হোম > জাতীয়

শিশুদের টাইফয়েডের টিকা নিয়ে গবেষকদের উদ্বেগ

আবু সুফিয়ান

দেশজুড়ে চলছে শিশুদের টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি। ১২ অক্টোবর শুরু হয়ে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ শিশুকে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) দেওয়া হয়েছে, যা চলবে আগামী ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সি মোট চার কোটি ৯০ লাখ শিশু এ কর্মসূচির আওতায় আসবে। সরকার বলছে, এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদিত ও নিরাপদ টিকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী টিকার ক্লিনিক্যাল কার্যকারিতা ডেটা ও লং টার্ম কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দেশ-বিদেশের একদল গবেষক।

টিকা শুরু, এরপরই বিতর্ক

গত ১২ অক্টোবর রাজধানীর সিরডাপে আনুষ্ঠানিকভাবে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরীক্ষিত ও অনুমোদিত এ টিকা নিরাপদ এবং কার্যকর। বাংলাদেশে এটি পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া হচ্ছে না। এতে শরিয়তনিষিদ্ধ কোনো উপকরণও নেই।’ টিকাটির সৌদি হালাল সেন্টারের সার্টিফিকেট আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজবে বিভ্রান্ত না হয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য নেওয়ার আহ্বান জানান।

টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই), যার সহায়তায় রয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), গ্যাভি–দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রেস ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে এই টিকা দেওয়া হলেও বড় কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দেশে টাইফয়েড কমাতে এটি অপরিহার্য।’

তবে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এ আশ্বাসের বিপরীতে একদল গবেষক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে।

গবেষকদের দাবি—যথেষ্ট ডেটা ছাড়াই গণটিকায় অন্তর্ভুক্ত

নেদারল্যান্ডসে কর্মরত বিজ্ঞানী ড. রেজাউল করিম (ইমিউনোলজিস্ট হিসেবে বায়োলজিক্স ও টিকা ডেভেলপমেন্ট এবং ইভ্যালুয়েশন বিশেষজ্ঞ), ড. জুবায়ের রহমান (যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ইমিউনোলজিস্ট) ও ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন (সাবেক সিনিয়র ম্যানেজার, আরএনডি; বায়োটেক ডিভিশন, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল) এক যৌথ বিশ্লেষণে বলেছেন, বাংলাদেশের শিশুদের দেওয়া টিকা, টাইফিবেভ-এর শর্ট টার্ম ও লং টার্ম ক্লিনিক্যাল কার্যকারিতা এবং লং টার্ম নিরাপত্তা-সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্য নেই। এটা এক ধরনের টিসিভি টিকা (টাইফয়েড কনজুগেটেড ভ্যাকসিন), যার উৎপাদনকারী কোম্পানি হচ্ছে বায়োলজিক্যাল ই লিমিটেড (ভারতের হায়দরাবাদে অবস্থিত)।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে ভারত বায়োটেক কোম্পানিতে উৎপাদিত একটি টিকার (টাইপবার টিসিভি) ট্রায়াল হয়েছিল, যার কার্যকারিতা ভালো ছিল। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এ টিভিসি টিকার পর্যাপ্ত ডেটা সত্ত্বেও বর্তমানে দেশের পাঁচ কোটি শিশুর অন্য একটি টিসিভি টিকা (টাইফিবেভ) দেওয়া হচ্ছে, যার ক্লিনিক্যাল এফিকেসি ডেটা নেই এবং লং টার্ম সেফটি ডেটা নেই। মনে রাখতে হবে, সব টিসিভি টিকা কিন্তু একরকম নয়।

টাইপবার টিসিভি ও টাইফিবেভের মধ্যে কেরিয়ার প্রোটিন, ভি পলিস্যাকারাইড সোর্স, লিংকার কেমিস্ট্রি, এক্সিপিয়েন্ট ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার একরকম নয়। এছাড়া টাইপবার টিসিভি ও টাইফিবেভের ম্যানুফেকচারিং প্রসেসের মধ্যে সামান্য পার্থক্য থাকলেও এটি টিকার কোয়ালিটির মধ্যে বড় পার্থক্য এনে দেবে। এসব কারণেই জেনেরিকের মতো কপি ভ্যাকসিন তৈরি করা খুবই কঠিন কাজ।

তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, টাইফিবেভের কোনো সরাসরি ক্লিনিক্যাল কার্যকারিতার ডেটা এখনো প্রকাশিত হয়নি। বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত টিকার ক্ষেত্রে (যেমন : ভিভোটিফ বা টাইফিম ভিআই) যথাক্রমে ৪৮ মাস ও ৩৪ মাস পর্যন্ত কার্যকারিতা ফলো-আপ করা হয়।

বায়োলজিক্যাল ই লিমিটেডের ফেজ দুই-তিন ট্রায়ালের সেফটি মাত্র ৪২ দিন ফলো-আপ করা হয়েছে, যা গবেষকদের মতে ‘একটি ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাকসিনের লং টার্ম সেফটি ফলো-আপের জন্য অগ্রহণযোগ্যভাবে কম।’ আগেই বলা হয়েছে, টাইপবার টিসিভি ও টাইফিবেভের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাই টাইফিবেভের ফলো-আপ করা একান্ত জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য (১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নথিপত্র অনুযায়ী টাইফিবেভের জন্য ক্লিনিক্যাল এফিকেসি-সংক্রান্ত কোনো সরাসরি ডেটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু ভারতে ইমিউনোজেনেসিটি ও শর্ট টার্ম সেফটির ক্ষেত্রে এর স্বল্পমেয়াদি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়েছে। টিকাটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও পায়নি।

গবেষকদের মতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রিকোয়ালিফায়েড টাইফয়েড ভ্যাকসিনের তালিকায় বায়োলজিক্যাল ই-লিমিটেডের তৈরি টাইফিবেভ ছাড়া আরো কয়েকটি টিকা রয়েছে। যেমন—ভারত বায়োটেকের টাইপবার টিসিভি, যার কার্যকারিতা ৭৯-৮৫ শতাংস পর্যন্ত প্রমাণিত।

তারা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যখন উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার পর্যাপ্ত তথ্য ছাড়া কোনো ভ্যাকসিন অনুমোদন করা হয় না, তখন বাংলাদেশে কেন এমন টিকা শিশুদের দেওয়া হলো—যার লং টার্ম সেফটি ও কার্যকারিতা অজানা!’

বিশেষজ্ঞদের যুক্তি : অর্থ নয়, বৈজ্ঞানিক সততা গুরুত্বপূর্ণ

ড. জুবায়ের রহমান বলেন, ‘আমরা টিকার বিপক্ষে নই। বরং আমরা টিকাকরণে বিশ্বাসী এবং নিজেরাও টিকা নিই। কিন্তু সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য ছাড়া টিকা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত মানুষকে ভ্যাকসিন বিষয়ে বিভ্রান্ত করতে পারে।’

ড. রেজাউল করিমের ভাষায়, ‘আমাদের উদ্বেগ মূলত কোনো টিকা-বিরোধিতা নয়। এটি জনস্বাস্থ্যের প্রতি বৈজ্ঞানিক দায়বদ্ধতার অংশ।’ তিনি মনে করেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এমন পর্যায়ে আছে যে, ভালো মানের টিকা কেনা সম্ভব। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক দুর্বলতার অজুহাতে শিশুদের জন্য নিম্নমানের টিকা নেওয়া অগ্রহণযোগ্য।’

তারা যুক্তি দেন—বাংলাদেশ যদি উন্নত দেশের মতো শক্তিশালী ফার্মাকোভিজিল্যান্স ব্যবস্থা না রাখে, তবে স্বল্পমেয়াদি ট্রায়ালের ভ্যাকসিনের ব্যাপক প্রয়োগে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করা উচিত।

ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে রোল আউট করা টাইফয়েড টিকার গুণগত মান, কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন অপরিহার্য।’ তিনি উল্লেখ করেন, কোভিডের সময় গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্স ও চায়নার সিনোভ্যাক টিকার গুণগত মান বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে দেশে সচেতনতা সৃষ্টি করেছিল, যা গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়।

তারা মনে করেন, ‘যদি টাইফিবেভ টিকাটি ভবিষ্যতে শিশুদের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে এটি শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে চরম অনৈতিকতা ও দায়িত্বহীনতার নজির স্থাপন করবে; বিশেষত যদি টিকার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে।

গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে এখন কোভিডের মতো টাইফয়েড মহামারি নিয়ে এমন কোনো ইমার্জেন্সি অবস্থা তৈরি হয়নি যে, পাঁচ কোটি শিশুকে এমন একটি টিকা দেওয়া হচ্ছে—যার গুণগত মান, লং টার্ম কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই।

তাদের ভাষায়, ‘পাবলিকলি ডকুমেন্টেড সায়েন্টিফিক তথ্য বিশ্লেষণে আমাদের অভিমত, শর্ট টার্ম ও লং-টার্ম ক্লিনিক্যাল কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ডেটা ছাড়া বায়োলজিক্যাল ই লিমিটেডের টাইফাইবেভ ভ্যাকসিন গণহারে প্রয়োগ করা জনস্বাস্থ্যের নৈতিকতার পরিপন্থী।’

সরকারের অবস্থান অপরিবর্তিত

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ইপিআই কর্মকর্তারা এসব সমালোচনায় গুরুত্ব দিতে নারাজ। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) উপপরিচালক শাহরিয়ার সাজ্জাদ গত ২১ অক্টোবর সিরডাপে এক অগ্রগতি পর্যালোচনায় বলেন, ‘দেশজুড়ে টিকাদান খুব ভালোভাবে এগোচ্ছে। লক্ষ্য অর্জনে আমরা আশাবাদী।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফরও বলেন, ‘কিছু লোক সামাজিকমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন ‘নিখোঁজ’

রেলওয়ে প্রকল্পের লোহা চুরির মহোৎসব

বাংলাদেশে ইসরাইলি শিপিং নেটওয়ার্কের গোপন উপস্থিতি

কাদের আনিসুল জিয়াউল আজমের ব্যবসা বহাল

অবশেষে কাঠগড়ায় ১৫ আর্মি অফিসার

পলাতক আওয়ামীদের গাড়ি যাচ্ছে আমলাদের সেবায়

এমপি নেই, তবু ৪০ ভাগ ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব

ঐক্য চায় তৃণমূল, ভিন্ন হিসাব নেতাদের

খুনের রাজ্য তৈরি করেন আসাদুজ্জামান নূর

রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ডিসিদেরই রাখছে ইসি