হোম > আমার দেশ স্পেশাল

চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে প্রবাসী মাফিয়া

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড এখন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে প্রবাসী সন্ত্রাসীদের হাতে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব মাফিয়া গোষ্ঠী নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নগর ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত আটটি গ্রুপ ইতোমধ্যে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বালুমহাল দখল ও পাহাড়ের মাটি ব্যবসার মতো ‘বিনা পুঁজির’ লাভজনক খাতে নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা নেমেছে সংঘর্ষ ও খুনোখুনিতে।

‘জুলাই বিপ্লব’-এর পর প্রশাসনিক শৈথিল্যের সুযোগ নিয়ে তাদের তৎপরতা বেড়েছে আরো। প্রতিটি গ্রুপে ৫০ থেকে ৮০ জন পর্যন্ত অস্ত্রধারী সদস্য রয়েছে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক আশ্রয় নিশ্চিত করাই এখন তাদের মূল লক্ষ্য। এজন্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বার্তা পাঠানো হচ্ছে। নির্বাচনে তাদের পক্ষে মাঠ দখল করা, প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখার নানা প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীসহ অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদাও আদায় করতে শুরু করেছে এসব প্রবাসী মাফিয়া।

সূত্র জানিয়েছে, প্রবাসী সন্ত্রাসীদের স্থানীয় সহযোগীরা রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি ও চন্দনাইশের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলকে নিরাপদ ডেরা হিসেবে ব্যবহার করছে। শহর এলাকায় তাদের ঘাঁটি সীতাকুণ্ডের ছলিমপুরের জঙ্গল এলাকায়। বিদেশ থেকে নির্দেশ এলে পাহাড় থেকে নেমে তারা প্রকাশ্যে হামলা চালায় এবং মুহূর্তেই গা ঢাকা দেয়। এ কারণে নগরের অলিগলি সংঘর্ষে কেঁপে উঠলেও বেশিরভাগ অপরাধী থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের পুরোনো ছয় শীর্ষ নাম—বড় সাজ্জাদ, হাবিব খান, নুরুন্নবী ম্যাক্সন, মেজর ইকবাল, ফজল হক ও বিধান বড়ুয়া। কেউ লন্ডন, কেউ দুবাই, কেউ ইতালি বা ভারতে অবস্থান করছে বলে জানায় গোয়েন্দারা। বিদেশে থাকলেও এনক্রিপটেড মোবাইল অ্যাপ ও হুন্ডি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা এখনো চট্টগ্রামের অপরাধ জগত পরিচালনা করছে। সম্প্রতি বিএনপি প্রার্থীর গণসংযোগে অংশ নিয়ে গুলিতে নিহত সারোয়ার হোসেন বাবলাও ছিল একটি গ্রুপের দলনেতা। তবে আন্ডারগ্রাউন্ডের পরিবর্তে সে সরাসরি রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করছিল।

গুজব আছে, নুরুন্নবী ম্যাক্সন ভারতে নিহত হয়েছে, তবে নিশ্চিত তথ্য নেই। তার নামে এখনো বায়েজিদ, অক্সিজেন, চান্দগাঁও ও বাকলিয়া এলাকায় সক্রিয় একটি গ্রুপ কাজ করছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানা গেছে, বড় সাজ্জাদ বর্তমানে দুবাইয়ে, হাবিব খান ইতালিতে, মেজর ইকবাল দুবাইয়ে ও ফজল হক সৌদি আরবে রয়েছে। বিধান বড়ুয়া দেশে ফিরলেও এখন আত্মগোপনে। আর মেজর ইকবালও সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন বলে জানা গেছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোর রাতে রাউজা ন থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত এক বছরে চট্টগ্রামে সংঘটিত ৪০টি খুনের মধ্যে অন্তত ১৫টিতে বড় সাজ্জাদের নাম জড়িত। জেলে থেকেও ‘ছোট সাজ্জাদ’ বা ‘বুড়ির নাতি’র মাধ্যমে সে অক্সিজেন, পাঁচলাইশ, বায়েজিদ ও বাকলিয়া এলাকার চাঁদাবাজি ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। ছোট সাজ্জাদের তিন ভরসার শুটার রায়হান, ইমন ও বাইস্যা। পাহাড়ি এলাকায় লুকিয়ে থেকে প্রয়োজনমতো শহরে নেমে হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটায়। শুধু সাজ্জাদ নয়, অন্য প্রবাসী গডফাদারদের কাছ থেকেও তারা ভাড়ায় কাজ নেয়।

নির্বাচন ঘিরে নতুন গতি

নির্বাচন ঘিরে এই নেটওয়ার্কগুলো আবারও সংগঠিত হচ্ছে। পতেঙ্গা, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, হালিশহর ও পাহাড়তলী এলাকাজুড়ে কিছু গ্রুপ রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে ‘শক্তি প্রদর্শন’ শুরু করেছে। নির্বাচনের সময় ‘চাহিদা’ বাড়বে বুঝে তারা এখন থেকেই নিজেদের কদর বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এর ফলেই এলাকায় বাড়ছে সংঘর্ষ ও খুনোখুনি।

দুর্গম পাহাড়ে নতুন ডেরা

সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি নজরদারি ও সিসিটিভি ব্যবস্থার কারণে অনেক সন্ত্রাসী শহর ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছে রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালী, লোহাগাড়া ও মীরসরাইয়ের অরণ্যঘেরা স্থানে। স্থানীয়রা জানান, রাতে মুখোশধারী লোকজন মোটরবাইক বা মাইক্রোবাসে নিয়মিত পাহাড়ে যাতায়াত করছে এবং সেখানকার লোকজনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সহযোগিতা আদায় করছে।

চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু জানিয়েছেন, পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সমতলের অপরাধীদের যোগসূত্র গড়ে উঠেছে। এ কারণেই পাহাড়কে ডেরা হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে তারা। এসব এলাকা দুর্গম হওয়ায় অভিযান পরিচালনা কঠিন—অনেক সময় ২-৩ ঘণ্টা হেঁটে যেতে হয়, ফলে ইনফরমারদের মাধ্যমে আগেই খবর পেয়ে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এ চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণে প্রবাসী মাফিয়া কারণেই অভিযান চালিয়েও সুফল আসছে না।

চাঁদাবাজি ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ

চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম আয়ের উৎস এখনো চাঁদাবাজি। বন্দর, ট্রাকস্ট্যান্ড, বাজার, নির্মাণ প্রকল্প ও রিয়েল এস্টেট খাতে মাসোহারা আদায় চলছে পুরোদমে। বিদেশে বসেই ফোনে চাঁদা দাবি করে মাফিয়ারা, স্থানীয় সহযোগীরা তা তুলে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় প্রবাসে। এভাবে বিদেশে থাকা নেতারা দেশে না থেকেও মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছে।

এছাড়া সরকারি টেন্ডারেও রয়েছে তাদের প্রভাব। নিজেদের লোকের মাধ্যমে দর নিয়ন্ত্রণ ও কমিশন আদায় এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। অনেক ঠিকাদার নিরাপত্তার কারণে বাধ্য হয়েই তাদের কমিশন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

রাজনীতির সঙ্গে আঁতাত

চট্টগ্রামের অপরাধ জগতের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নতুন নয়। দুই প্রধান দলেরই কিছু নেতার সঙ্গে সন্ত্রাসীদের যোগাযোগের অভিযোগ বহুদিনের। নির্বাচনের সময় তাদের ব্যবহার করা হয় ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয় দেখানো ও আধিপত্য কায়েমে। সম্প্রতি বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগে শীর্ষ সন্ত্রাসী সারোয়ার হোসেন বাবলার নিহত হওয়ার ঘটনায় আবারও বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। নিহত বাবলার পরিবারের দাবি, ছোট সাজ্জাদের নির্দেশেই এই হামলা চালানো হয়।

ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাবলা ও সাজ্জাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তোলা ছবি ভাইরাল হয়। তাতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত এমনকি এনসিপি নেতাদের সঙ্গেও তাদের দহরম-মহরমের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রযুক্তিনির্ভর আন্ডারওয়ার্ল্ড

আগে যেসব সন্ত্রাসী খোলা জায়গায় বৈঠক করত, এখন তারা অনলাইনে ‘ভার্চুয়াল মিটিং’ করছে। এনক্রিপটেড অ্যাপ, সিগন্যাল, টেলিগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপের সিক্রেট চ্যাটের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। বিদেশ থেকে নির্দেশ আসে এনক্রিপটেড বার্তায়। কোডনেম ব্যবহারের কারণে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা শুধু যোগাযোগই নয়, অস্ত্র কেনা ও লেনদেনের পরিকল্পনাও করছে বলে জানিয়েছে সাইবার ইউনিট।

বিশ্লেষকদের মত

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির বলেন, চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড এখন শুধু অপরাধ নয়, এটি রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রবাসী নেটওয়ার্কের এক জটিল মিশ্রণ। বিদেশে বসে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। এ প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদদের সখ্যের অভিযোগ সামনে এসেছে। বিষয়টি সত্য হলে কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করে লাভ নেই।

প্রশাসনের অবস্থান

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফিজুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের প্রায় সব হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্ঘাটিত হয়েছে এবং অনেক আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছে। কিন্তু বিচারের দৃষ্টান্ত না হওয়ায় অপরাধের প্রবণতা কমছে না। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে পুলিশ ও র‌্যাবের জনবল সংকট। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক নীতিমালার কারণে অভিযানে ভারী অস্ত্র ব্যবহার কমে গেছে, ফলে দুর্গম এলাকায় অভিযান চালাতে সদস্যরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, এতে সন্ত্রাসীদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।

তবে তিনি বলেন, বিদেশে বসে যারা অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের অবস্থান ও নেটওয়ার্ক আমাদের জানা আছে। তারা এখনো নিজেদের এলাকায় সীমাবদ্ধ। নতুন করে বড় মাফিয়া নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি।

র‌্যাব কর্মকর্তার মতে, উদ্বেগের বিষয় হলো—এখন সন্ত্রাসীরা কাজ ভাগ করে নিয়েছে: কেউ শুধু হুমকি দেয়, কেউ শুধু চাঁদা তোলে, কেউ কেবল শুটার হিসেবে কাজ করে। এতে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কৌশল বদলেছে, শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছেন তিনি।

সংসদ নির্বাচন ও গণভোট এক দিনে হলে বাড়বে ভোট গ্রহণের সময়

দেড় বছরেও জানা যায়নি সেই ১১৪ লাশের পরিচয়

পোশাক খাতে দুরবস্থা, রপ্তানি আয়ে ভাটা

ভারতকে খুশি করতে বারবার অস্ত্র উদ্ধার নাটক হাসিনার

মৃত্যু বাড়াচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎসা ঘাটতি

শ্রম রপ্তানির আড়ালে রাশিয়ায় সৈনিক নিয়োগের সিন্ডিকেট

হাইকোর্টের রায়ে জটিল পরিস্থিতিতে ইসি

১৩ নভেম্বর কী হবে ঢাকায়, চিন্তায় কলকাতার আ.লীগ নেতারাও

পুড়ে অঙ্গার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী জুলহাস

দেশজুড়ে চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনা