উদ্যোগ গ্রহণের এক দশক পর চট্টগ্রাম বন্দরের বহুল আলোচিত বে-টার্মিনালের স্থাপনা নির্মাণকাজ শুরু করতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১০ কোটি ডলার ব্যয়ে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ ও নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট স্থাপনে বিডারদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর অডিটোরিয়ামে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান জানান, বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়ন একটি বড় উদ্যোগ। এর পুরো নির্মাণকাজ কখন শেষ হবে তা এখনই বলা না গেলেও ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত একটি টার্মিনাল চালু করা সম্ভব হবে। যত দ্রুত সম্ভব পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বে-টার্মিনালকে ধাপে ধাপে নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর প্রথম ধাপে বাস্তবায়ন হবে ‘বে-টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (বিটিএমআইডিপি)’। এ প্রকল্পের আওতায় থাকবে টার্মিনালের চ্যানেল ও ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ, রেল ও সড়ক সংযোগ স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো উন্নয়ন। প্রকল্পের প্রাথমিক বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে বিশ্বব্যাংক দেবে ১০ হাজার কোটি টাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগ করবে চার হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।
এ প্রকল্পের আওতায় ব্রেক ওয়াটার নির্মাণে আট হাজার ২৬৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, নেভিগেশন অ্যাকসেস চ্যানেল নির্মাণে এক হাজার ৯৭৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, নেভিগেশন যন্ত্র স্থাপনে ৫৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং রেল, সড়ক সংযোগসহ অন্যান্য কাজে তিন হাজার ৪৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
গতকাল সকালে ব্রেক ওয়াটার ও অ্যাকসেস চ্যানেল নির্মাণে আগ্রহী দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে অংশ নেয় অসংখ্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানি, অনেকে যুক্ত হন ভার্চুয়ালি। বৈঠকে বিনিয়োগকারী বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
বন্দর সচিব ওমর ফারুক জানান, ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ আমাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। বিডারদের মাধ্যমে আমরা জানতে চেয়েছি, কীভাবে তারা এটি নির্মাণ করবে এবং এর প্রক্রিয়া কী হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী তাদের আগ্রহ ও প্রস্তাব জানাই ছিল এ বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য।
ব্রেক ওয়াটারের কাজ কী
সাগরের বড় ঢেউ বা প্রতিকূল আবহাওয়ায় বন্দরের স্থাপনাকে সুরক্ষিত রাখতে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করা হয়। জেটি থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে বিশেষায়িত ব্লক ফেলে অথবা দেয়ালের মতো স্থাপনা তৈরি করে এ ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করা হয়। একই সঙ্গে চ্যানেলের মধ্যে পলি জমতেও বাধা দেয় এ ব্রেক ওয়াটার। মূলত সব সমুদ্র বন্দরেই এ ব্রেক ওয়াটার তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরেও প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ কৃত্রিম ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করা হয়েছে।
বে-টার্মিনালের জন্য নির্ধারিত স্থানটি চট্টগ্রাম ইপিজেডের পেছনে, উপকূল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সাগরের ভেতরে অবস্থিত দুটি ডুবোচর এলাকায়। সেখানে সাত থেকে আট মিটার গভীর পানিতে ১৪ মিটার প্রস্থ ও ছয় মিটার উচ্চতার দেয়াল তৈরি করে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। দুটি চরকে সংযুক্ত করে ৭০০ থেকে ৮০০ মিটার প্রশস্ত অ্যাকসেস চ্যানেল তৈরি করা হবে, যার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জাহাজগুলো বে-টার্মিনালের ভেতরে প্রবেশ করবে ও পণ্য ওঠানামার পর বের হয়ে যাবে।
গতকাল বিডারদের সঙ্গে এ বৈঠকের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে গড়ালো বে-টার্মিনাল তৈরির ভৌত কাজ। বৈঠক শেষে বন্দর চেয়ারম্যান এসএম মনিরুজ্জামান জানান, বে-টার্মিনাল শুধু একটি জেটি নয়, এটি হবে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ বন্দর। নতুন প্রযুক্তি ও অবকাঠামো যুক্ত হওয়ায় বাস্তবায়নের পথে নানা নতুন বিষয় আসবে। তবে সরকার, বিশ্বব্যাংক ও বন্দর কর্তৃপক্ষ সবাই প্রকল্পটি দ্রুত শেষ করতে বদ্ধপরিকর। যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত একটি টার্মিনাল অপারেশনে আসবে। বে-টার্মিনালের স্থলভাগে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, এর মধ্যে দুটি হবে কনটেইনার টার্মিনাল এবং একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। সিঙ্গাপুরের পিএসএ ও দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড জি-টু-জি ভিত্তিতে কনটেইনার টার্মিনাল দুটি নির্মাণ করবে। অন্য মাল্টিপারপাস টার্মিনালটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করার কথা থাকলেও তাতে জি-টু-জি ভিত্তিতে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে। তিনটি টার্মিনালে প্রায় ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হতে পারে, যার মধ্যে পিএসএ ও ডিপি ওয়ার্ল্ডের প্রত্যেকের বিনিয়োগ দুই বিলিয়ন ডলার করে এবং বাকি দুই বিলিয়ন ডলার আসবে মাল্টিপারপাস টার্মিনালের জন্য।