ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ইতোমধ্যে বিএনপি সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় রাজশাহী জেলার ছয়টি আসনের জন্যও প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই রাজশাহীর রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। জেলার ছয়টি আসনের তিনটিতেই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। আসনগুলো হলো—রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর), রাজশাহী-৪ (বাগমারা) এবং রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর)। এই তিন আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন যথাক্রমে অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন, ডিএম জিয়াউর রহমান জিয়া ও অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডল।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর)-এ বহিরাগত প্রার্থী নিয়ে ক্ষোভ। এই আসনে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলনকে। কিন্তু তার মনোনয়নের পর থেকেই বিক্ষোভ করে আসছে স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত সোমবার পবা উপজেলার আন্ধারকোঠা এলাকায় উপজেলা বিএনপির উদ্যোগে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কর্মীরা অভিযোগ করেন, শফিকুল হক বহিরাগত হওয়ায় তাকে গ্রহণ করা কঠিন। তারা স্থানীয় প্রার্থী চেয়ে তার মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানান।
এর আগে গত রোববার রাতে নগরীর আলোকা মোড়ে মশাল মিছিল বের করে মিলনের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে স্লোগান দেন বিক্ষুব্ধ কর্মীরা। এছাড়া গত সোমবার বিকেলে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধের ঘটনাও ঘটে।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মিলন বলেন, আমি ২০১৩ সাল থেকে পবা-মোহনপুরের মানুষের সঙ্গে আছি। ২০১৮ সালেও এই আসনে বিএনপি আমাকে প্রার্থী করেছিল। কিন্তু ফ্যাসিবাদী সরকারের জুলুমে আমার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আব্দুল মজিদ বলেন, তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে মনোনয়ন দিলে সংগঠনে ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়। রাজশাহী-৩ আসনে সেটিই হচ্ছে।
অন্যদিকে রাজশাহী-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী ডিএম জিয়াউর রহমান জিয়ার সমর্থকদের বিরুদ্ধে সহিংস কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। গত শনিবার রাতেই বাগমারার দুবিলা এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ও তিনটি পুকুরে বিষ প্রয়োগের ঘটনা ঘটে। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, এসব হামলার সঙ্গে প্রার্থীর সমর্থকরা জড়িত।
প্রার্থী জিয়া এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বাগমারার সবাই আমার কর্মী। আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করছে। মনোনয়ন বঞ্চিত উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব অধ্যাপক কামাল হোসেন সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, মনোনয়নের পর প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে, যা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক রমজান আলী বলেন, বাগমারায় দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল। মনোনয়ন ঘোষণার পর সেটি সহিংস আকার ধারণ করেছে, যা নির্বাচনি পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক।
এছাড়া রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডলকে মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতারা। গত রোববার পুঠিয়ায় সংবাদ সম্মেলন থেকে স্থানীয় বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘদিন দলের কার্যক্রম থেকে দূরে থাকা এক জনবিচ্ছিন্ন নেতাকে প্রার্থী করায় কর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে।
তাদের দাবি, ত্যাগী ও সক্রিয় স্থানীয় নেতাদের উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী দেওয়ায় সংগঠনে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে তারা তারেক রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে প্রার্থী পরিবর্তনের আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনোয়ার হোসেন বলেন, বিএনপি এখন প্রার্থী নয়, প্রক্রিয়াগত সংকটে ভুগছে। তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করলে নির্বাচনের মাঠে ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হবে।
স্থানীয় ভোটার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, দল যদি এলাকার পরিচিত মুখকে প্রার্থী না করে, ভোটারদের আগ্রহও কমে যায়। দলীয় ঐক্য ছাড়া জয় সম্ভব নয়। রাজশাহীর তিনটি আসনে বিএনপির মনোনয়নকে ঘিরে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা দলটির জন্য বড় পরীক্ষার মুখ তৈরি করেছে। স্থানীয়দের মতে, কেন্দ্র দ্রুত হস্তক্ষেপ না করলে নির্বাচনের মাঠে বিএনপির অবস্থান আরো দুর্বল হতে পারে।