পদ্মায় জেগে ওঠা চরে সাদা কাশফুলের সারি—দূর থেকে দেখলে মনে হয় সৌন্দর্যের এক টুকরো স্বর্গ। কিন্তু এই নির্মল সৌন্দর্যের নিচেই লুকিয়ে আছে লুণ্ঠন, সন্ত্রাস ও রক্তপাতের ভয়াবহ বাস্তবতা। শীত এলেই এই চরে শুরু হয় কোটি টাকার খড় ব্যবসাকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। সৃষ্টি হয় সংঘাত, ঝরে মানুষের জীবন। প্রতি বছরের মতো এ বছরও ইতোমধ্যে সংঘাতে মারা গেছে তিনজন। এরপর অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেককে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা না গেলে চরাঞ্চলে শান্তি ফিরবে না বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
জানা যায়, পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোর ও রাজশাহীর বিস্তৃত চরাঞ্চলে কাশফুল থেকে সংগ্রহ করা খড়ের বার্ষিক বাজারমূল্য প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। বিনা চাষের এই খড় বিক্রি পুরোপুরি লাভ হওয়ায় বছর বছর বাড়ছে এই ব্যবসার পরিধি । এর ভাগবাটোয়ারা নিয়েই শুরু হয় সংঘাত।
খড় ব্যবসায়ী মুজাম্মেল হক (মুজা) বলেন, চরের প্রকৃত মালিকরা প্রায়ই বঞ্চিত হন। বিভিন্ন বাহিনীর লোকজনই জমি দখল করে খড় বিক্রি করে। অন্যদিকে জামির মালিক খড় বিক্রি করলেও নৌকাপ্রতি ৫–৬ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।
জানা যায়, রাজশাহীর পানচাষিদের কাছে এই খড় একমাত্র ভরসা। জেলার ৯টি উপজেলায় চার হাজার ৫০৯ হেক্টর জমিতে পানের বরজ। আর এসব বরজ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে অপরিহার্য খড়। বর্তমানে এক হাজার খড়ের দাম ২২ হাজার টাকা; মৌসুমের শেষে প্রতি আঁটি খড়ের দাম পৌঁছে যায় ৩০–৩২ টাকায়। প্রায় দুই মাস ধরে চলে এই খড় ব্যবসা। মোহনপুরের পানচাষি শামিম রেজা বলেন, খড় ছাড়া পানচাষ অসম্ভব। বরজ ঢেকে রাখা না গেলে রোদ, কুয়াশায় পাতা নষ্ট হয়ে যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের প্রভাবের মধ্যেই চরাঞ্চলে বাহিনীগুলোর আধিপত্য রাজনীতি বিস্তার লাভ করে। তখন থেকেই চরের জমি ও খড় বাণিজ্য দখল করে চলে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। এখনো সেই নেটওয়ার্ক বহাল। এই নেটওয়ার্কগুলো ভেঙে না দিলে চরাঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ফিরবে না।
রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়ার পদ্মার চরজুড়ে কাঁকন বাহিনীসহ অন্তত ১১টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আধিপত্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো-মণ্ডল, টুকু, সাঈদ, লালচাঁদ, রাখি, শরীফ কাইগি, রাজ্জাক, চল্লিশ, বাহান্ন, সুখচাঁদ ও নাহারুল বাহিনী। এই গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে চরবাসীর জীবন দুর্বিষহ করে রেখেছে।
গত ২৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের হবিরচরে কাঁকন বাহিনীর গুলিতে রাজশাহীর নিচখানপুরের আমান মণ্ডল ও নাজমুল মণ্ডল নিহত হন। পরদিন একই এলাকা থেকে লিটন নামে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ধারণা করা হয়, তিনিও কাঁকন বাহিনীর সদস্য ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী মিঠু সরদার বলেন, আমরা খড় কাটতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কাঁকন বাহিনী স্পিডবোট থেকে অতর্কিত গুলি করতে শুরু করে। তারা প্রায় দুই ঘণ্টা গুলি চালায়। প্রথমে আমানের মাথায় গুলি লাগে, তাকে বাঁচাতে গিয়ে নাজমুলও মারা যায়।
বাঘার চকরাজাপুর চরের বাসিন্দা রজব মণ্ডলের ১২ বিঘা জমি রয়েছে। তিনি বলেন, চরের জমিতে জন্মানো খড় আমরা পাই না। বাহিনীর লোকজন দখল করে বিক্রি করে দেয়। প্রতিবাদ করলে মারধর করা হয়। আরেক জমির মালিক বাচ্চু যোগ করেন, ২০ হাজার টাকার খড় হলে মালিককে দেওয়া হয় মাত্র ৪-৫ হাজার টাকা। বাকিটা লুটে নেয় সন্ত্রাসী বাহিনী। বেশিরভাগ মালিক প্রাণের ভয়ে জমিতে যায় না। পদ্মার বিভিন্ন ঘাটজুড়ে প্রায়ই সশস্ত্র মহড়া চলে স্পিডবোট আর বড় নৌকায়। কাশবন, জমি ও বালু মহাল দখল এবং আধিপত্য বিস্তারই এসব বাহিনীর মূল লক্ষ্য।
সম্প্রতি পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএন মিলে সন্ত্রাসীদের দমনে ‘অপারেশন ফাস্ট লাইট’ অভিযান চালায়। চলতি বছরের ৮ ও ৯ নভেম্বর এই অপারেশন চালানো হয়। এতে ৬৭ জনকে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় উদ্ধার করা হয় ১০টি অস্ত্র, চার রাউন্ড গুলি, ছয়টি ডেসার, ২৪টি হাঁসুয়া, ৫০ পিস ইয়াবা, ৮০০ গ্রাম গাঁজা ও পাঁচটি মোটরসাইকেল।
রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, অভিযানে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। চরের সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিকভাবে এ অভিযান চলবে।
মানবাধিকার কর্মী আনোয়ার হোসেন ফিরোজ বলেন, চরের খড় ব্যবসা এখন এক অদৃশ্য অর্থনীতি। আইনগত মালিকানা থাকা সত্ত্বেও স্থানীয়রা বঞ্চিত। উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত না করলে এই সন্ত্রাসী অর্থনীতি ভাঙবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।