীক্ষা করে রাজনৈতিক ও ইসলামি চিন্তাধারার বিষয়ে প্রশ্ন করে তারা। তাদের দাবি অনুযায়ী ইসলামিক আগ্রহ মানেই অপরাধ। দুদিন দুই রাত ঘুমানো বা বিশ্রাম দেওয়া হয়নি।’
জারির ও আরাফাতের মতোই বসুন্ধরা, মোহাম্মদপুর ও কলাবাগান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল আরো ছয় তরুণকে। তাদের সবাইকে ২৬ নভেম্বর একাধিক মাইক্রোবাসে র্যাবের কাওরান বাজার মিডিয়া সেন্টারে নেওয়া হয়। এরপর আবার র্যাব-১-এ ফেরত নেয়। রাতে ভাটারা থানায় হস্তান্তর করা হয়।
কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কারাগার থেকে ২০১৯ সালে সবাই জামিনে মুক্ত হন। এর মধ্যে আসিফ বাদে অন্যরা আট মাস পর আগস্টে জামিনে মুক্ত হন। আসিফ প্রায় এক বছর পর ২০১৯ সালের অক্টোবরে জামিন পান। আসিফের বাবা চট্টগ্রাম থেকে আসিফকে দেখতে এসে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং মুক্তির কয়েক মাসের ভেতরই মারা যান। তরুণদের মধ্যে যারা চাকরি করতেন, তাদের নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে চাকরিচ্যুত হন।
তরুণদের আটকের পেছনে লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম
প্রকৌশলী আরাফাতের বর্ণনা অনুযায়ী, এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি র্যাব-১-এর অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি। সারওয়ারের তত্ত্বাবধানেই তরুণদের ওপর নজরদারি, বাছাই এবং জঙ্গি কার্যক্রমের অভিযোগে টার্গেট করা হয়। তুলে নেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি, যিনি ফজরের নামাজের সময় তরুণদের ওপর নজরদারি করতেন।
২০১৮ সালে হাসিনার সাজানো নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী ইসলামপন্থিদের ব্যাপক ধরপাকড়ের সময় এই তরুণদেরও তুলে নিয়েছিল সারওয়ার ও তার দলবল। পরবর্তীতে ২০২০ সালে সারওয়ার র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান হন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সম্প্রতি সেনাবাহিনীর যে ১৫ শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার অন্যতম হলেন লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম। গত ২২ অক্টোবর তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
মামলায় সব তরুণ খালাস
সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ২০২২ সালের ১৩ মার্চ সব তরুণকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। শুনানিতে এজাহার, জব্দকৃত আলামত, সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং ফরেনসিক প্রতিবেদনসহ পুলিশ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়। বিচারকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, উদ্ধারকৃত বইগুলো সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ নয় এবং কোনো আসামি দোষ স্বীকারোক্তি দেননি। আদালতের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯-এর উল্লিখিত ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একইসঙ্গে তাদের জামিনের দায় থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং ফেরত দেওয়া হয়েছে জব্দকৃত আলামত।
ভুক্তভোগীদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি
এ ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, ফজরের নামাজের সময় মসজিদে তরুণদের নজরদারি করা হয়েছিল। ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় র্যাবের প্রক্রিয়া ছিল পরিকল্পিত, সংগঠিত এবং ভয়াবহ। তারা শুধু জিজ্ঞেস করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতন, ভয়ভীতি, ঘুম ও বিশ্রামবঞ্চিত করেছে। র্যাবের উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা। লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম ছিলেন নজরদারি, অভিযান, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার প্রধান কুশীলব।
মানবাধিকার কর্মীরা যা বলছেন
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ স্কলার মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ‘এ ঘটনা আরো একবার প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা ইসলামবিদ্বেষী আচরণে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেকোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করা মানবাধিকার পরিপন্থী। এই প্রেক্ষাপট জরুরিভিত্তিতে সক্রিয় বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি অনতিবিলম্বে পরিবর্তন করা অপরিহার্য।’
তিনি আরো বলেন, ‘র্যাবসহ দেশের সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা সামগ্রিকভাবে দশকের পর দশক ধরে দায়মুক্তি ভোগ করে আসার প্রেক্ষাপটে তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার করা সরকারের জন্য সহজ হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি অপরাধের ঘটনার ন্যায়বিচার প্রকাশ্য আদালতে স্বচ্ছতার সঙ্গে বাহিনী ও পদমর্যাদা বিবেচনা ব্যতিরেকে দ্রুততম সময়ে নিশ্চিত করতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহরিয়ার মাহমুদ বলেন, ‘এসব ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, এ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র দেশি-বিদেশি ইসলামবিদ্বেষীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। এ দেশের অধিকাংশ জনগণ ইসলামপ্রিয় হলেও এই দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র সেই অধিকাংশ জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে পরিচালিত হতো।’