ভারতে এসআইআর আতঙ্ক
ভোটার তালিকার স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (এসআইআর) বা বিশেষভাবে হালনাগাদ করছে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের ১২টি রাজ্য প্রশাসন। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ফর্ম বিলির কাজ। বিষয়টি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠছে, আছে ধোঁয়াশাও। বিশেষ করে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে বাঙালিপাড়ায়। এরই মধ্যে নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে বেশ কয়েকজনের আত্মহত্যার তথ্যও পাওয়া গেছে।
এই আবহে গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে নানা বিভ্রান্তিমূলক খবর। যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই বলেও অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, এসআইআর চালু হতেই ভারতে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকরা পালাতে শুরু করেছে। কোনো কোনো খবরে নিউটাউন, সল্টলেকের কিছু বস্তি এলাকাকে ‘মিনি বাংলাদেশ’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এর ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুজবতো আছেই।
ছড়িয়ে পড়া খবরগুলোর ঘটনার সত্যাসত্য জানতে নিউটাউন ইকোপার্কের ৬ নম্বর গেটসংলগ্ন বস্তি এলাকা, সিসি-২-এর পেছনে এবং মহিষবাথানসংলগ্ন ঝুপড়িতে গিয়ে মানুষের ক্ষোভের আঁচ পাওয়া গেছে। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি, কিছু তালাবদ্ধ বাড়ির ছবি দেখিয়ে বাংলাদেশিদের বাড়ি বলে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো যে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশিদের বাড়ি এর কী প্রমাণ আছে?
ইকোপার্কের ৬ নম্বর গেটের রামমন্দিরসংলগ্ন বস্তির বিথি দাস নামে এক পরিচারিকা বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকায় আছি। আমার স্বামীর চায়ের দোকান আছে। আমি লোকের বাড়িতে কাজ করি। অনেক সময় বাড়িতে তালা লাগানো থাকে। আর এই তালাবদ্ধ ঘরের ছবি দেখিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’
একই এলাকার রেবা মণ্ডল পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, এখানে বাংলাদেশিরা থাকে তার কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে? তাদের দাবি, তারা নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে এসে সেখানে বস্তিতে বসবাস করছেন। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে আবর্জনা, প্লাস্টিক সংগ্রহ এবং বিক্রি করেই তারা সংসার চালান। অন্য জেলার ভোটার হলেও তারা ভারতেরই নাগরিক। নাগরিকত্ব প্রমাণ করার নথিও তাদের কাছে আছে। অনেকে ইতোমধ্যে সেসব নথি আনতে গ্রামে চলে গেছেন। কিন্তু রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, ‘বাংলাদেশি’ বলেই তারা এলাকা ছেড়েছেন।
নিউটাউন অ্যাক্সিস মলসংলগ্ন ঝুপড়ির এক বৃদ্ধ বাসিন্দা বলেন, সব রকম নথি থাকা সত্ত্বেও তাদের নামে টিভিতে মিথ্যা খবর প্রচার করা হচ্ছে।
নিউটাউন লাগোয়া বিধাননগর পৌরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের আটঘড়া পূর্বপাড়ার বাসিন্দা সোরিফা বিবি, রোজিনা বিবিদের অভিযোগ, এসআইআর শুরু থেকেই তাদের ঘর দেখিয়ে ‘বাংলাদেশিদের ঘর’ বলে প্রচার চলছে। এমনকি, সংবাদমাধ্যমে তাদের ঘরের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে। যার জেরে তারা পুলিশি হয়রানির সম্মুখীন হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুল হোসেনের দাবি, গত এক দশকে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গরিব মানুষরা এখানকার কয়েকটি ব্যক্তি-মালিকানাধীন জমিতে বসতি গড়েছেন। বিহার থেকেও অনেকে এসেছেন। তারা এখানকার ভোটার নন। বাংলাদেশ থেকে কেউ এসে বসবাস করলে সেটা প্রশাসন দেখবে।
একদিকে যেমন বাংলাদেশি তকমা দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে এসআইআর প্রক্রিয়ার কারণে রুটি-রুজিতেও টান পড়ছে। ইকোপার্কের ৬ নম্বর গেটসংলগ্ন এক নারী ছোট্ট ঠেলা গাড়িতে চা-বিস্কুট-মুড়ি-ঘুগনি বিক্রি করেন। তিনি বলেন, পূজার পর থেকেই ইকোপার্কে ঘুরতে আসেন অনেক মানুষ। গত বছর এই নভেম্বরে দিনে ২ হাজার টাকারও বেশি বিক্রিবাট্টা হয়েছিল, কিন্তু এ বছর দিনে ৫০০ টাকার বেশি বিক্রি করাই কষ্টকর।
কারণ হিসেবে তিনি জানান, এসআইআরের জন্যই আতঙ্কে মানুষ আসছে না। তার পাশেই বসা আরেক স্থানীয় নারীও বলে ওঠেন, ‘আমরা সবাই আতঙ্কে আছি। আপনাদের মতো শিক্ষিত তো নই, বাবা। বুঝতে পারছি না কী হবে?’ সব মিলিয়ে এসআইআর নিয়ে নানা ধোঁয়াশা, আর বিভ্রান্তিতে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ আতঙ্কিত।