বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ গুড়ের হাট। জেলার প্রাচীন এই হাট এক সময় খেজুর রস ও গুড়ের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে দেশের বৃহত্তম খেজুর গুড়ের এই হাট এখন বহুমুখী সংকটে জর্জরিত। খেজুর গাছের বিলুপ্তি, গাছিদের অনাগ্রহ এবং ভেজাল গুড়ের ভয়াবহ বিস্তারের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী এই হাট।
সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের যৌথ গবেষণায় সরোজগঞ্জ হাটের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। International Journal of Sustainable Development and Planning-এ প্রকাশিত গবেষণায় সরোজগঞ্জ হাটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন গবেষকরা।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদ আলম ও সহকারী অধ্যাপক মো. আল-আমিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক মো. নুরুল আলম।
গবেষণায় বলা হয়, স্থানীয়ভাবে সরোজগঞ্জ হাটের ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো বলে প্রচলিত থাকলেও ২০ শতকের দ্বিতীয় দশকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সরোজগঞ্জ হাট’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এর বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়। পরে হাটটি গুড় কেনাবেচার বাইরে বহুমাত্রিক মিশ্র বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়; যেখানে স্থানীয় কৃষি, শিল্প ও আর্থিক কার্যক্রম একসঙ্গে বিকাশ লাভ করে।
গবেষকদলের প্রধান ড. মাহমুদ আলম বলেন, সরোজগঞ্জ হাট কেবল একটি গুড়ের বাজার নয়, এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনধারার একটি প্রতিচ্ছবি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই হাট স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। কিন্তু বর্তমানে ক্রমাগত খেজুর গাছের সংখ্যা হ্রাস, ভেজাল গুড়ের বিস্তার ও গাছিদের পেশা ত্যাগÑএ তিনটি প্রধান সংকট পুরো শিল্পকেই বিপদে ফেলেছে।
গবেষণা প্রতিবেদন উল্লেখ করে তিনি বলেন, খেজুর গাছের সংখ্যা এখন আগের তুলনায় নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। এর প্রধান কারণ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছের ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে গাছের ক্ষতি। এছাড়া খেজুরের রস সংগ্রহ করা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হওয়ায় নতুন প্রজন্ম এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লাভের আশায় গুড়ের সঙ্গে সোডা, রঙ, ফিটকিরি ও অন্যান্য রাসায়নিক মিশিয়ে তা বিক্রি করছে। এটা শুধু ঐতিহ্যের ক্ষতি নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও বড় হুমকি। তবে এসব সংকট সত্ত্বেও সরোজগঞ্জ হাট এখনো দেশের অন্যতম সক্রিয় গুড়ের হাট হিসেবে টিকে আছে বলে মনে করেন গবেষকরা। তাদের মতে, এটি একটি মিশ্র অর্থনৈতিক কেন্দ্র; যেখানে বাণিজ্য, কারুশিল্প ও ক্ষুদ্রশিল্প একে অপরের পরিপূরক হয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখছে।
দেশজুড়ে সরোজগঞ্জের গুড়ের বিপুল চাহিদা রয়েছে। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলার পাইকাররা প্রতি মৌসুমে এই হাট থেকে নিয়মিত খেজুর গুড় কিনে নিয়ে যান। শুধু দেশের বাজারেই নয়; ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানকার গুড় ভারত, সৌদি আরব, কানাডা, ইতালি, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় ।
গবেষণায় দেখা যায়, সরোজগঞ্জ হাটে প্রতি মৌসুমে গড়ে পাঁচ হাজার ৪১২ টন খেজুর গুড় কেনাবেচা হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সংগৃহীত এ তথ্য অনুযায়ী, এখানকার প্রধান চার প্রজাতির গুড় হলোÑনোলেন পাটালি, দানা গুড়, ঝোলা গুড় ও চিটিয়া গুড়।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, গুড়বাণিজ্যকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে সহায়ক শিল্প হিসেবে মৃৎশিল্পের বিস্তার ঘটেছে। গুড় সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য মাটির পাত্র তৈরিতে স্থানীয় অনেক কারিগর যুক্ত, যা গ্রামীণ অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে গবেষকরা সতর্ক করেছেন, এই ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। খেজুর গাছ সংরক্ষণ, গাছিদের আর্থিক সহায়তা, ভেজাল প্রতিরোধ এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে না পারলে সরোজগঞ্জের শতবর্ষী ঐতিহ্য বিলীন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
ড. মাহমুদ আলম বলেন, সরোজগঞ্জ শুধু অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি উদ্যোগ, গবেষণা সহায়তা এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণÑসব একসঙ্গে প্রয়োজন। না হলে একদিন হয়তো এই ঐতিহ্য কেবল ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবে।