হোম > আমার দেশ স্পেশাল

ন্যানো প্রযুক্তির যুগে প্রবেশের আগেই থেমে গেল বাংলাদেশ

আবু সুফিয়ান

অতি ক্ষুদ্র কণার বিজ্ঞান বা ন্যানো প্রযুক্তি খাতে গবেষণা ও শিল্পের যুগান্তকারী অধ্যায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ন্যানো প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্পটি সরকারি নির্দেশে অসমাপ্ত রেখেই বন্ধ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চলতি বছরের ১৫ জুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত নোটিসে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।

প্রকল্পটি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন ছিল। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বিস্তারিত পর্যালোচনা ছাড়াই সুপারিশ করেছেÑসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও অনুমোদনের সংশোধন নির্দেশিকা অনুসারে প্রকল্পের অসমাপ্ত অংশগুলো সমাপ্ত ঘোষণা করা যেতে পারে। আইএমইডি জানিয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব ও অভিপ্রায় অনুযায়ী ইনস্টিটিউট অব ন্যানো টেকনোলজি স্থাপন প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করার জন্য এ সুপারিশ প্রেরণ করা হলো।

আইএমইডির সুপারিশের আলোকে মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে ডিপিপি পুনর্গঠন করে আরডিপিপি চলতি বছরের ২২ জুনের মধ্যে খসড়া জমা দেওয়ার জন্য। উপসচিব ড. ফয়সাল আবেদীন খান জানিয়েছেন, প্রকল্পের অসমাপ্ত অংশগুলো প্রাসঙ্গিকভাবে সমাপ্ত করার কাজ তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হবে।

প্রকল্পের প্রারম্ভিক লক্ষ্য ও প্রয়োজনীয়তা

ন্যানো টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ প্রথম (একনেক) অনুমোদন লাভ করে ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল। প্রশাসনিক অনুমোদন হয় ২০২৩ সালের ১২ জুন। প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশের ন্যানো প্রযুক্তি গবেষণার জন্য একটি কেন্দ্রীভূত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সুবিধা স্থাপন করে দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং ন্যানো ম্যাটেরিয়াল উৎপাদনের মাধ্যমে শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সরবরাহের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ন্যানো টেকনোলজি গবেষণার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন করছে। ন্যানো টেকনোলজি মার্কেটের আকার বর্তমানে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ন্যানো মেডিসিন, ন্যানো টেক্সটাইল, ন্যানো কৃষি ও ন্যানো সেন্সরসহ অন্যান্য ন্যানোভিত্তিক শিল্পের বাজার মিলিয়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ এই বাজারের মাত্র ১ শতাংশও ধরতে পারলে তা জাতীয় জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ সমমূল্য হতে পারে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন দীর্ঘদিন ধরে সীমিত পরিসরে ন্যানো টেকনোলজি গবেষণা করছে। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল তিন শতাধিক প্রবন্ধে প্রকাশ হয়েছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার ও কর্মশালায় উপস্থাপিত হয়েছে। ২০১৭ সালে কমিশন প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ ন্যানো টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। ফিজিবিলিটি স্টাডি আশানুরূপ হওয়ায় প্রকল্প অনুমোদিত হয়।

স্থাপত্য ও যন্ত্রপাতি

প্রকল্পের অধীন দশতলা ফাউন্ডেশনবিশিষ্ট ছয়তলা বিশেষায়িত ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। স্থাপত্য নকশা, গবেষণাগার ডিজাইন ও প্রাক্কলন তৈরি করতে ২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল একটি স্থাপত্য ও প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও স্টেকহোল্ডারের মতামত সংগ্রহের মাধ্যমে চূড়ান্ত নকশা তৈরি করা হয়। বর্তমানে ভবন নির্মাণের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন এবং প্রধান যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনায় মোট ৫৮টি যন্ত্রপাতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে কিছু যন্ত্র বর্তমানে পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের অন্যান্য প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে। কিছু নতুন এবং কিছু অচল অবস্থায় থাকায় নতুন করে সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

কমিটি ও সিদ্ধান্ত

২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত কমিটি স্থাপিত গবেষণাগারের সঙ্গে সমজাতীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য দ্বৈততা যাচাই করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির প্রতিনিধিরা নিশ্চিত করেছেন, দেশে বিদ্যমান গবেষণাগারের সঙ্গে কোনো দ্বৈততা নেই এবং প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়েছে।

২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের আলফা হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় কমিটি প্রকল্পের কার্যক্রম, উদ্দেশ্য ও সম্ভাব্য দ্বৈততা পর্যালোচনা করে। সভার আহ্বায়ক ছিলেন ড. শামশাদ বেগম কোরাইশী। সদস্য সচিব ছিলেন ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান।

ওই সভায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাসিনা আখতার বলেন, ন্যানো টেক্সটাইল গবেষণার আধুনিক সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের টেক্সটাইল খাতে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার কম, তাই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণাগার বস্ত্রশিল্পের প্রতিযোগিতাশীলতা বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ড. ফরিদুল আলম উল্লেখ করেন, কৃষিতে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও আধুনিক সুবিধা না থাকায় মাঠে সুফল প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হলে গবেষণার ফলাফল কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, বুয়েটে কিছু গবেষণা চলছে, তবে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে বিদেশে নমুনা পাঠাতে হয়। প্রস্তাবিত ইনস্টিটিউট ন্যানো ম্যাটেরিয়াল, ন্যানো এনার্জি, বায়োমেডিক্যালসহ ন্যানো টেকনোলজির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব হবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির ড. আবু হাশেম মন্তব্য করেন, ন্যানো টেকনোলজিভিত্তিক বায়োটেকনোলজি গবেষণার জন্য ইনস্টিটিউট গুরুত্বপূর্ণ। এতে ন্যানো কোটেড এনজাইম, বায়ো-সেন্সর, ড্রাগ ডেলিভারি ইত্যাদির গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যানো এনার্জি ও অন্যান্য মৌলিক গবেষণা চলছে কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হলে গবেষক ও শিক্ষার্থীরা সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে এবং সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষণার মান উন্নত হবে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক ড. এম মঈনুল ইসলাম এবং জীববিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ফারিয়া নাসরিন উল্লেখ করেন, প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই ও ফিজিবিলিটি রিপোর্টের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছে। ন্যানো টেকনোলজি বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

সভায় কমিটির সার্বিক মন্তব্য ছিলÑদেশে বিভিন্ন গবেষণাগারে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার সীমিত হলেও পর্যাপ্ত আধুনিক সুবিধা নেই। প্রস্তাবিত ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হলে গবেষণা, পরীক্ষণ ও সেবাদান কার্যক্রম এক স্থানে সম্ভব হবে এবং বিদ্যমান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্বৈততা থাকবে না।

সম্ভাবনা ও প্রাসঙ্গিকতা

ন্যানো টেকনোলজি প্রযুক্তি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বাস্তবায়ন হলে কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, পরিবেশ এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাত, কৃষি উৎপাদন ও ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ন্যানো প্রযুক্তি প্রয়োগ দ্রুত অর্থনৈতিক সুবিধা আনতে পারবে।

ড. মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ন্যানো টেকনোলজিভিত্তিক গবেষণার জন্য আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ইনস্টিটিউট স্থাপন দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের জন্য মাইলফলক হবে।

বিশ্বজুড়ে ন্যানো প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে প্রায় এক কোটি মানুষ কর্মরত এবং বৈশ্বিক বাজারমূল্য ইতোমধ্যে এক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ যদি এখনই নিজস্ব ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে আগামী দশকে হাজারো দক্ষ গবেষক ও প্রকৌশলী তৈরি করা সম্ভব হবে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা

ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যে ন্যানো প্রযুক্তিকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে এনেছে। ভারত ২০০৭ সালে ‘ন্যানো মিশন’ চালু করে ন্যানো গবেষণাকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার দেয়। কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও শিল্পÑসব ক্ষেত্রেই ন্যানো উদ্ভাবনের প্রভাব স্পষ্ট। পাকিস্তান ২০২৩ সালে ন্যাশনাল সেন্টার ফর ন্যানো সায়েন্স অ্যান্ড ন্যানো টেকনোলজি (এনসিএনএন) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। প্রতিরক্ষা ও টেক্সটাইল খাতে ন্যানো উপাদান ব্যবহার শুরু হয়। শ্রীলঙ্কায় ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কা ইনস্টিটিউট অব ন্যানো টেকনোলজি (স্লিনটেক) প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই তিন দেশেই ন্যানো টেকনোলজি গবেষণা ও শিল্পে নতুন সুযোগ তৈরি করছে, যেখানে বাংলাদেশ এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে।

কেন প্রকল্পটি বন্ধ করা হচ্ছেÑএমন প্রশ্নের জবাবে পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নজরুল ইসলাম বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটির ইতিবাচক মতামত থাকা সত্ত্বেও এত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি কেন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, তা জানি না।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ যদি এখনই এগোতে না পারে, তবে ভবিষ্যতের শিল্প ও প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় দেশ কেবল ব্যবহারকারীর ভূমিকা রাখবে, উদ্ভাবকের নয়। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ন্যানো প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট স্থাপন ছাড়া দেশের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা ধ্বংসের মুখে পড়বে।

জিয়া হত্যায় এরশাদকেই সন্দেহ চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসির

২৩৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা

জটিলতার মেঘ কেটে যাচ্ছে

আবদুচ ছালামের নেওয়া প্রকল্প এখন সিডিএর গলার কাঁটা

ডেঙ্গুর আচরণে নাটকীয় পরিবর্তন, বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যু

সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাড়ল পেঁয়াজের দাম

হাসিনার কৃপায় উত্থান সাম্রাজ্য ফেলে পলায়ন

বাংলাদেশি রোগীদের নতুন চিকিৎসা গন্তব্য তুরস্ক

রূপনগর লেক প্রায় ‘উধাও’ গভীর ঘুমে কর্তৃপক্ষ

ফুলের সঙ্গে সারা বেলা, তবু জীবন নয় ওদের ফুলের মতো