আধুনিক হচ্ছে দেশের কৃষি। উদ্ভাবন হচ্ছে নতুন নতুন ধানের জাত। উচ্চ ফলনশীল এসব জাতে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। নতুন বেশ কয়েকটি ধান চাষ করে ইতোমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন লক্ষ্মীপুরের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা আবদুর রহমান সোহাগ। এ বছর তিনটি নতুন জাত সহ মোট ১২টি জাতের ধান পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেন তিনি। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সোহাগ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের নলডগী গ্রামের ইব্রাহীম খলিলের ছেলে। তিনি লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের ডিগ্রি ২য় বর্ষের ছাত্র। আট বছর যাবৎ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত সোহাগ। ধান ছাড়াও সয়াবিন, সূর্যমুখী, সরিষা, তিল, ক্যাপসিকাম, চূড়াইফলসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেন তিনি।
জানা যায়, এ বছরের জুন মাসে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত লবণাক্ততা সহনশীল, উচ্চ ফলনশীল, বোরো ও ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী- এমন তিনটি নতুন ধানের জাত অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় বীজ বোর্ড (এনএসবি)। নতুন এ তিন জাত হলো :- ব্রি ধান-১১২, যা মাঝারি মেয়াদি রোপা আমনের জাত, এছাড়া লবণাক্ত জমির জন্য উপযোগী। ব্রি ধান-১১৩ জাতটি বোরো মৌসুমের জন্য উদ্ভাবিত এবং জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান-২৯ এর বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্রি ধান-১১৪, যা ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী এবং দীর্ঘ জীবনকালীন বোরো জাত; ব্লাস্ট রোগের কারণে যে-সব এলাকায় ধানের ফলন কমছে, সেসব এলাকায় এই জাতটি চাষ করে কৃষকরা উপকৃত হবেন। এ নতুন তিন জাত লক্ষ্মীপুরে ২ একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে আবদুর রহমান সোহাগ। ফলনও ভালো হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের যাচাই-বাছাইয়ের পর নতুন এ তিনটি জাত সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।
এছাড়া গত বছর বোরো মৌসুমে নতুন জাত ব্রি ধান-১০০, ব্রি ধান-১০২, ব্রি ধান-১০১, ব্রি ধান-১০৮, ব্রি ধান-১০৭, ব্রি ধান-১০৫, ব্রি ধান-১০৪ চাষ করে সে। এর মধ্যে ব্রি ধান-১০৫ কে ডায়াবেটিস ধানও বলা হয়। এর চাল খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। ব্রি ধান-১০০ জিং সমৃদ্ধ। এছাড়া আউশ মৌসুমে ব্রি ধান-৯৮, আমন মৌসুমে ব্রি ধান-১০৩, ব্রি ধান-৮৭, ব্রি ধান-৯৪, ব্রি ধান-৯৫ চাষ করেছে সোহাগ। এদের মধ্যে ব্রি ধান-১০৮ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং তার কাছ থেকে সারাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্রিজ সংগ্রহ করে। নতুন উদ্ভাবিত তিন জাতসহ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এখন পর্যন্ত মোট ১২১টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে ৮টি হাইব্রিড জাত।
আবদুর রহমান সোহাগ জানান, ২০১৯ সাল থেকে তিনি কৃষির সাথে জড়িত হন এবং ২০২১ সাল থেকে নতুন জাত নিয়ে কাজ করেন। বোরো, আমন ও আউশ মৌসুমি পরীক্ষামূলকভাবে ধানের নতুন নতুন জাতগুলো তিনি চাষ করেন। নতুন জাতগুলো চাষ করে তিনি ব্যাপক ফলন পাচ্ছেন। এ বছর ২ একর জমিতে তিনটি নতুন যাত পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেন তিনি। যা আর শুধু বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাষ হয়েছে। আগামী মৌসুমে সারাদেশের কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের মাঝে নতুন জাতের বীজ ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। এরআগে তার চাষকৃত ব্রি ধান-১০৮ জাত সারাদেশে ব্যাপক সাড়া পেলেছে। পরীক্ষামূলক এসব নতুন জাতের ধান চাষে তদারকি করেন জেলা ও সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এছাড়া, প্রতি মৌসুমে গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বৈজ্ঞানিকরা এসে মাঠ পরিদর্শন করে যান এবং এলাকার কৃষকদের মাঝে নতুন ধানের বীজ ছড়িয়ে দেন। তার দেখাদেখি অনেকেই নতুন নতুন এসব ধান চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
স্থানীয় কৃষক আবদুস শহীদ বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে কৃষির সাথে জড়িত। কিন্তু কৃষিতে তেমন ভালো করতে পারছি না। সোহাগ আধুনিক কৃষির সাথে জড়িত, এতে সে ভালো ফলন পাচ্ছে। আমরাও তার কাছ থেকে নিয়মিত পরামর্শ নিচ্ছি। এছাড়া নতুন নতুন যে জাতগুলো আছে সোহাগের কাছ থেকে ঐ জাতগুলো নিয়ে আমরা চাষ করছি এবং ভালো ফলন পাচ্ছি। আমাদের এলাকার প্রায় শতাধিক কৃষক নতুন এসব জাত চাষ করে। আমরা মনে করি সোহাগের হাত ধরে আধুনিক কৃষি ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে।
সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হাসান ইমাম জানান, সোহাগ একজন আদর্শ কৃষক। সে প্রতিবছর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে নতুন যে জাতগুলো উদ্ভাবিত হয় সেগুলো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক চাষ করে। এ বছর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের নতুন তিনটি জাত সে চাষ করে। আমরা মাঠপর্যায়ে তা তদারকি করি এবং তাকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তিনি সঠিকভাবে চাষ করছেন কিনা সেটি তদারকি করি এবং যে-কোনো বিষয়ে আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি। ইতোমধ্যে নতুন জাতের ধান গুলো চাষ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ধান নিয়ে গবেষণা করে। কীভাবে ফলন বৃদ্ধি করা যায় আমরা তা নিয়ে কাজ করি। সম্প্রতি আমরা আরো ৩টি নতুন জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছি। যা পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হচ্ছে। সবগুলো ভালো জাত। এখন প্রত্যেক জাতেরই ফলন বেশি। সোহাগদের মতো নতুন নতুন উদ্যোক্তারা আমাদের এ কাজে সহযোগিতা করছেন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এর জন্য অগ্রণী ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।